জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -২৯/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

 অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -২৯


সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও জিনিয়াস (২)

যন্ত্রযুগে ঘড়ি যেমন প্রতি সেকেন্ডকেও সশব্দে ঘোষণা করল, টাকা যেমন হল গতিশীল ও সৃষ্টিশীল, তেমনি বিদ্যাবুদ্ধি শিল্পকলা সব কিছুর উপর 'প্রতিভা'র ছাপ পড়লো। 'প্রতিভা' বা 'জিনিয়াস' কথার জন্ম হয় বুর্জোয়া যুগে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টাকা যেমন স্রষ্টা, 'ক্যাপিটাল' যেমন 'ক্রিয়েটিভ', তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকলেই স্রষ্টা, সকলেই 'ক্রিয়েটিভ।' কিন্তু ধনতান্ত্রিক যুগের শৈশবকালে এই সৃষ্টিশক্তির চেতনা সুস্থ চেতনা ছিল। কর্মী ও শিল্পীর মধ্যে তখনও ব্যবধানের প্রাচীর ওঠেনি। ধনতান্ত্রিক যুগের যখন বিকার ও সংকট দেখা দিয়েছে, যখন সমস্ত সমাজ 'পাগলাগারদ'-এ পরিণত হয়েছে, তখন 'জিনিয়াস' এর স্বাতন্ত্র্যবোধও উগ্র হয়ে উঠেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে 'লুনাসি' হয়েছে 'জিনিয়াস' এর নামান্তর, 'পাগলামি' ও 'প্রতিভা' এক হয়ে মিশে গেছে। 

বুর্জোয়া যুগ বা ধনতান্ত্রিক যুগের শ্রমভেদের ফলে সংস্কৃতিসংকট সৃষ্টি করেছে, ধনতান্ত্রিক যুগের শৈশবকালের তা করেনি। তখন শিল্পীরা বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, ইঞ্জিনিয়াররাও শিল্পী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমভেদ যেমন প্রকট হয়ে উঠেছে, সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও 'ক্রিয়েটিভ' জিনিয়াসদের কৌলীন্য ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তেমনি বিকট মূর্তি ধারণ করেছে। সাহিত্যক্ষেত্রেও যিনি কবি, গল্পলেখক বা ঔপন্যাসিক তিনি 'ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস', আর যিনি ঐতিহাসিক, সমালোচক, সমাজবিজ্ঞানী বা গবেষক তিনি 'প্রোডাক্টিভ লেবারার'। যিনি স্টুডিওতে ছবি আঁকেন, পাথরের মূর্তি গড়েন, তিনি 'জিনিয়াস', যিনি বাড়িঘর নির্মাণ করেন, নগর-পরিকল্পনা করেন, তিনি 'ফিল্ড লেবারার'। যিনি ল্যাবরেটরিতে বন্দি হয়ে অধীত বিজ্ঞানের গবেষণা করেন, তিনি 'জিনিয়াস', যিনি নকশা করেন, ইঞ্জিনিয়ার, তিনি 'মজুর' মাত্র। এই যে বিকট বৈষম্য, এ হল বিকৃত বুর্জোয়া যুগের দান। কল্পনার ঐশ্বর্য এবং সেই কল্পনাকে রুপ দেওয়ার শক্তি যদি 'প্রতিভা'র বৈশিষ্ট্য হয় তাহলে কবি বা ঔপন্যাসিকের চেয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীর কল্পনাশক্তি কম নয়, বরং বেশি। 'ইমেজ' ও ঘটনাকে কবি ঔপন্যাসিক যেমন চোলাই করে তাকে সাহিত্যিক রূপ দেন, ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীরাও তেমনি প্রচুর উপাদান চোলাই করে তাকে সাহিত্যিক রূপ দেন।
যিনি বিরাট একটি নগরের পরিকল্পনা করেন, তিনি স্টুডিয়োবন্দি ভাস্কর বা শিল্পীর চেয়ে কম 'প্রতিভাশালী' কীসে? যে মিস্ত্রি একটা নিরেট কাঠ খণ্ড থেকে সুন্দর একটা কাঠের জিনিস তৈরি করেন, তিনি কি শিল্পী নন? যিনি যন্ত্রের ডিজাইন করেন, বিরাট জটিল যন্ত্রের মধ্যে যাঁর সমস্ত কল্পনা মূর্ত হয়ে ওঠে, তিনি 'বিশুদ্ধ' বিজ্ঞানীর চেয়ে কম শক্তিশালী কীসে? এই বিভেদ ও বৈষম্য, এই 'fantastic nonsense' উদীয়মান গতিশীল বুর্জোয়া যুগের দান নয়, অস্তগামী বিকৃত ধনতান্ত্রিক যুগের দান। একশ্রেণির তথাকথিত মার্কসবাদীদের মধ্যেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে 'জিনিয়াস' এর একাধিপত্য, স্বাতন্ত্র্য ও সংকীর্ণতা সম্পূর্ণ অর্থহীন 'ননসেন্স'। 
নতুন জ্ঞানজগতের কলম্বাস বেকন বললেন -- কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে নিরপেক্ষ ও একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণই হবে বিজ্ঞানীর প্রথম কর্তব্য। কিন্তু মনের অবস্থা ঠিক ভাঙা আরশির মতন হয়ে আছে। সেখানে যা কিছু প্রতিফলিত হয় তার আসল রুপের বদলে বিকৃত রূপটাই বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেইটাই মনে হয় সত্য। মনের আরশিটা এইভাবে ভেঙে রয়েছে কতকগুলি কুসংস্কারের ভারে। তিনি এদের 
'idols' বা 'ভূত' বলেছেন। ভূতগুলির মধ্যে চার শ্রেণির ভূতের দৌরাত্মই মারাত্মক।

মানবজাতির কতকগুলি সাধারণ সংস্কার আছে। তার মধ্যে প্রধান হল, যা ভালো লাগে তা-ই সত্য বলে বিশ্বাস করার প্রবৃত্তি। এ হল 'জাতের ভূত।' 
প্রত্যেক ব্যক্তির কতকগুলি নিজস্ব সংস্কার আছে, কিছুতেই তা সে ছাড়তে চায় না। এগুলি 'গুহার ভূত'।
ভাষাগত কতকগুলি সংস্কার আছে যা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকে। ভাবের আদান-প্রদানের ভিতর দিয়ে কতকগুলি 'শব্দ' ও 'নামের' সৃষ্টি হয়। মানুষ মনে করে নামগুলির সঙ্গে বাস্তব অস্তিত্বেরও সম্পর্ক আছে। যেমন দৈব অদৃষ্ট ভাগ্য ভূত ইত্যাদি। এগুলি 'বাজারের ভূত'।

এগুলি হল 'বিশেষ চিন্তাধারা'র সংস্কার। বেকন বেশ জোর দিয়ে বলেছেন-- 'আমার মতে, পৃথিবীতে যেসব দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়েছে সেগুলি রঙ্গমঞ্চের নাট্যাভিনয়ের মতন। নানা রকমের অবাস্তব দৃশ্যপট দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে দার্শনিকরা তাদের নিজস্ব মনগড়া জগতের অভিনয় করে গেছেন মাত্র'। তাই এই দার্শনিক মতামতগুলি 'রঙ্গমঞ্চের ভূত'।

শাস্ত্র ধর্ম দেশাচার জনশ্রুতি ও নানা রকমের কুসংস্কারের কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ গবেষণা ও পরীক্ষার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করতে হবে। বেকনের এই পথ ধরেই হবস (Hobbes) ও লক (Locke) আরও অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। বেকনের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে লকবাস্তব দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করলেন। লক বললেন, যে জ্ঞান ইন্দ্রিয়গোচর নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, তা সত্য নয়, জ্ঞানই নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে ইন্দ্রিয়ের অগোচর যা তা জানবার শক্তি মানুষের নেই। বস্তুবাদ দৃঢ়পদে বেকন থেকে হবস, হবস থেকে লক পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ফ্রান্সে দেকার্ত (Rene Descartes) বস্তুবাদের এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। মধ্যযুগের সমস্ত কুসংস্কার ধর্মবিশ্বাস ও দেশাচারের বিরুদ্ধে দেকার্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং স্বাধীন চিন্তা যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব মুক্তকণ্ঠে প্রচার করলেন। 
ধনতান্ত্রিক যুগের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়াশ্রেণীর ভূমিকা বদলেছে। যতদিন বুর্জোয়াশ্রেণির আধিপত্য সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যতদিন তারা শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হয়নি, ততদিন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে তাদের বিরোধও তীব্রতর হয়নি, স্পষ্টতর হয়নি। তা যখন হল তখন বুর্জোয়াশ্রেণি দেখল, মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যেসব হাতিয়ার নিয়ে তারা সংগ্রাম করেছে সেইসব হাতিয়ার তাদের বিরুদ্ধেই উদ্যত হয়েছে। যে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও স্বাধিকারের আদর্শ তারা প্রচার করেছে, প্রবর্তন করেছে, সেই আদর্শ এখন তাদেরই আধিপত্যকে ধূলিসাৎ করতে চাইছে। তাদের অগ্রগতির 'মূলমন্ত্র' যে স্বাধীন চিন্তা যুক্তি বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি, তা-ই এখন 'সোশ্যালিস্টিক' হয়ে উঠছে। সোশ্যালিজমের বিকাশ হচ্ছে এই স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার পথে, সেই যুক্তি ও বুদ্ধির অবিশ্রান্ত অভিযানের পথে, বিজ্ঞান ও শিক্ষার আলোকে উজ্জ্বলতর হয়ে। তাইতো বুর্জোয়াশ্রেণিকে আবার, মার্কসের ভাষায়, সমাজের 'all the elements of that vague, dissolute, down-at-heels and out-at-elbows rabble' দলবদ্ধ করতে হচ্ছে। তাই বুর্জোয়াশ্রেণীকে মধ্যযুগের আবর্জনাস্তূপ ঘেঁটে আবার তাকে ধর্মশাস্ত্র অধ্যাত্মবাদ জাদুমন্ত্র কুসংস্কার জড়তা গোঁড়ামি সংকীর্ণতা স্বেচ্ছাচারিতা, সবই কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জড়ো করতে হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে 'লিবার্টি ইকুয়ালিটি ফ্রেটার্নিটি'র বদলে 'ইনফ্যান্ট্রি ক্যাভালরি আর্টিলারি'র মহত্ত্বও প্রচার করতে হচ্ছে, কারণ 'সোশ্যালিজম' এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে তাদের। কিন্তু এ হল আধুনিক ইতিহাস, ব্যাধিগ্রস্ত ধনতান্ত্রিক যুগের সংকট এবং বুদ্ধিজীবী সংকটের ইতিহাস।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. অসম্ভব ভালো একটা বিষয়ভিত্তিক লেখা আপনার কলামে জ্বলদর্চিতে পড়ে চলেছি।আশা করছি পুস্তকাকারে বের করবেন এই সমৃদ্ধ তথ্য পরিপূর্ণ এবং নিজস্ব চেতনায় দেখা লেখাগুলি। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।

    ReplyDelete