জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -৩০/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

 অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল -৩০

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও সমাজ-৪

বুদ্ধিজীবীর অন্তর্ভুক্ত হবেন কারা?
প্রথমেই যদি ধরি বুদ্ধিজীবী চিহ্নিত করতে গেলে, তার মাপকাঠি শিক্ষা। তবে এবার প্রশ্ন উঠবে স্বল্পশিক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষিত সকলেই কি 'বুদ্ধিজীবী'। তার চেয়ে ও বড় কথা শিক্ষিত বা বিদ্বান হলেই কি বুদ্ধিজীবী হবেন? 

চাণক্য শ্লোক হল, "বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।/ স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।" অর্থাৎ বিদ্বানের সঙ্গে রাজার কখনো তুলনা হবে না। রাজা স্বদেশে ক্ষমতা ও আধিপত্যের জোরে যে সম্মান আদায় করেন, বিদেশে না-ও পেতে পারেন। কিন্তু যিনি প্রকৃত বিদ্বান এবং জ্ঞানের অধিকারী, তিনি দেশের বাইরে ও পূজা পান। যিনি সম্যক বিদ্যা অর্জন করেন, তিনিই বিদ্বান। যেহেতু বিদ্যা সব দেশে প্রয়োজন, তাই বিদ্বানের সম্মান সর্বত্র রয়েছে। কিন্তু রাজা হলে যে, তিনি বিদ্বান হবেন এমন কোনো কথা নেই। 

কয়েক বছর আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ,'অর্মত্য সেন' বলেছিলেন- কই 'নিউ ইয়ার্স ডে', 'ভ্যালেন্টাইন ডে', 'ক্রিসমাস ডে' এসব আমাদের সংস্কৃতি না হওয়ার সত্ত্বেও উৎসবের মেজাজে পালিত হয় আমাদের দেশে। কিন্তু 'জয় শ্রী রাম' কেউ বলতে না চাইলে তাকে দিয়ে জোর করে বলানো হবে কেন?" এই কথা শুনে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য বলেছিলেন, 'উনার কোনো সামাজিক গ্রহণ যোগ্যতা নেই।' অথচ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য থাইল্যান্ডের যুব রানি 'চুলাভর্ন ওয়ালাইলাক' চাণক্যের এই শ্লোক মেনে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে দেখা করতে বিশেষ বিমানে কলিকাতায় এসেছিলেন। যদিও যুবরানি রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপিকা। 
চাণক্য যে যুগের কথা বলেছেন, সে যুগে সাধারণ মানুষের স্বতন্ত্রভাবে কাউকে সম্মানিত করবার অধিকারই ছিল না। বিদ্যা পাণ্ডিত্য প্রতিভা সবই রাজস্বীকৃতির মুখাপেক্ষী ছিল। বিদ্যার অধিকারও ছিল জাতিগত ও কুলগত। সেকালের পণ্ডিতসমাজ এই বিশেষ জাতি ও কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের চেয়ে কুল-কৌলীন্যের মর্যাদা ছিল তাদের বেশি। ব্রাহ্মণ সকলের পূজ্য ও সর্বাগ্রে পূজ্য, পণ্ডিত হন বা না হন। পণ্ডিত হলে সকলের তিনি 'পণ্ডিতমশাই', কিন্তু প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয় তিনি ব্রাহ্মণ বলে। ব্রাহ্মণপণ্ডিতের বংশধর গণ্ডমূর্খ হলেও প্রণম্য এবং পণ্ডিতের তূল্য পূজনীয়। পণ্ডিত বা বিদ্বান হওয়ারও সুযোগ ছিল না সকলের।  শুদ্রদেরও সেকালে বিদ্যার অধিকার ছিল, অব্রাহ্মণদের মধ্যেও অনেক পণ্ডিত ছিলেন, এবং তাঁরা সমাজে সমাদৃতও হতেন। অনেক গূঢ়তত্ত্ব ক্ষত্রিয়দেরই শুধু জানা ছিল এবং ব্রাহ্মণরা তাদের শিষ্যত্ব স্বীকার করে সেই সব তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতেন। শূদ্রাগর্ভজাত মহামতি বিদূরের জ্ঞানবিদ্যার তুলনা নেই। তিনি সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। সৌতি মহাভারতের প্রচারক ছিলেন। সে যুগে শূদ্রের শাস্ত্রবিদ্যায় অধিকার ছিল না। ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তরে একবার বিদুর বলেছিলেন, "আমি শুদ্রার গর্ভে জন্মেছি,তাই মৃত্যুর গূঢ়তত্ত্ব জানলেও আমি প্রকাশ করতে পারব না। ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে অতি গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ করলেও, দেবতাদের নিন্দনীয় হতে হয় না।" তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে শুদ্র যদি দৈবক্রমে পণ্ডিতও হয়, তাহলেও সমাজ তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করার কোনো অধিকার নেই। এই ছিল সেকালের সমাজনীতি। সেকালের পণ্ডিতসমাজ বলতে ব্রাহ্মণসমাজকেই বোঝাত এবং পাণ্ডিত্য ও ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুগ পর্যন্ত জ্ঞান-বিদ্যার ক্ষেত্রে এই কুলাধিপত্যই প্রায় অপ্রতিহত ছিল বলা চলে। ইংরেজ শাসকরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে সংস্কৃত কলেজ কলকাতা শহরে স্থাপন করেছিলেন, সেখানেও ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানদের ছাড়া অন্য কারও পড়বার অধিকার ছিল না। সংস্কৃত-শিক্ষা সম্পর্কিত কুলগত সংস্কার ইংরেজরাও স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
অবশেষে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকেই এই সংস্কার দূর করতে হল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে কায়স্থদের এবং পরে ১৮৫৪ সালে ডিসেম্বর মাসে অন্যান্য জাতির হিন্দুদের সংস্কৃতবিদ্যা শিক্ষার অধিকার দান করেন। ইংরেজিতে 'intelligentsia' বলে যে কথা আছে, তা রুশদের প্রবর্তিত। 'ইন্টেলজিনসিয়ার' বাংলা প্রতিশব্দ 'বিদ্বৎসমাজ'। 'শ্রেণিচেতনা' মূলত আর্থনীতিক স্বার্থের একতাবোধ থেকে উদবুদ্ধ হয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণপদ্ধতি ভিন্ন হলেও, যদিও সে-পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তাহলে তার ফলাফল ভিন্ন হতে পারে না, হওয়া উচিৎ নয়। সমাজবিজ্ঞানীই স্বতন্ত্র শ্রেণিমর্যাদা দেননি, কেউ 'গ্রুপ স্টেটাস' কেউ 'কমিউনিস্ট স্টেটাস' দিয়েছেন। কার্ল মার্কস 'বিদ্বৎজনদের' মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ঐতিহাসিক চরিত্রের সুস্থিরতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। 

আপাতত দেখা যাচ্ছে যে বিদ্বৎজনেরা কোনো স্বতন্ত্র 'শ্রেণি' নন এবং এ- সম্বন্ধে সকলমতের সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রায় একমত। 'ইন্টেলিজেন্সিয়া' মানে 'socially unattached free intelligentsia'। এ যুগের আর একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহাইম 'ইন্টেলিজেনসিয়া' সম্পর্কে বলেছেন- 'This unanchored, relatively classless stratum', রবার্টো মিচেলস বলেছেন- 'intellectuals are the officers and subalterns of all arms and of all armies' ঐতিহাসিক টয়েনবি কালসমুদ্র মন্থন করে শেষ পর্যন্ত একটি বিষের পাত্র বিদ্বৎজনদের সামনে তুলে ধরে বলেছেন- 'an intelligentsia is born to be unhappy' এবং কটাক্ষ করে বলেছেন- 'the intelligentsia is a class of liason officers.' 
সহজ ভাষায়, বিদ্বৎজনের অবস্থা হল, 'ঘরেও নহে, পারেও নহে, যেজন আছে মাঝখানে,' কতকটা তার মতো সারাজীবন সাধ্যমতো বিদ্যার কেরামতি দেখিয়ে সমাজের কাছ থেকে তিনি যা পান, তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন না। শেষ-জীবনে তাঁর মনে হয়, সমাজের তরী যেন তাকে তীরে নিক্ষেপ করে, পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে চলে গেছে। সমাজের মধ্যে থেকেও তিনি যেন জনমানবশূন্য দ্বীপে নির্বাসিত। একথা যত মনে হয় তত অতৃপ্তি বাড়ে, আক্রোশ বাড়ে, অভিমান বাড়ে। বিদ্বৎজনদের এই অতৃপ্তিকে টয়েনবি তাই 'congenital unhappiness' বলতে কুণ্ঠিত হননি। 
আমরা কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছি এবং সেই শিক্ষাকে সমাজের কাজে নিয়োগ করেছি'- এ বোধ সর্বস্তরের বিদ্বানদের মধ্যে আছে। সাধারণ গ্রাম্য স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক সাহিত্যিক সাংবাদিক বৈজ্ঞানিক, একনিষ্ঠ জ্ঞানতপস্বী সকলের প্রধান বিদ্যার্জনের একটা একানুভূতি আছে। এই একানুভূতি থেকে সকল স্তরের বিদ্বৎজনের মধ্যে একটা সহানুভূতির ভাব সঞ্চারিত হয়। এই সহানুভূতি থেকেই তাদের মধ্যে 'সমাজ'-বোধ আছে। ব্রাহ্মণসমাজ বৈদ্যসমাজ কায়স্থসমাজ যেমন 'কমিউনিটি' বোধ থেকে গড়ে ওঠে (শ্রেণিবোধ থেকে নয়), বিদ্বৎসমাজেরও কতকটা সেরকম বিকাশ হয়। 'সমাজ' কথার এই অর্থে, বিদ্বৎজনদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র 'বিদ্বৎসমাজের' কথা ভাবা যেতে পারে।এখনকার  বিদ্বৎসমাজের কথা ভাবলেও ভুল হয় না। 'Officers and Subalterns of all arms and of all armies' এর মধ্যে শ্রেণিগত ঐক্য না থাকলেও, সমাজগত একতাবোধ থাকতে বাধা নেই। বৈদ্যসমাজে যেমন 'প্রলেটারিয়েট' বৈদ্যের প্রতি 'ক্যাপিটালিস্ট' বৈদ্যের একটা অদৃশ্য সহানুভূতি থাকে, ব্রাহ্মণসমাজে যেমন সব ব্রাহ্মণের সমান class status না থাকা সত্ত্বেও একটা সমাজবোধ থাকে, বিদ্বৎসমাজেও তেমনি অফিসার ও সাব-অল্টার্ন, ক্যাপ্টেন ও জমাদার, গোলন্দাজ ও পদাতিক, সর্বস্তরের মধ্যে, শ্রেণিবৈষম্য থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছন্দে একটা সমাজবোধের বন্ধন থাকতে পারে এবং আছেও। তবে এই সমাজবোধের বন্ধন যে শ্রেণিবোধের বন্ধের তুলনায় অনেক বেশি শিথিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments