জ্বলদর্চি

এপার ওপার বাংলার পিঠে/রোশেনারা খান

এপার ওপার বাংলার পিঠে 

রোশেনারা খান


পিঠে খেলে পেটে সয় কিনা, সে পরের কথা। তবে এই সেদিন পর্যন্ত বাঙ্গালির পছন্দের খাদ্য তালিকায় পিঠের স্থান ছিল সবার ওপরে। সেই তালিকায় কিছু অবাঙ্গালি ও চিনে খাবার ঢুকে পড়লেও বাঙ্গালির রসনা আজও পিঠের কথা শুনলে সিক্ত হয়ে ওঠে।

 পিঠের ইতিহাস বহু পুরনো। সভ্যতার আদিতেই পিঠের জন্ম। মানুষ যে তখন বিভিন্ন জিনিসের মণ্ড আগুনে পুড়িয়ে খেত সেটাই ছিল পিঠে বানানোর আদিম পদ্ধতি। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে পিঠেরও পদ্ধতি, আকৃতি ও স্বাদের পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন ধান উঠলেই গ্রামাঞ্চলে পিঠের বানানোর ধূম পড়ে যায়। আতপ চালের জন্য ধান সরিয়ে রাখা হয়। এই ধান থেকে যে আতপচাল পাওয়া যায়, সেই চাল দীর্ঘক্ষণ জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর ঝুড়িতে ছেঁকে রেখে ভাল করে  জল ঝরতে নিতে হয়। এই চাল ঢেঁকিতে কুটে যে গুড়ি তৈরি হয়, সেই  গুড়িই হল পিঠে তৈরির প্রধান উপকরণ। এর সঙ্গে কমপক্ষে আর যে উপকরণগুলি লাগে, তা হল গুড়, তেল আর নারকেল। কিছু পিঠে মেশিনে গুড়ো করা শুকনো চালের গুড়ি দিয়েও বানানো যায়।

  ওপার এপার মিলিয়ে দুই বাংলায় কত রকম যে পিঠে হয়, তার পরিসংখ্যান বলা মুশকিল। গ্রামের মানুষের কাছে, মানে যারা এখনো গ্রামীণ পরম্পরাকে ধরে রেখেছেন তাঁদের কাছে পিঠে খুবই উপাদেও খাবার। বাড়িতে কুটুম্ভ বা জামাই এলে পিঠে বানিয়া খাওয়ানো হয়। তাছাড়া পরিবারের সকলের জন্যও শীতকাল জুড়ে প্রায় সব বাড়িতেই সকাল-সন্ধে পিঠে বানানো হয়। এই সময় যেমন নতুন ধান ওঠে, তেমন আখ ও সুস্বাদু খেজুরের গুড় এই সময়ই তৈরি হয়। শীতকালে পিঠে খাওয়াও যায় রাখাও যায়।
সাধারণত যে সব পিঠে সচরাচর সবার বাড়িতে হয়ে থাকে তা হল-পুরপিঠে বা পুলিপিঠে, চিতুইপিঠে, সরুচাকলি, গুড়পিঠে বা পাকান পিঠে, পাটি সাপটা, সিমাইপিঠে বাবুইঝাক, ইত্যাদি। এর বাইরে হাজারও সৌখিন পিঠে রয়েছে যা দেখতে ও খেতেও যেমন সুন্দর, তেমন বানানোও বেশ কষ্টকর। পিঠে তৈরি করাও একটা শিল্প। এবিষয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। ওখানকার পিঠের পদ্ধতি ও নাম মনে রাখা সহজ কাজ নয়। 

চেষ্টা করছি সেইরকম কিছু পিঠের নাম উল্লেখ করার। যেমন- মুগডালের পিঠে, চিঁড়ের দুধপুলি, পুরিপিঠে, চন্দনপিঠে খিরসালুচি, ডিমপিঠে, জাঁকপিঠ, তেলপিঠে, ভাপাপিঠে, ডিমের পাকান, চুসিপিঠে, গোকুলপিঠে ইত্যাদি। এ ছাড়াও চাল গুড়ির রুটিও খুব সুস্বাদু। গ্রামাঞ্চলে আজও আত্মীয়-স্ব্জন এলে মাংসের ঝোল সহযোগে এই রুটি খাইয়ে জামাই ও আত্মীয়-স্বজনকে আপ্যায়ন করা হয়। এরমধ্যে পুলিপিঠে ও পাটিসাপটা নানান জিনিস দিয়ে নানাভাবে তৈরি করা হয়।    
 
  এছাড়াও তালের সময় তালের মাড়ি দিয়ে নানা রকম পিঠে তৈরি হয়। তালের বড়া, তালের কেকপিঠে বা পাতাপিঠে। আমের সময় পাকা আমের বড়া ভাজা  হয়। এই সমস্ত পিঠে বানাতে আরও অনেক রকম উপকরণ প্রয়োজন হয়। মেশিনে গুড়োকরা চালগুড়ি দিয়ে রুটি, পুলিপিঠে, বাবুইঝাঁক, সেমুইপিঠে ইত্যাদি হয়ে থাকে। কিন্তু চিতুইপিঠে, সরুচাকলি, পাকান ইত্যাদি পিঠে তৈরি করতে ঢেঁকিতে কোটা চালগুড়ির প্রয়োজন হয়। এখন অবশ্য অনেকে চালগুড়ি  ছাড়াই নানারকম পিঠে বানাচ্ছেন। সেগুলিকে আদৌ পিঠে বলা যায় কিনা, এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। পিঠে সাধারণত গ্রাম্য এলাকার মানুষের বা গরিব মানুষের খাদ্য হিসেবে ভাবা হয়।তাই তার উপকরণও খুবই সহজলভ্য হয়ে থাকে।

  পুর বা পুলিপিঠে বানাতে লাগে চালগুড়ি, নারকেল ও গুড়।নারকেল কুরে কড়াইয়ে সামান্য ভেজে তাতে গুড় মিশিয়ে প্রথমে পুর তৈরি করতে হবে।তারপর গরম জলে চাল  গুড়ির মণ্ড তৈরি করে মসৃণ করে চটকে লুচির আকারে লেচি কেটে ছোট্ট বাটির আকারে গোড়ে তার মধ্যে পুর ভরে শিমের মত ভাঁজ করে দুই আঙ্গুলে চেপে চেপে মুখ আটকে দিতে হয়। নক্সা করেও মুখ আটকানো যায়। এরপর উনুনে জল বসিয়ে তার মুখে ঝাঁজরি থালা রেখে বা পাতলা কাপড় বেঁধে তার ওপর পিঠেগুলি সাজিয়ে ওপর কিছু চাপা দিয়ে পিঠে সেদ্ধ করতে হবে। পিঠের গা মসৃণ হলে বুঝতে হবে পিঠে সেদ্ধ হয়ে গেছে। একে সেদ্ধ পিঠেও বলা হয়।এই পিঠে খেজুর গুড়ে ডুবিয়ে খেতে ভাল লাগে। এই পিঠেকে ঘন দুধে চিনি বা খেজুরের গুড় সহযোগে ফুটিয়ে নিলেই হয়ে যাবে অতি সুস্বাদু দুধপুলি। সরুচাকলি বানাতে হলে হাল্কা গরমজলে সামান্য নুন দিয়ে তার সঙ্গে চালগুড়ি মিশিয়ে পাতলা কাই তৈরি করতে হবে। ননসটীক তাওয়াতে ব্রাশ বা বেগুনের বোঁটা দিয়ে গরম তাওয়াতে তেল বুলিয়ে নিতে হবে।তারপর হাত দিয়ে ওই গোলা তাওয়া জুড়ে ছিটিয়ে দিয়ে সামান্য পরেই তুলে নিলেই সরুচাকলে তইরি। দুধে ভিজিয়ে সরুচাকলি খেতে ভাল লাগে। হাত দিয়ে যারা পারেন না, তারা ধোসার মত করেও করতে পারেন। চিতুই পিঠের জন্য জল ফুটে ওঠার পর কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা করে অল্প করে করে চালগুড়ি মেশাতে হবে। ঐসময় অনবরত নাড়তে হবে, যাতে দলা বেঁধে না যায়। এরপর গরম মাটির কড়াইয়ে মাপ মত গোলা ঢেলে চাপা  দিতে হবে। পিঠে সেদ্ধ হলে দেখে বোঝা যায়। তখন খুন্তি দিয়ে তুলে নিতে হবে।পিঠে যদি নরম হয়,তবে খেজুরের গুড় মেশানো ঘন দুধে ভিজিয়ে খেতে ভাল লাগবে।আর যদি মুচমুচে হয় তাহলে গুড়ে ডুবিয়ে খেতে ভাল লাগবে।গুড়পিঠে ও অনেকটা এভাবেই করতে হয়।চালগুড়ির কাইয়ের সঙ্গে গুড় মেশাতে হয়,আর শুকনো সরার বদলে কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে হাতার সাহায্যে গোলা ঢেলে ভাজতে হয়।

    ওপার বাংলায়, মানে বাংলাদেশে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে পিঠে হয়, এমন কি মাছ -মাংসের ও পিঠে বানায় ওরা। পিঠের নানারকম নামও শোনা যায়। পুলিপিঠে, চিতুই পিঠে হয় নানা উপকরণ দিয়ে, সেটা নামেই বোঝা যায়। যেমন-ছানারপুলি, দুধপুলি,তিলেরপুলি, ভাপাপিঠে, শাহি ভাপাপিঠে, (এই পিঠে বানাতে বাদশাভোগ চালেরগুড়ি লাগে এবং নারকেলের পুরের সঙ্গে দুধের ক্ষীর ও মালাই মেশাতে হয়), খেজুররসে সেদ্ধ ভাপাপিঠে, রসচিতুই, ডিমের চিতুই, দুধ চিতুই, খোলা চিতুই ইত্যাদি। পাটিসাপটা ওরা মিষ্টি আর নোনতা দুরকমের  বানায়। নারকেলের পাটিসাপটা, ক্ষীরের পাটিসাপটা, চিংড়িমাছের পাটিসাপটা, গাজররের ও কপির পাটিসাপটা, মাংসের পাটিসাপটা। আরও যে সমস্ত পিঠে বাংলাদেশের মহিলারা বানিয়ে থাকেন তাদের নাম এই অল্প পরিসরে উল্লেখ করা যদিও সম্ভব নয়, তবে কিছু নাম  না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

    ওপার বাংলার মানুষ যেমন অনেক নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন(ইংলিশ থেকে বাংলা), যেমন নিজেদের নামের সঙ্গে ছোট্ট একটি শ্রুতিমধুর নাম ব্যবহার করেন। সে রকম এঁদের কিছু পিঠের নামও খুব সুন্দর। সেগুলিই লেখার চেষ্টা করছি। নকশি পিঠে, আনারস পিঠে, মেরা পিঠে, ইলিশ পিঠে, বিবিখান পিঠে (এই পিঠে বানাতে ঘি, দুধ, নারকেল, ডিম, হাল্কা ভাজা চালের গুড়ি, এলাচ গুড়ো একসঙ্গে ভালকরে মেখে কেকের মত বেক করতে হয়), কলারপিঠে, কলসি পিঠে (মুরগির মাংস ভাল করে কষিয়ে চালগুড়ির সঙ্গে নরম করে মেখে একটি মাটির কলসির ভেতরে ভাল করে তেল মাখিয়ে ওই মণ্ড কলসিতে ভরে মুখে কলাপাতা রেখে শক্ত আটার মণ্ড দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। উনুনে নয়, কোনোকিছুর সঙ্গে কলসিটি দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে নিচে কাঠের আগুন জ্বালতে হবে।সময়সাপেক্ষ ব্যপার। অল্প তাপে কলসিটি পুড়ে কালো হয়ে গেলে বুঝতে হবে পিঠে তৈরি। কলসি ভেঙ্গে পিঠে বের করতে হবে),চাপাতি পিঠে, ফুলঝুরি পিঠে, ঝিনুক পিঠে, খাজুর পিঠা, মুখশলা পিঠে, উট পিথে, রাজদউলা পিঠে, চুঙ্গা পিঠে (বাঁশের মধ্যে নারকেল, দুধ, চালেরগুড়ি চিনি ভরে আগুনে পোড়াতে হয়) ইত্যাদি।

  এখন এই ব্যস্ততার যুগে  শহরাঞ্চলে বেশিরভাগ পরিবারে মহিলারা পিঠে বানাতে জানেন না। কিন্তু খেতে যে ভাল বাসেন সেটা বোঝা যায় যখন তাদের পিঠে মেলায় চড়া দামে পিঠে কিনতে দেখা যায়। দুই বাংলাতেই ইদানীং বিভিন্ন খাবারের দোকানে পিঠে বিক্রি হয়। তবে শহুরে পিঠে তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দেখা যাচ্ছে পিঠে বানানোকে সহজ করতে চাল গুড়ির সঙ্গে ময়দা, সুজি মেশানো হচ্ছে। স্বাদের জন্য মেশানো হচ্ছে কাজু কিশমিশ, এসেন্স ইত্যাদি। এখন চালের গুঁড়ির বদলে সুজির খামির করে অনেকে পুলিপিঠে বানাচ্ছেন।এসব পিঠেতে পিঠের স্বাদ কতটা পাওয়া যায়, সেটা পিঠে প্রেমিকরাই বলতে পারবেন। আমি এখানেই থামলাম। 

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

         
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments