জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২২/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২২

শ্যামল জানা

ভোর্টিসিজম (শেষ অংশ)

“ব্লাস্ট” পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ পায় জুন ১৯১৪ সালে৷ এই মাসটা যে অত্যন্ত খারাপ সময়ের অশনি সংকেত, তা এঁরা এতটুকুও আঁচ করতে পারেননি৷ যে, এর ঠিক একমাস পরেই অগাস্ট-এ বৃটেন যুদ্ধ ঘোষণা করবে জার্মানির বিরুদ্ধে! ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে চরম সংকট নেমে এসেছিল, বিশেষত ইয়োরোপের সাধারণ মানুষের ওপর! এতদসত্ত্বেও আভাঁগার্দ আন্দোলনের যে ক্ষুধা, তা নষ্ট হয়নি! ১০ জুন ১৯১৫ সালে ভোর্টিসিস্টদের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল লন্ডনের নিউ বন্ড স্ট্রিটের “ডোরে” গ্যালারিতে৷ প্রদর্শনীটির উদ্বোধনের ঠিক আগের মুহূর্তে একটি মর্মান্তিক খবর আসে যে— প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী অন্যতম চিত্রশিল্পী গাউডিয়ার-ব্রেজস্কা ফ্রান্সের ট্রেঞ্চ-এ মারা গেছেন! তাই, এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য “ব্লাস্ট” পত্রিকার দ্বিতীয় বিশেষ “যুদ্ধ সংখ্যা”টির প্রকাশ সেই সময়ে না করে পিছিয়ে দেওয়া হয়৷ একমাস পরে ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে সেটি প্রকাশ পায়৷

মোট ১২জন শিল্পী এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ এঁদের মধ্যে  নিমন্ত্রিত চিত্রশিল্পী হিসেবে ছিলেন— লরেন্স অ্যাটকিনসন, কাথবার্ট হ্যামিল্টন, উইলিয়াম রবার্ট, এডওয়ার্ড ওয়াডসওয়ার্থ৷ ভাস্কর হিসেবে ছিলেন— স্যর জ্যাকব এপস্টাইন ও হেনরি গাউডিয়ার-ব্রেজস্কা৷ আর, এঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন মহিলা শিল্পী— জেসিকা ডিসমোর ও হেলেন সাউন্ডার্স৷ যা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর! কারণ, আভাঁগার্দ আন্দোলনে মহিলা শিল্পীরা যুক্ত হয়েছেন, এ কথা তখন কল্পনাও করা যেত না(ছবি-১)!

শুধু তাই নয়, এই নতুন ধরনের প্রদর্শনীতে নানা ধরনের অভিনব সব কাজ ছিল! যার মোট সংখ্যা ছিল ৬৩টি৷ যেখানে পেন্টিং ও ড্রইং-এর সংখ্যা ছিল ২৬টি(ছবি-২)৷

তার বাইরে অন্য মাধ্যমের কাজ ছিল ৯টি৷ আর একেবারে অজানা, আগে কেউ দেখেনি, এরকম কাজ ছিল ২৮টি৷ এই প্রদর্শনীটি যে একেবারে অন্যরকম, তা এই প্রদর্শনীর ক্যটালগে লিখিতভাবে ভোর্টিসিস্টরা উল্লেখ করেছিলেন৷ তাঁরা স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন— “একটা গ্যালারি এই যে বিশেষ একটি প্রদর্শনী করল, তা ইংল্যান্ডের ইতিহাসে নেই৷ এটাই প্রথম৷” শুধু তাইই নয়, তাঁরা ওই ক্যাটালগের শেষের দিকে সরাসরি ফিউচারিস্টদের বিরোধিতা করে অদ্ভুত তিনটি ঘোষণা করেছিলেন৷ লিখেছিলেন, “ভোর্টিসিস্টরা মনে করে—

(ক) আমাদের কর্মকাণ্ড(ACTIVITY) হচ্ছে— পিকাসোর নিষ্ক্রিয়তার (PASSIVITY) ঠিক বিপরীত!

(খ) আমাদের তাৎপর্য(SIGNIFICANCE) হচ্ছে— প্রাকৃতিক দৃশ্য, যা কিনা নিস্তেজ এবং কল্পনাপ্রবণ চরিত্রের, তাকে আমরা নিন্দা করি৷ আমরা এর ঠিক বিপরীত!

(গ) আমাদের অপরিহার্য আন্দোলন ও কর্মকাণ্ড(ESSENTIAL MOVEMENT and ACTIVITY [যেমন মনের শক্তি] ) হচ্ছে— সিনেমার চলমান দৃশ্যের অনুকরণ করা বা এই ধরনের আদিখ্যেতা সম্বলিত ফিউচারিস্টদের যে ইতিহাস, আমরা তার ঠিক বিপরীত!

    যাই হোক, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ভোর্টিসিস্টদের অদম্য উৎসাহের জন্য প্রদর্শনী উতরে গেল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের পিছু ছাড়ল না! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে সংকট আরও ঘনীভূত হল! কোনো শিল্পীই আর একটুও কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারলেন না! তাঁদের জোর করে টেনে-হিঁচড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হল! ফলে, যা হবার তাইই হল৷ যুদ্ধ করতে করতে অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারাল৷ ফলে, অতবড় টগবগে আন্দেলনের জাজ্জ্বল্য্যমান প্রদীপশিখাকে অকালেই জোর করে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল সময়, বলা ভালো ফ্যাসিস্টরা!

    যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও কয়েকজন শিল্পী তখনও বেঁচে ছিলেন৷ বেঁচে ছিলেন ওয়াইন্ডহ্যাম লেউইস নিজেই৷ এত কিছুর পরেও তিনি হতদ্যম হননি! তিনি চেষ্টা করলেন ভোর্টিসিজমকে অন্য নামে হলেও বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা! তিনি ১৯২০ সালে ম্যানসার্ড  গ্যালারিতে দশজন শিল্পীকে নিয়ে আবার একটি যৌথ চিত্র প্রদর্শনী করলেন৷ দলের নাম দিলেন “গ্রুপ-এক্স”(Group-X)(ছবি-৩)৷ 

লেউইস বিশ্বাস করতেন যে, গত দশ বছরে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গোটা ইয়োরোপ জুড়ে শিল্পীরা যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, সেগুলি হাল্কাভাবে নেওয়ার বিষয় নয়৷ এই বিশ্বাসকে অতিক্রম করে, শিল্পীদের যাঁর যা অবদান, সেগুলিকে এক জায়গায় এনে সমন্বয়সাধন করার একটা কঠিন প্রয়াস ছিল এই প্রদর্শনীতে৷ ফলে, একটি প্রদর্শনীকক্ষে একই সময়ে বৈচিত্রময় সব কাজের সমাহার ঘটেছিল একসঙ্গে! যেমন লেউইস-এর চারটে আত্ম-প্রতিকৃতি ছিল৷ আবার, কিউবিজম শৈলীর বিবর্তন ঘটিয়ে নতুন ধরনের চারটে ছবি ছিল রবার্টস-এর৷ যেন ভোর্টিসিজম-এরই ছায়া এই নতুন “গ্রুপ এক্স”৷ আর সত্যিসত্যিই  “গ্রুপ এক্স”-এ এমন ছয়জন শিল্পী ছিলেন, যাঁরা ভোর্টিসিজম-এর সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন৷ এঁরা হলেন— ডিসমোর(মহিলা শিল্পী), ইচেলস্, হ্যামিল্টন, লেউইস, রবার্টস, এবং ওয়াডসওয়ার্থ৷

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল— দুঃসাহসের অগ্নিশিখা পুনর্বার জ্বালাতে ব্যর্থ হয়েছে এই প্রদর্শনী! আসলে, যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তখন বৃটেনের সাধারণ মানুষদের মনকে যারপরনাই আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলেছিল৷ ফলে, তাদের ওই আতঙ্কগ্রস্ত মন পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক আভাঁগার্দ শিল্প-আন্দোলনকে গ্রহণ করতে সক্ষম হল না! ফিরে এল সেই পুরোনো, ডিটেইল-এ আঁকা রক্ষণশীল শিল্প৷ পুনঃ-প্রতিষ্ঠিতও হল!

     ওয়াইন্ডহ্যাম লেউইস শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে এমনই এক চরিত্র, যে, কোনো অবস্থাতেই তাঁকে হতদ্যম করা যায়নি! ফ্যাসিস্ট শক্তি গোটা ইয়োরোপ জুড়ে ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি নামিয়ে এনেছিল৷ তাঁদের আভাঁগার্দ শিল্প আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল! তবুও লেউইসকে দমিয়ে রাখা যায়নি! প্রায় ছত্রিশ বছর অবজ্ঞা সওয়ার পরেও তিনি ১৯৫৬ সালে টেট গ্যালারিতে “Wyndham Lewis and Vorticism” নামে অতীতের কাজগুলি নিয়ে একটি প্রদর্শনী(Retrospective exhibition)করলেন৷ কিন্তু সেই সময় তৎকালীন শিল্পীরা লেউইস-এর সঙ্গে থাকেননি৷ তিনি একাই আন্দোলনের শীর্ষ ছুঁয়েছিলেন৷

হতে পারে, আক্ষরিক অর্থে ভোর্টিসিস্ট আন্দোলন খুব অল্প সময়ের জন্য ঘটেছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও বৃটেনের আধুনিকতায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান কেউই অস্বীকার করতে পারে না, করেওনি! শুধু তাইই নয়, আন্দোলন থেমে গেলেও ভোর্টিসিজম-এর কিন্তু মৃত্যু হয়নি৷ এখনও, এই একুশ শতক পেরিয়েও, ভোর্টিসিজম জীবিত এবং প্রাসঙ্গিক৷ এখনও তাদের বেশ কিছু প্রদর্শনী হচ্ছে৷ যেমন— বৃটেনের টেট গ্যালারিতে ২০১১ সালে “The Vorticists: Manifesto for the Modern World” শীর্ষক প্রদর্শনী হয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা, ভোর্টিসিজম আজকের সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছে বা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, যে, তারা বর্তমান আধুনিকতায় নান্দনিকতার প্রশ্নে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করতে পেরেছে৷        (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

3 Comments

  1. ভোর্টিসিজম-এর শুরুর অংশটি
    পরার পর বর্তমান অংশটি ঘাড়
    ধরে পড়িয়ে নিল লেখক। এটিই
    এই লেখার অমোঘ টান আর লেখকের স্বকীয় মুন্সিয়ানা। তাকে
    আমার কুর্ণিশ।

    ReplyDelete
  2. দ্বিতীয় লেখাটাতে ভুল বশত:
    পরার পর হয়েছে। ওটা পড়ার
    পর হবে।

    ReplyDelete