জ্বলদর্চি

তোমাদের ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম/ আশিস চৌধুরী

তোমাদের ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম

আশিস চৌধুরী

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বলতে চাই বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখভাল মোটেই হচ্ছে না। পরিবারে তাঁরা দারুণভাবে অবহেলিত। ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধাশ্রমগুলির সংখ্যা তারই সাক্ষ্য বহন করছে। সংসারে যতক্ষণ তাঁদের প্রয়োজন ছিল ততক্ষণই খাতির আদর-যত্ন ছিল। প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই এত হেলাফেলা। সমাজে এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। যে সব পিতামাতা তাঁদের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন, বৃদ্ধবয়সে সেই ছেলেমেয়েরাই তাদের দেখছে না। আজকের সমাজে বৃদ্ধ পিতামাতাদের বোধ হয় সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি এটাই। আমরা এখন অর্থোপার্জনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছি। ভোগসর্বস্ব আধুনিক জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই প্রকট হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের অবনতি। মূল্যহীন হয়ে পড়ছে চিরায়ত সম্পর্কের বন্ধন। বিগত কয়েক বছরের সংবাদপত্রের পাতা উল্টে যদি দেখি তাহলে দেখবো, বৃদ্ধ পিতা-মাতারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সুবিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। কেন? কারণ সন্তানরা তাদের নিজস্ব বাড়ি থেকে নানারকম অত্যাচারের করে বাড়ি থেক উৎখাত করতে চাইছে, কোথাও কোথাও আবার তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
   এতো গেল যে সব পিতা-মাতা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তাদের কথা। যারা মানবিক লজ্জায় দ্বারস্থ হতে পারেননি তাদের সংখ্যা কম নয়। তারা নির্যাতন ভোগ করেই চলেছে। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই। আমরা মুখে বলছি বরিষ্ঠ নাগরিক কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তাঁদের প্রাপ্যসম্মানটুকুও দিই না, তাদের হেনস্থা দেখে নির্বিকার থাকি। আমরা এখন এমন একটা সমাজে বাস করছি যাকে মানবসমাজ বলতে কুন্ঠা বোধ হয়। বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের উপর সন্তানদের অত্যাচার দেখেও আশেপাশের মানুষরা কোনও প্রতিবাদ করে না। কেন? না তারা জানেন যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছ থেকে তারা কোনও উপকার পাবে না কিন্তু সেই বাড়িরই তরুণতরুণীর কাছ থেকে প্রয়োজনে উপকার পাবে তাই প্রতিবাদ করে অত্যাচারীদের চটাতে চায় না।
  নানান স্বার্থের দ্বন্দ্বে যৌথ পরিবারগুলি ভেঙে যাচ্ছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার পুত্রেরা নববিবাহিত স্ত্রীর হাত ধরে আপন সুখের সন্ধানে নিজের বাড়ি ছেড়ে ১-২ কিলোমিটারের মধ্যে হয় বাড়ি ভাড়া নিয়ে না হয় নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে যাচ্ছে। এটিই এখন মূল প্রবণতা। নিজেদের বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে তাদের বোঝা মনে হচ্ছে। পুত্রবধূরাও এইসব দায়-দায়িত্ব নিতে চাইছে না।  নব্য শিক্ষিতা গৃহবধূদের মধ্যেই শ্বশুর-শাশুড়িকে ত্যাগ করে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।

  একটা কথা এখানে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-ছেলেদের যেমন কর্মক্ষেত্রে অনেক কিছুর সঙ্গেই আপোষ করেই চাকরি বজায় রাখতে হয় তেমনি নব্য শিক্ষিতা গৃহবধূদেরও কিছুটা সহনশীল হতে হবে, এতে সমাজেরই মঙ্গল। আমি কখনোই এ কথা বলতে চাইছি না যে গৃহবধূরা শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত হন না,  তবু অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি-এই সংখ্যাটা তূলনামূলক বিচারে কম। যৌথ পরিবারগুলি ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা গল্পগুজব করার মানুষ পাচ্ছেন না, নাতি- নাতি-নাতনিদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং একাকীত্বে ভুগছেন। যেখানে পরিবারগুলি ভাঙেনি সেখানে সকলেই যেন খুব কর্মব্যস্ত তাই তারা কেউ তাদের সময় দিতে চায় না। 

বাস্তবে এও দেখতে দেখতে পাচ্ছি, যে মহিলারা তাদের মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে কী ভাবে চলতে হবে তার পরামর্শ দিচ্ছেন, সেই  মহিলারাই তাদের মেয়েকে দেওয়া পরামর্শের অনুসরণে পুত্রবধুরা চললে তিনি সহ্য করতে পারছেন না, পরিবারে গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে। তাছাড়াও পরিবারে মেয়েদের জন্য একরকম নিয়ম আর পুত্রবধূদের জন্য অন্যরকম,এইসব দ্বিচারিতা কেন? খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে এ কথা স্বীকার করছি- মহিলারাই তুলনাহীন পরিশ্রমে সংসারকে গড়ে তোলেন। কিন্তু সেই তাদেরই আবার সংসার ভাঙার মূলে প্রধান ভূমিকা থাকে।
  একজন সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য পিতা-মাতাকে আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে যে বিপুল পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সে কথা কি সন্তানেরা আদৌ হৃদয়ঙ্গম করে? হয়ত করে না। যদি তা করত তাহলে সমাজের ছবিটাই বদলে যেত। নিজেরাও যখন বৃদ্ধ হবেন তখন আপনাদের সন্তানেরা আপনাদের সঙ্গে কী আচরণ করবে তা সহজে অনুমেয়। তোমার অন্যায়ে জেনো সে অন্যায় আরও প্রবল হবে। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা এখন সামাজিক ব্যধিতে  পরিণত হয়েছে। তাদের শেষের দিনগুলি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। দুঃসহ নিঃসঙ্গতায় ভুগতে ভুগতে তারা প্রাণ ত্যাগ করছেন।

    গত ৪ঠা নভেম্বর ‘মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফ পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন বিল ২০১৯’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অনুমদন পেয়েছে এবং ১১ই ডিসেম্বর লোকসভায় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের বিলটি পাশ হওয়ার পর এখন এর আইনি মান্যতা পেতে কত সময় লাগে সেটাই দেখার।প্রস্তাবিত নতুন বিলে মুলত নয়টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে-১) প্রবীণদের ভরণপোষণ বাবদ দেয় অর্থের পরিমাণ সীমিত নয়, তা ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন । ২)ভরণপোষণের দায়িত্বে পুত্রবধু এবং কন্যা ও জামাতার অন্তর্ভুক্তি। ৩)প্রবীণ নিপীড়নে কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা। ৪)ভরণপোষণ দাবির আবেদনপত্র জমা পদ্ধতির সরলীকরণ । ৫)অশীতিপর প্রবীণদের ৬০ দিনের মধ্যে আবেদনের নিষ্পত্তি। ৬)সন্তান-সন্ততিদের আপীল দাখিলের অধিকার। ৭)নিরাপত্তার জন্যে প্রতি থানায় এএসআই পদমর্যাদার একজন নোডাল অফিসার এবং জেলাস্তরে শুধুমাত্র প্রবীণদের জন্যে ডিএসপি পদ মর্যাদার অফিসারের অধীনে জেলার সকল থানার নোডাল অফিসার এবং একজন পুরুষ ও অন্যজন মহিলা সমাজকর্মী নিয়ে তৈরি বিশেষ পুলিশ ইউনিট। ৮) এ ছাড়া সর্বভারতীয় স্তরে স্বাস্থ্য, পুলিশ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত একটি হেল্প লাইন চালু। ৯)প্রবীণের হোম কেয়ার সার্ভিস এবং ডে-কেয়ার সার্ভিস সংস্থার নিবন্ধীকরণ ও ন্যুনতম মান নির্ধারণ। এই বিল সংশোধন ও পরিমার্জনের পর আইনে বলবৎ হলে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থার পরিবর্তন কি খুব একটা হবে?

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments