জ্বলদর্চি

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা (গুচ্ছ কবিতা) /ঔরশীষ

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা 
স্বরবর্ণ

ঔরশীষ


অনেক দেরী হয়ে গেছে৷ যেসব বন্ধুরা গিয়েছিল সান্ধ্য মজলিশে, ঘরে ফিরেছে তারাও। অন্ধকার গিলে খাচ্ছে এক বিশালাকৃতির কমলা চাঁদ। এসময়ে নাগপাশ লাগে। জীবন ও যৌবনের জুয়া খেলা ছেড়ে উঠে আসে এক মামুলি যুবক। ঘুম তাকে নিশিডাকে টেনে আনে ছাদের কিনারে


আগুন ও আলো যেমন শুধু উষ্ণতার তিব্রতায় প্রকাশিত হয়, তেমন তোমার ছোঁয়া পেয়ে এতদিন বেড়ে উঠেছি। এখন শীতকাল এলে আর সারারাত উৎসব করতে মন চায় না। অনেক নিচে পৌঁছে গেলে একজনের শুধু ঘুম পায়। যতটা দূরত্বে চলে গেলে একটি চুম্বক আরেকটি চুম্বকের টান ভুলে যেতে পারে, তারও বেশি দূরে দাঁড়িয়ে ঠাওর করেছি যে এই পৃথিবী আসলে একটি বিশাল চুম্বক, এবং আমরা দুজনেই স্পর্শ করে আছি তাকে। অতএব দূরত্ব এখন একটি পরিমাপ মাত্র, যা দিয়ে কখনো বা বয়স মেপে রাখি


ইন্দ্রিয়ের অমোঘ নির্দেশে যন্ত্র যৌনতার শিকার হবো না ভেবে যারা যৌন যন্ত্র হয়ে গেল, তাদের শরীরে জমা লবনের হ্রদে ভেসে আছে চতুর্দশী চাঁদের শরীর। কিসের বিভ্রান্তি বলতে পারো, যা মানুষের মগজে ভরে দেয় নদীর বাতাস-- মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়। এমন উন্মাদনা পারে আমাদের অহর্নিশ শিহরিত করতে। এখন শিশির স্পর্শে কেঁপে উঠি শুকনো পাতার মত, আর যা কিছু অন্ধকারে জ্বলে ওঠে, তাদের এখন চাঁদ বলে ভুল হয়


ঈশপের গল্পের চরিত্রে পরিনত হচ্ছি প্রতিদিন। যে ছাগল কুয়োর তলায় বহুদিন মরে পচে একদিন চাঁদ হয়ে গেল, অথবা যে শৃগাল তাকে ছেড়ে এলো সেই অন্ধকুপে, আমাদের সম্পর্কে তার বেশি মালমশলা কখনো ছিল না৷

যেভাবে একটি যুদ্ধের সিনেমা প্রস্তুত হয় বা একটি ঘুড়ির ছবি পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে দেয় মানুষের মন তেমনি কিছু দৃশ্যের ভিতর এক সোনালি ফাঁসে বাঁধা পড়ছি ক্রমাগত। একটা চাঁদিয়াল শূন্য আকাশের গায় ক্রমাগত লাট খাচ্ছে। এমন দৃশ্যের কাছে রেখে আসি জন্মদিন


উন্নাসিক আর অহংকারি বটে। এই হাওয়া। সেই মেয়ে। এমন অকাল বৃষ্টি।  দুচোখ ছেঁচা মেঘ নিয়ে সে বরফে পা ঢুবিয়ে গুনগুন করে যায় প্রিয় কোনও গানের একটি। এভাবে বাঁচার মধ্যে মৃত্যুই আদর্শ আর আদালত। জীবন তখন স্লো মোশনে বারংবার ঘটে চলা কোনও বিপর্যয়ের অ্যাকশন রিপ্লে দেখায়। চরিত্রদের চেনা লাগে বা চেনার মধ্যে অচেনা ঠাওর হয়-- সকল তর্কের শেষে তুমি বলে ওঠো দ্যে জাঁ ভ্যু, আমার সরল মন বিশ্বাস হারায় না জাতিস্বরে


ঊষর শরীরে তার শস্যের দেবতা বাস করে । আমার সমস্ত দাহ্য তার অর্ঘ্যে দিয়ে একদিন নিভে যাবো জলের শরীরে ভাসানো দীয়ার মত। আমার শ্মশান পছন্দ নয়, কিন্তু প্রতিটি মানুষের মনের ভিতর যেমন বাগান আছে, তেমন শ্মশান থাকতে বাধ্য। সেখানে সারারাত নানান ভষ্মের ছাই ওড়ে। আর এইসব রাতে, যখন রাক্ষুসে চাঁদ ঝুঁকে নেমে আসে, শ্বদন্ত ফোটায়... বিমর্ষ আলোরা নেচে ওঠে, হাওয়ায় তখন অচেনা উদ্বেগ নজর কাড়ে। বন্ধ করতে না পেরে একসময়ে যে খোলা জানলার সামনে ঘুমিয়ে পড়েছি, সেও কী জানতো, এভাবে স্বপ্নের তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে, একদিন পুরেনো অভ্যেসে ফিরে আসবো?


ঋ বললেই প্রেম ও সন্যাস এসে দুই পাশে স্থির হয়ে যায়৷ যেন দুটি ঘড়ি কাঁটা, ক্রমাগত স্নেহা ও সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে মনে৷ শুধুমাত্র তুচ্ছকে তাচ্ছিল্য করতে পারি নি বলে কবিতা নামক এক প্রেত ঘাড়ে বয়ে নিয়ে শ্মশানের থেকে সিংহাসনের অভিমুখে রওনা দিয়েছি, এবং পথে সে নানান গল্পের ফাঁদে আমাকে আটকে ক্রমাগত মজা লুটছে। কখনো আসছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে....তখন কুড়িয়ে আনতে হচ্ছে তাকে ফুলের জঠর থেকে। নিয়ত এমন যাতায়াতে যখন সর্বস্ব ভুলে যাবো, সেদিন আবার যদি দেখা হয়--- যদি না হয় দেখা


এভাবে ফিরিয়ে দিতে নেই৷ বলো ধীরে, দৃঢ় স্বরে, 'এখন সময় নেই'। যেটুকু সময় লাগে একটি দীর্ঘশ্বাস থেকে আরেকটি দীর্ঘশ্বাসে ফিরে যেতে, বা যেটুকু অবসর পেলে দেহ জুড়ে অরণ্য জন্মাবে, তার কম মুহূর্তের ব্যবধানে বলে যেতে পারি কুহক দিনের গল্প। এভাবে ফিরিয়ে দিতে নেই। যা তুমি ফিরিয়ে দাও, তাই প্রতিধ্বনি হয়ে যায়। প্রতিধ্বনির মৃত্যু নেই, অবসর নেই... সময় ও দূরত্বের অঙ্কে সে শুধু সূচক হয়ে থেকে যায়


ঐশ্বরিক কিছু বিশ্বাস হয় না৷ যদিও অলীক এক আলো যখন তোমাকে ঘিরে ধরে, তুমি সমস্ত অতীত ও বর্তমান ভুলে কোনও অমোঘ ইশারায় মেতে ওঠো। বস্তুত যে ঘাস জন্মায় মুক্তির চাঞ্চল্যে, তাকে বুটের তলায় কুচলে দিয়ে আমাদের বেপরোয়া জীবনযাপন আরো আত্মঘাতী হয়ে ওঠে৷ এভাবেই একদিন দখল নিয়েছি ধর্মে ও শরীরে-- কিন্তু জ্ঞানের নিষ্প্রভ পাপড়িরা যখন হঠাত রক্তের স্পন্দনে সাড়া দেয়, সেসময়ে যুক্তাক্ষর ভেঙে স্বরবর্ণে ফিরে আসার অক্লান্ত প্রয়াসে কখন যে খু্লে গেল অস্তিত্ববাদের দরজা


ওদের দেখেছি। একটি সিগারেটের মৃত্যু নিয়ে শোক পালকের দলে বা তুমুল বর্ষার দিনে যারা ছাতার তলায় ছিল। ওদের দেখেছি আর প্রমাদ গুনেছি৷ সাড়া দেব না ভেবেও চাপা গোঙানির মত এক প্রলোভন আমাকে আঁকড়ে ধরেছে৷ ছটফট করেছি আর মৃত্যুর অঘোরে ডুবে দেখেছি জীবন কত সৌন্দর্যের গোপন মিউজিয়াম। ওদের দেখেছি, আর ভেবেছি অনেক--  তারপর একদিন ভুলে গেছি


ঔচিত্যবোধের দরজায় একটি আয়না রেখেছি৷ যখন খোলসে ঢুকি দেখে নি নিজের মুখ, এবং যখন বের হই চেষ্টা করি মিলিয়ে নেওয়ার৷ দুটো ছবি কখনো মেলে না। জলের সঙ্গে জলের বিভেদ যেমন অমূলক নয়।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments