জ্বলদর্চি

একুশে স্মরণ, উনিশে এবং বিশে এত নীরব কেন?/ দুর্গাপদ মাসান্ত

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা 
একুশে স্মরণ, উনিশে এবং বিশে এত নীরব কেন?
দুর্গাপদ মাসান্ত


২১ ফ্রেব্রুয়ারি ঠিক যতটা উদ্দীপনার সঙ্গে ভাষাদিবস পালন করা হয়, ১৯ মে ঠিক ততটাই অন্ধকারে। বাংলা ভাষার জন্য অসমের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের আত্মত্যাগ কোনমতেই ভোলার নয়। অসমের দক্ষিণ সীমান্ত কাছার, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি-এই তিন জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা। এখানে বাংলাভাষীদের সংখ্যাধিক্য।  ১৯৬০ সালের শেষ দিকে অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ চালিহারের তৎপরতায় বিধানসভায় একটি বিল পাশ হয়। ওই বিলে বাংলাভাষা, সরকারি ভাষার মর্যাদা হারায়। এর বিরোধিতা করে করিমগঞ্জের বিধায়ক রণেন্দ্র মোহন দাস বলেন, তাহলে  রাজ‍্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে অস্বীকার করা হবে? এতে বরাক উপত্যকার বাঙালিরাও নিজেদের ভাষার অপমান মুখ বুজে মেনে নেননি। শুরু হয় বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন।

       ১৯৬১ সালের ১৯ মে  এই  দাবিতে শিলচর স্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান কমলা ভট্টাচার্য সহ ১১ জন ভাষাসৈনিক। শহিদরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত‍্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, শচীন্দ্রচন্দ্র পাল,  ধীরেন্দ্র সূত্রধর ও সুকমল পুরকায়স্থ।  তাঁদের  প্রাণের বিনিময়ে বরাক উপত্যকাবাসী অসমীয়ার পাশাপাশি বাংলাকেও সরকারি ভাষা হিসেবে পান। অথচ ২১ ফ্রেব্রুয়ারি নিয়ে যত মাতামাতি হয়, ১৯ মে নিয়ে আমারা ততটাই নিশ্চুপ। দুই জায়গাতেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ ঝরেছে। একুশের  আন্দোলনে নিহত ভাষাপ্রেমীরা যদি ভাষা  শহিদের মর্যদা পান তবে উনিশে নিহত ভাষাপ্রেমীরাও ভাষা শহিদের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। যে সংগ্রামের সঙ্গে আবার  বিশ্বের ১ম মহিলা ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের নাম জড়িত। সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাংলাভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন শিলচরের কমলা। যখন চতুর্দিকে 'মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ' ধ্বনিতে মুখরিত, ঠিক তখনই ২টো ৩৫ মিনিটে সবাইকে অবাক করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল থেকে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর নির্বিচারে গুলি চলে ৭ মিনিট ধরে। এরই মধ্যে একটি গুলি কমলার মাথার খুলি এফোঁড ওফোঁড করে বেরিয়ে যায়।  লুটিয়ে পড়ে কমলার রক্তাক্ত দেহ, ছোট বোনের পাশে। প্রাণের বিনিময়ে বাংলাভাষাকে রক্ষা করার অঙ্গীকারে শহিদ হলেন এই সাহসী কিশোরী, হলেন মৃত্যুঞ্জয়ী। বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহিদ। যার ফলস্বরূপ বাংলা বিরোধী বিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সরকার। 

      কমলা পিকেটিং-এ যাওয়ার সময় মাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন-  'ভয় নেই, কিচ্ছু হবে না'। কাঁদানে  গ‍্যাস ছাড়লে ছেঁড়া ন‍্যাকড়া ভিজিয়ে নাকে দেবেন বলে মায়ের কাছ থেকে শুধু একটা ন‍্যাকড়া চেয়ে নেন। ক্ষুধার্ত কমলা  যাবার আগে খাবার চাইলে, মা তাঁর হাতে কিছুই তুলে দিতে পারেননি। খালি পেটে ছোট বোন  মঙ্গলাকে নিয়ে কুড়ি-বাইশ জন মেয়ের সঙ্গে রেলস্টেশনে বেরিয়ে যান কমলা। দুপুরে মা কমলার খোঁজে রেলস্টেশনে গেলে মায়ের ধুলোমাখা পা জল দিয়ে ধুয়ে দেন এবং শরবত খেতে চান। মা এবারেও নিরাশ  করেন কমলাকে। কমলা মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে ভাই বকুল আর বড়দির ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে ফিরে যেতে বলেন। মা ফিরে আসার একটু পরেই শুরু হয় পুলিশের  লাঠিচার্জ। লাঠির ঘা আর বন্দুকের কুঁদোর আঘাত থেকে বোনকে বাঁচাতে গিয়েই গুলিবিদ্ধ হন কমলা। মঙ্গলা দীর্ঘ একমাস সংজ্ঞাহীন ছিলেন। আর  সেজদি প্রতিভাও এই আঘাতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। স্বাধীন  গণতান্ত্রিক দেশে মাতৃভাষার অধিকার হরণের এই ঘটনা  আজও মাতৃভাষাপ্রেমী বিশ্ববাসীর প্রেরণার উৎস।

       কমলা একজন বাঙালি এবং ভারতীয় অথচ পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আমারা তাঁকে যথাযথ সম্মান আজও দিতে পারিনি। ১৯ মে সম্পর্কে এখানকার বাঙালিদের নীরবতা গভীর বেদনাদায়ক। অনেকের স্মরণ থাকতে পারে ২০১১ সালে ১৯ মে-র পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু ১৯ মে-র সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেও এ রাজ‍্যে; কি সরকারি,  কি বেসরকারি কোন তরফ থেকেই দিনটিকে যথাযোগ্য ভাবে  স্মরণ করা বা মর্যাদা দেওয়া হয়নি। দু' একটি ব‍্যাতিক্রম থাকতেই পারে। মোটকথা ১৯ মে-র সুবর্ণজয়ন্তীতেও নিদ্রা ভাঙেনি এ রাজ‍্যের বহু মানুষের।

      অসমের মতো এপার বাংলাতেও  ১৯১২ সালে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল মানভূম জেলায়, যা তৎকালীন বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে আন্দোলনের জেরে বিহার ভেঙে তৈরি হয় একটি জেলা-পুরুলিয়া। টুসু গানে এর প্রচার  করা হত বলে এই আন্দোলনের আর এক নাম ছিল 'টুসু সতাগ্রহ'। ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সেই সময়  মানভূম জেলার সদর মহকুমা পুরুলিয়ায় শতকরা  ৮৭ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী  মানুষের বাস ছিল। স্বধীনতার পর তৎকালীন বিহার নিয়ন্ত্রিত  মানভূম-পুরুলিয়ায় বাংলা ভাষাভাষীদের আকস্মিক ভাবে তীব্র সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কারণ ১৯৪৮ সালে এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মানভূম জেলার কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা  হরফে সাইনবোর্ড  দেওয়া  যাবে না। এমনকী বাংলা ভাষাভাষীদের স্কুলে বাংলা ভাষায়  প্রার্থনাসঙ্গীতও চলবে না। তার পরিবর্তে 'রামধুন'  আবশ‍্যিক। সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত বিদ‍্যালয়ে পঠনপাঠনে বাংলা  ভাষাও চলবে না। শুরু হল মুক্তির লড়াই।  মানভূমবাসীর দাবি ছিল, বাংলা যেহেতু তাদের মাতৃভাষা, সে কারণে মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় ৯ বছর ধরে আন্দোলন চলে। একেবারে শেষ ধাপে ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষ, নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে পুরুলিয়ার  পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে  প্রায় ১০ জন মহিলা সহ ১০০৫ জন পদযাত্রী  মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে কলকাতা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসে আইন অমান্য করেন এবং ৭ মে কারাবরণ করেন।  এদের মধ্যে ৯৫৬ জন গ্রেফতার হন এবং  ৩৪ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩ দিন পরে, ২০ মে তাঁরা মুক্তি পান। টানা ২১ দিন বৈশাখের তীব্র দাবদাহ মাথায়  নিয়ে প্রায় ৩০০ কিমি পথ হেঁটেছিলেন সত‍্যাগ্রহীরা। সত‍্যাগ্রহই ছিল তাঁদের মূল আদর্শ। বাংলাভাষীদের আন্দোলনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া জেলা।

    মানভূমের এ ভাষা আন্দোলন কোনও স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না; ছিল কেবল বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার লড়াই। আজকের প্রশাসনিক পুরুলিয়া সেই লড়াইয়েরই ফসল। এবং পুরুলিয়া জেলা যে এরকম একটি গৌরবজনক ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে তা প্রায় অনেকেরই অজানা। তাই  ২০ মে পালিত হোক আরও একটি ভাষা দিবস।  মিলে যাক ১৯, ২০, ২১।

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments