জ্বলদর্চি

বিপ্লবী তারাপদ কর্মকারের মাথার দাম ধার্য হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা/মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

বিপ্লবী কথা 
বিপ্লবী তারাপদ কর্মকারের মাথার দাম ধার্য হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 সম্পূর্ণ ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য মেদিনীপুর ও হুগলি জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বদনগঞ্জের যে মানুষটির মাথার দাম ধার্য হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা তত্কাপলীন ব্রিটিশ সরকার তিনি আর কেউ নন – তিনি প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী তারাপদ কর্মকার। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলোনে যখন সারা দেশ উত্তাল, চোখের ঘুম টুটে গেছে ইংরেজ সরকারের তখন এই বদনগঞ্জ, কয়াপাট, ফুলুই শ্যামবাজার সহ গোঘাট থানা এলাকায় তারাপদ কর্মকার দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। সমস্ত রকম দু:খ, কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে, ত্যাগ স্বীকার করে সুখ ও নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। 

   বিপ্লবী তারাপদ কর্মকারের জন্ম বিশের দশকে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী এবং জেদি। সেই সঙ্গে পড়াশোনায় ছিলেন দারুণ মেধাবী। ছেলেবেলায় বদনগঞ্জ হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এই স্কুলে পড়াকালীনই তারাপদ কর্মকারের মন ঘুরে যায়। পড়াশোনার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের কাজে – দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। বিপ্লবী দলে নাম লেখান। সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন স্বদেশী আন্দোলোনে। সহপাঠী জীতেন্দ্রনাথ হাজরার কথায় বদনগঞ্জ হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তারাপদ কর্মকারের মন-প্রাণ সবই স্বাধীনতা আনয়নের পথে পা বাড়ায়। সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন বিপ্লবী কাজকর্মে। প্রচণ্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও স্কুলের পড়ায় মন বসে না, স্কুল আসা-যাওয়া তাঁর অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কোথায় পিকেটিং করতে হবে, বিদেশী দ্রব্য ও কাঁচের চুড়ি বর্জন করার সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কোথায় গাঁজা-অফিমের দোকান ভাঙচুর করতে হবে, দোকান-পাট পোড়াতে হবে, থানা অবরোধ করতে হবে – সেই সব জায়গায় দেখা গেল তারাপদ কর্মকারকে। সবার আগে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। পড়াশোনা কেন করছে না, ইংরেজ সরকারের পিছনে লেগে কি হবে – ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে তারাপদ কর্মকার  বলতেন, ‘পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। দেশের জন্য আমি আত্মোৎসর্গ করেছি। ব্রিটিশ শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাই।’ 

   তারাপদ কর্মকারের মুখের বক্তব্য এরপর ধীরে ধীরে কাজে-কর্মে রূপান্তরিত হয়। বাস্তবে তার রূপ দেওয়ার কাজ চলে। হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ ব্রিটিশ বিরোধী। গোলোক ঘটক, কালীপদ দে, তারাপদ চক্রবর্তী প্রমুখ যুবক ও তরুণদের নিয়ে স্বদেশী দল গঠন করেন। তাদের নিয়ে তিনি একের পর এক পিকেটিং করা শুরু করেন। বদনগঞ্জ থানা দখল করেন। গাঁজা ও মদের দোকান ভাঙচুর করেন ও পুড়িয়ে দেন। হেথায়-হোথায় সভা-সমিতি করে ব্রিটিশ-বিরোধী বক্তব্য ছড়াতে থাকেন। দেশের তরুণ-যুবকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ সরকার যার ফলে তারাপদ কর্মকারের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। তাদের স্বাভাবিক কাজ-কর্মের ধারা তাঁর কাছে বাধা পায়। এরফলে ইংরেজদের কু-নজরে পড়ে যান তিনি। ব্রিটিশ শাসকের শ্যেনদৃষ্টি তাঁকে ছুটিয়ে বেড়িয়ে নিয়ে যায়। তারাপদ কর্মকারও আত্মগোপন করেন। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে থেকে তাঁর বৈপ্লবিক কাজকর্ম করতে থাকেন। সহকর্মী জীতেন্দ্রনাথ হাজরার কথা থেকে জানা যায় – ইংরেজ সরকারের দৃষ্টি এড়াতে তিনি নানারকম পন্থা অবলম্বন করেন। যা ছিল তাঁর চাতুর্যে এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে পরিপূর্ণ। একবার তিনি জনৈক গ্রামবাসীর কুমড়োর বস্তার ভিতরে থেকে - তারমধ্যে শুয়ে তিনি ব্রিটিশ দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে যান। এছাড়া আরো এমন অনেক কাজ করেছেন, যা ছিল সত্যিই দুঃসাহসিকতায় ভরপুর। 
  
   তারাপদ কর্মকারের বৈপ্লবিক কাজকর্ম যখন তুঙ্গে, তাঁর জ্বালায় যখন ইংরেজ সরকার অতিষ্ঠ ঠিক তখনই তাঁকে ধরে হিজলী জেলে পাঠানো হল। দেড় বছর তিনি জেলবন্দি অবস্থায় কালতিপাত করেন। জেল থেকে ছাড়া পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই স্বাধীনতার কাজে যোগ দেন। জেলের কঠোর শাসন ও অকথ্য নির্যাতন তাঁকে তাঁর কার্যকলাপ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। বরং তিনি আরো ইংরেজ বিদ্বেষী ও জেদি হয়ে উঠেন। তাঁর নেতৃত্বে বদনগঞ্জে লবণ তৈরি হয়। 
   এরপর কগ্রেসী নেতা প্রফুল্ল সেন ও অতুল্য ঘোষের চরম ভক্ত হয়ে পড়েন। প্রফুল্ল সেন এবং অতুল্য ঘোষ বদনগঞ্জে বক্তৃতা দিতে এলে তারজন্য সভার আয়োজন করেন এবং আরো অনেকের সঙ্গে অনেককে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা নেন। এরপর এই দুই গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্ল সেন ও অতুল্য ঘোষের নির্দেশ মতো বদনগঞ্জ এলাকায় ব্যাপকভাবে ভারতছাড়ো আন্দোলনের ঢেউ জাগিয়ে তুলেন। ইংরেজ সরকার তাঁর এই বিধ্বংসী কাজকর্মে ক্ষেপে উঠে এবং তাঁকে ধরার জন্য লোক নিযুক্ত করে। ধরিয়ে দিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে – এই ঘোষণাও করা হয়। এই সময় তিনি বদনগঞ্জের নব চক্রবর্তীর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। গোটা বদনগঞ্জে ইংরেজ পুলিশ তল্লাশি চালায় তাঁকে ধরার জন্য। কথিত এই সময়েই একদিন বদনগঞ্জ বাজারের সন্নিকটে ইংরেজ সরকারের এক সভা চলছে। ইংরেজ দালাল আলতাফ জমাদার ভাষণ দিচ্ছে। তারাপদ কর্মকারকে কিভাবে ধরা যায় তার পরিকল্পনা চলছে। ঠিক সেই সময়েই সন্ধ্যাবেলায় মেয়েলি পোশাক পরে, পায়ে মল পরে সভার পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যান। মেয়েমানুষ যাচ্ছে তাই ইংরেজ সরকারের লোক সন্দেহই করতে পারে না। এইভাবে তিনি লুকিয়ে ছদ্মবেশে পুরুলিয়ার মানভূমে চলে যান। এরকমই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী তারাপদ কর্মকারের বৈপ্লবিক কাজকর্মের ইতিহাস। 
   ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে বিপ্লবী তারাপদ কর্মকার হাওড়ার ইছাপুরে চলে যান। ওখানেই এক আশ্রমের মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁরা সকলেই ইছাপুরেই আছেন। জন্মভিটা বদনগঞ্জে বর্তমানে তাঁর ভাইপোরা থাকেন। সম্প্রতি তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে যে সকল তথ্য পাওয়া গেল – স্বাধীনতা লাভের পর তিনি আর ফিরে আসেননি তেমন। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। 
   আর এক বিশ্বস্ত সহকর্মী স্বাধীনতা সংগ্রামী কালীপদ দে’র বক্তব্য – মৃত্যুর দু’মাস আগে তারাপদ কর্মকার বদনগঞ্জে আসেন। পুরনো দিনের মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা করতেন। ভালোবাসতেন এলাকার মানুষের সঙ্গে হেসে খেলে গল্প-গুজব করতে। খদ্দরের জামাকাপড় পরিধান করতেন। ভালোবাসতেন সহজ সাধারণ জীবনযাপন করতে। ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে এই প্রখ্যাত বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটে। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামী নয়, তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ। 
   ভারত সরকার তারাপদ কর্মকারের এই বৈপ্লবিক কাজকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে তাম্রপত্র প্রদান করেন। এই তাম্রপত্র নেওয়ায় ইচ্ছা তাঁর ছিল না। বহু মানুষের অনুরোধে তিনি তা নিতে স্বীকার করেন। এছাড়া আরো বহু জায়গায় তাঁকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। ভারতছাড়ো আন্দোলোনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বদনগঞ্জ এলাকাবাসী কালীপদ দে সহ তারাপদ কর্মকারকেও নতুন বস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে সম্বর্ধিত করেন। এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর আবক্ষ মূর্তি বা সেরকম কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই এলাকায়। এলাকাবাসীর তাই দাবি এখানে একটি তারাপদ কর্মকারের আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হোক। 

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments