জ্বলদর্চি

দুটি অণুগল্প /অভিজিৎ সাউ

দুটি অণুগল্প 

অভিজিৎ সাউ

ডাকবাক্স

অমিত দেখল ঠাম্মি বাড়ির ভাঙ্গা ডাকবাক্সটিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছে; কিছু বুঝতে না পেরে সে ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করল,  "ও ঠাম্মি, ভাঙ্গা ডাকবাক্সটির এত যত্ন নিচ্ছো কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ডের লাভ লেটার আসবে বুঝি!" ঠাম্মি হেসে বলল, "আমার কী আর সে বয়েস আছে রে দাদুভাই! এই মোবাইলের যুগে তুই এর মর্ম বুঝবিনা।" অমিত বুঝলো সে ঠাট্টা করতে গিয়ে ঠাম্মিকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে বলল, "এই ভাঙ্গা ডাকবাক্সে কি এমন আছে যে তুমি এত যত্ন নিচ্ছো?" ঠাম্মির চোখের কোণে ছলছলে আভা দেখা দিয়েছে; কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, "তোর ঠাকুরদা যখন কলকাতায় থাকতো তখন প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটা করে চিঠি লিখতো। আমি সারা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করতাম সেই চিঠির জন্য। দিনে কতবার যে এই ডাকবাক্সে এসে উঁকি দিতাম তার ঠিক ছিল না। এই ডাকবাক্সটি আমাদের অনেক আবেগ, প্রেম, হতাশা, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের সাক্ষী হয়ে থেকেছে।" অমিত মনে মনে ভাবছিল, "এই আবেগ গুলো এখন আমাদের মোবাইলের ইনবক্সে আর হোয়াটস-অ্যাপ চ্যাটে আছে গো ঠাম্মি।"

 অ্যাডমিশন

সুখেন বাবু কলকাতার একটি ব্যাঙ্কে বদলি হয়ে এসেছেন, সঙ্গে তার স্ত্রী সুলেখা দেবী এবং সপ্তম শ্রেণীতে পাঠরত বারো বছরের একটিমাত্র ছেলে মুকুলও আছে। 
একদম স্কুলের মাঝ সেশনে এসেছেন তাই ছেলেকে কোন স্কুলে অ্যাডমিশন করাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না; অবশেষে একটি বেসরকারি স্কুলে যোগাযোগ করলেন কিন্তু সেখানে মুকুলকে ইন্টারভিউয়ে পাস করতে হবে এবং সেই সঙ্গে মোটা অংকের ডোনেশনও দিতে হবে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুখেন বাবু রাজি হয়ে গেলেন। ইন্টারভিউয়ের দিন সুখেন বাবু মুকুলকে নিয়ে যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হলেন।  স্কুলের অফিসে চেয়ারম্যান এবং প্রিন্সিপাল দুজনেই উপস্থিত আছেন মুকুলের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। পরিচয়পর্বের পর চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, "মুকুল তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?" মুকুল বলল, "আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই, যদি কোথাও কোনো অন্যায় অত্যাচার দেখি তাহলে সেখানে আমি রুখে দাঁড়াবো; কোনোদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবোনা। নিঃস্বার্থ ভাবে দেশের মানুষের সেবা করবো, সমাজের লাঞ্ছিতদের পাশে দাঁড়াবো; যে শিক্ষা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে সেই শিক্ষাকে বিক্রি হতে দেখলে তার প্রতিবাদে গর্জে উঠবো। মানুষের মনের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারকে দূর করবো...... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 
          অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
          তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।"
 মুকুলের কথা গুলো তাদের গায়ে যেন চাবুকের মতো আঘাত করছিল। ইন্টারভিউয়ের শেষে স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার সুখেন বাবুকে ডেকে বললেন, " অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমরা আপনার ছেলের অ্যাডমিশন নিতে পারবো না। কারণ আমাদের সিলেবাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কিন্তু আপনার ছেলে অনেকটাই পিছিয়ে গেছে ও সিলেবাস কভার করতে পারবেনা।" 
সুখেন বাবু ধন্যবাদ জানিয়ে মুকুলকে নিয়ে স্কুল থেকে চলে আসছেন কিন্তু তাঁর কোনো আফশোষ নেই। বরং গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠছে, আনন্দে চোখে জল চলে এলো।
মুকুল তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, " বাবা, ওরা আমাকে অ্যাডমিশন দেবে না?"
সুখেন বাবু, "না রে সোনা।"
মুকুল, "কেন বাবা? আমি তো সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি!"
সুখেন বাবু, "এই স্কুল তোর যোগ্য না। আমি তোকে আরো ভালো স্কুলে অ্যাডমিশন করাবো। তবে তুই বদলে যাবিনা সোনা, সবসময় এইরকম থাকবি।"
মুকুল, " হ্যাঁ বাবা।"
সুখেন বাবু মুকুলকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, এমন সময় পাশের চায়ের দোকানের এফ.এম রেডিও থেকে গান ভেসে এলো.....
   
                "লাল পাহাড়ির দেশে যা,
                 রাঙা মাটির দেশে যা,
                 হিতাক তোকে মানাইছেনা রে,
                 ইক্কেবারে মানাইছেনা রে......"


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments