জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-৩১/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
পর্ব- ৩১
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও সমাজ- ৬ 

যে দেশে বেঁচে থাকার মধ্যে কোনও সুখ নেই, সম্ভোগ নেই, বিকাশও নেই, যে দেশে বাঁচাটা প্রায় কোনও ক্রমে টিকে থাকার সামিল, সেখানে মনে হয় আর বেঁচে থেকে কাজ নেই, কোনও রকমে এ দেহ ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচি। প্রাচীন যুগে মানুষ নিজের বিকাশের মাধ্যমে উন্নতির চাইতে 'উদ্ধার লাভের' জন্য বেশি ব্যাকুল থাকতো। কিন্তু মানুষের কাজ তো মরে বাঁচার জন্য নয়। এখানেই বুদ্ধিজীবীদের প্রধান কাজ হল, মানুষের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা। সামাজিক নীতি আদর্শ ও জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করা, বুঝিয়ে দেওয়া। সমাজ যত স্থিতিশীল হয়, সামাজিক গড়ন তত অচলায়তনের মতো অটল অনড় হয়ে ওঠে। যেমন একটি বদ্ধ পুকুরে শ্যাওলা জন্মায়, কিন্তু যে নদীতে স্রোত থাকে সেখানে শ্যাওলা জন্মাতে পারে না। প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ সমাজ ও পণ্ডিত সমাজের কোনো পার্থক্য ছিল না। এরা সে সময় বুদ্ধিজীবী বলে সামাজিক একটা জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই তাঁরা সমাজ জীবনের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে পেরেছিল। তাদের চিন্তাধারা জ্ঞান বিদ্যা একটি পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই তাদের জ্ঞানবিদ্যা ও ক্রমে সঙ্কীর্ণ ও প্রাণহীন হয়ে উঠেছিল। প্রত্যক্ষ সমাজ জীবনের দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন ও সমস্যার সাথে এদের কোন সম্পর্ক ছিল না। এই কেতাবী শিক্ষায় মানুষ যে নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা, তার ভাগ্য রচনা করার ক্ষমতা তার নিজের মধ্যে আছে তা পাওয়া যেতো না। 
এই প্রসঙ্গে দার্শনিক 'ম্যানহাইম' বলেছিলেন--চিন্তার উদ্রেক হয় প্রত্যক্ষ জীবনসংগ্রাম থেকে। যেমন একজন চাষী মাঠে ধান চাষ করেন। তিনি কেবল জানেন কখন জল সার ঔষধ দিতে হবে। আর শহরে বাবু যিনি বই পড়ে পরীক্ষায় পাশ দিয়ে সরকারের কৃষি বিশেষজ্ঞ হয়ে চাষের বিষয়ে বলেন,তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় চাষির থেকে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা কম হবে। চাষির সংগ্রাম জীবনসংগ্রাম। আর কেতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত কৃষি বিশেষজ্ঞের সংগ্রাম জীবিকাসংগ্রাম। তাই জীবন সংগ্রাম ও জীবিকার সংগ্রাম এক নয়। তাই 'ম্যানহাইম' বলেছিলেন, "শিক্ষাগত চিন্তা এবং কেতাবী শিক্ষা এরকম কোনো জীবন সমস্যার প্রত্যক্ষ ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সৃষ্ট হয় না। তাই সমাজ জীবন থেকে সে চিন্তা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এমনকি প্রাকৃতিক জীবন থেকেও।" প্রধানত এই বিদ্যা এবং চিন্তা নিজেদের উন্নতির জন্য 'শাস্ত্রের' মধ্যে ধরে রাখা হয়। বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে নয়। আর সেই শাস্ত্রবিদ্যা দিয়ে বছরের পর বছর একইভাবে সব সমস্যা ও তার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়। এই কাজ আগের দিনের পণ্ডিতরা করতেন। তাই সেকালের অচল অটল নিরেট সমাজে তাঁরা ছিলেন প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবী। 
এরপর দেশ যখন অবাধ বাণিজ্য ও ধনতন্ত্রে প্রবেশ করলো, তখন জন্ম নিল নতুন বুদ্ধিজীবীর দল। তাঁরা যে শিক্ষা আয়ত্ত করতে লাগলেন, তার মধ্যে ছিল প্রখর বিচারবুদ্ধি, নির্মল যুক্তি ও উদার মূল্যবোধ। এই নতুন যুগের আদর্শ হলো মহানুভবতা নয় মানবতা। একে বলা হয় মানবতন্ত্রী। অনেকে একে আবার মানবধর্ম বলে ভুল করেন। কিন্তু মানবতন্ত্রী আর মানবধর্ম এক নয়। এই প্রসঙ্গে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী 'আলফ্রেড ফন মার্টিন' বলেন, "Humanism here represented an ideology which played a closely defined part in the bourgeoisies struggle for emancipation and power." এর অর্থ হলো মানবতন্ত্রী এমন একটি শক্তি, যা বুর্জোয়া শক্তি থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে। মানবতন্ত্রীর বিচারে মানুষ শুধু সবকিছুর মাপকাঠি নয়, মানুষই মনুষ্যত্বের একমাত্র উৎস। কিন্তু আমরা প্রাচীনকাল থেকে বাপঠাকুর্দার সময় থেকে শুনে এসেছি যে, মনুষ্যত্বের উৎস মানুষ নয়। মানুষের মধ্যে যে ঈশ্বরের বা পরমাত্মার অংশ রয়েছে, তিনিই মনুষ্যত্বের যোগানদার। আবার খৃষ্টানরা বলেন, মনুষ্যত্বের মধ্যে ভালো কিছু নেই। কারণ মানুষের অস্তিত্ব আদিম পাপের দ্বারা চিহ্নিত। আর ঈশ্বর দয়া না করলে, সে পাপ থেকে আমাদের মুক্তি সম্ভব নয়। তাঁরা কিছুতেই মানতে রাজি নয় যে, মানুষের যা কিছু গুণ মানুষের নিজের অস্তিত্ব থেকে পাওয়া। কিন্তু নতুন যুগের আদর্শ হলো যে, মানুষের বিচিত্র সম্ভাবনাসমষ্টির নাম মনুষ্যত্ব। আর তাই মানুষের বিকাশের জন্য কোনও অতিমানবিক শক্তির কল্পনা স্পষ্টতই অবান্তর। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। তার ভাগ্য রচনার ক্ষমতা নিজের হাতেই আছে। বিশিষ্ট দার্শনিক 'পিকো দেলা মিরান্দোলা' তাঁর 'মানুষের মহত্ত্ব বিষয়ক' প্রবন্ধে বললেন- "ঈশ্বর আদমকে বললেন, দেখো তোমাকে আমি মুক্ত জীব হিসাবে সৃষ্টি করছি। আমার অন্য কোনও সৃষ্টির মধ্যে বিকাশ নেই। কিন্তু তুমি নিজের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে নিজেকে যেভাবে খুশি বিকশিত করতে পারো। শুধু তোমার মধ্যেই বৈশ্বিক জীবনের বীজ উপ্ত আছে। আবার আর একজন মানবতাবাদী 'আলবর্তি' লিখলেন, " মানুষ যদি ইচ্ছা করে তবে সবকিছুই সে করতে পারে।" কোন ও গ্রহ-নক্ষত্র বা দেবদেবী মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে দমিত করতে পারে না। অর্থাৎ মানুষ কারও হাতের যন্ত্র নয়, সে নিজেই যন্ত্রী। 
  মানুষের মধ্যে অফুরন্ত সম্ভাবনা বর্তমান। মানুষ নিজের চেষ্টায় সেই সব সম্ভাবনাকে সার্থক করে তোলে। এইভাবেই মানুষ নিজেকে নিজে বারবার নতুনভাবে সৃষ্টি করে। তাই মানুষ নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। মানুষের ইতিহাস তাই নিত্য নতুন সৃষ্টির ইতিহাস। 

  মানুষ তাই নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করে। আর তা সম্ভব হয় দুটি কারণে, এক বুদ্ধি আর অন্যটি মুক্তির স্পৃহা। অন্য জীবজন্তুর মধ্যে ও এ দুটি আছে। তবে মানুষের দেহ এবং তার মস্তিষ্কের আশ্চর্য বিবর্তন যা অন্য জীবজন্তুর মধ্যে নেই। মানুষের ক্ষেত্রে বুদ্ধির প্রকাশ বহুমুখী। বুদ্ধির দ্বারাই মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির কার্য-কারণ এবং বিশ্বপ্রকৃতিকে মানুষ নিজের কাজে লাগায়। বুদ্ধি মানুষকে সার সত্য জানতে সাহায্য করে। এবং ধারণায় ব্যাপকতা ও স্পষ্টতা আনে। মানুষ অনুভূতিশীল বলে, তার জীবনে জটিলতার দ্বন্দ অন্য প্রাণীর তুলনায় প্রবল। বুদ্ধির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভাবনার লেনদেন হয়। সামাজিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে। 

  অনেকে বলেন আমাকে এবার মুক্তি দাও! মুক্তি মানে তারা বলতে চায় দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি। মহাপ্রয়াণ! অর্থাৎ মরে যাওয়া। তারা যেন বলতে চায় এ জীবদেহ থেকে পরমব্রহ্মে বিলীন হতে পারলেই শান্তি। আর এ পরিবেশ তৈরি করেছে আমাদের দেশের আধ্যাত্মিক পরিবেশ। কিন্তু যারা মানবতাবাদী তাঁরা মুক্তি মানে বোঝে মানুষের মধ্যে বিচিত্র সম্ভাবনাকে সার্থক করার অপর নাম মুক্তি। তাদের সাধনা মরে বেঁচে যাওয়ার সাধনা নয়। মানবতাবাদীরা বোঝেন, মানুষের নিজস্ব চেষ্টার অনুভূতির বিচিত্র প্রকাশ। তাঁরা বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অফুরন্ত বিচিত্র সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আর সেই সম্ভবনাকে সার্থক করতে হলে, যেমন মনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে, তেমনি দেহের ও ক্ষমতা চাই। তবেই পারবে পরিবেশের বাধা-কে দূর করতে। এই ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বুদ্ধিকে যেমন মার্জিত করা দরকার, তেমনি অনুভূতিকে সূক্ষ করা দরকার। যে উপায়ে দেহ ও মনের যথার্থ বিকাশ ঘটে, তাকেই বলে প্রকৃত শিক্ষা। 

  এই প্রকৃত শিক্ষাই শেখায় আমি কার সঙ্গে লড়াই করবো, আর কার সঙ্গে করবো না। যারা অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির মানুষ তাঁরা সবসময় চায় সফল ব্যক্তির সাফল্যকে ছোট করে দেখতে। সফল ব্যক্তির দোষ গুলিকে বড় করে দেখতে। মানবতাবাদীরা জানে তাদের সঙ্গে লড়াই না করলেই, তবে জীবনে জয়যুক্ত হবে। সেই নীচ প্রকৃতির মানুষেরা যদি আঘাত করার জন্য মানবতাবাদীদের লক্ষ্য করে, তবে মানবতাবাদীরা তা আটকাবার চেষ্টা না করে সরে দাঁড়ায়। কারণ ঐ আঘাত আটকাতে গেলে যে শক্তির প্রয়োজন, সে শক্তি অপচয় না করে সমাজের উন্নতির জন্য তা ব্যয় করে। তাছাড়া তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হলে, তাদের স্তরে নেমে আসতে হয়। আর নীচ প্রবৃত্তির লোকেরা তাই চায়। 

  বুদ্ধির চর্চা ও মুক্তির সাধনা পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। বুদ্ধি ছাড়া ব্যক্তির বিকাশ অসম্ভব। বুদ্ধির না চর্চা করলে, সেই বুদ্ধি জড়ত্বে পরিণত হয়। সত্যের অনুসন্ধান মানুষের মুক্তি প্রয়াসকে সাহায্য করে। মুক্তির প্রয়াস জিজ্ঞাসাকে অবসন্ন হতে দেয় না। যারা বুদ্ধি বিমুখ মন নিজের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে সার্থকতা খোঁজে। তারা প্রচলিত ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে সবরকম প্রশ্ন করার সাহস হারায়। কিন্তু যারা মানবতাবাদী তাঁরা দাস নয়, তাঁরা কর্তা। তাঁরা তাদের বুদ্ধির দ্বারা নিয়ম-নিয়ন্ত্রিত জগতকে মানুষের বিকাশের কাজে লাগায়। তাঁরা একাধারে বুদ্ধিমান এবং মুক্তিকামী। তাই ইতিহাস তাদের নায়করুপে মেনে নেয়। 

  তাঁরা ইতিহাসের নায়ক হলেও, কখনও নিজেদের ব্রহ্ম বলে দাবী করে না। কারণ মানবতাবাদীদের অস্তিত্ব দেহের দ্বারা নির্ধারিত। আর ব্রহ্ম বিশ্বপ্রকৃতি’র সব সম্ভাবনা একদেহে অবস্থান করছে। মানুষের বিকাশের সম্ভাবনার স্তরের কোথাও চরমসীমা নেই। মানুষের বিকাশ ক্রমশ থেকে আরও ক্রমশ। আর ব্রহ্ম এমনি কল্পনা যার কোন দেহাশ্রিত বাস্তবীকরণ অসম্ভব। যে বিকাশের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। তাই ব্রহ্মত্ব অর্জন কোনো মানবতাবাদীর লক্ষ্য হতে পারে না। 
  'আর্ল নাইটিংগেল' একবার বলেছিলেন, "একটি যথার্থ উদ্দেশ্য উত্তরোত্তর উপলব্ধির নামই সফলতা।" উপলব্ধি হল একটি অভিজ্ঞতা। বাইরের কোনো শক্তি আমাকে সাফল্যের অনুভূতি দিতে পারে না। এটা মানুষকে নিজের মধ্যে অনুভব করতে হয়। মানবতাবাদীরা জানে জীবন সংগ্রামে জয় অথবা পরাজয়ের দু'য়েরই সম্ভবনা আছে। কোন জয় সংগ্রাম ছাড়া আসে না। শান্ত সমুদ্রে কখনো দক্ষ নাবিক হওয়া যায় না।(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments