জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান -১৭/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল


ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

"সপ্তদশ পর্ব- "সাহিত্য ৬"

ভাসের পর আমরা এইবার লক্ষ্য রাখব খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর দিকে। এই যুগের প্রধান শ্রেষ্ঠ কবি ধরা হয় অশ্বঘোষকে, যিনি নাকি কনিষ্কের সমসাময়িক। তবে কারো কারো মতে তিনি তিনি অযোধ্যার অথবা কাশী বা পাটনার লোক ছিলেন। এক্ষেত্রে একটু পারিবারিক পরিচয় জানিয়ে রাখা ভালো, তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, তাঁর পিতা সৌম্যগুহ ও মাতা সুবর্ণাক্ষী। তিব্বতীয় জীবনচরিত প্রণেতার মতে তিনি সুকণ্ঠ গায়ক হওয়ার দরুণ, সঙ্গে অনেক গায়ক ও গায়িকা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এমনটাই প্রচলিত আছে। তাঁর গান গাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল- জগতের অনিত্যতা প্রচার করা, যা নাকি শ্রোতৃমন্ডলীকে বেশ আকর্ষণ করত বলে জানা যায়।

তিনি তর্কেও বেশ পারদর্শী ছিলেন, তথ্য মারফত জানা যায়, তিনি বৌদ্ধদের ভারতবর্ষের বহু স্থানে তর্কে পরাস্ত করে, সর্বশেষে আর্যদেব কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি বৌদ্ধদের মধ্যেও খুব সম্মান লাভ করেছিলেন। চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইতসিং ৬৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষ ঘুরেছেন। তাঁর মতে নাগার্জুন, দেব, ও অশ্বঘোষের মতো লোক এক একটি যুগে নক্ষত্রের মতন। যদিও তিনি কবি হিসাবে যতটা না বিবেচ্য, ততটা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিসাবে তাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি সমৃদ্ধ নন। আর এইখানে এই কবি বিষয়টিকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

ফরাসী পন্ডিত সিলভা লেভি বলেছিলেন-
"খ্রীস্ট শতাব্দীর প্রারম্ভে যে সমস্ত বৃহৎ স্রোত ( ভাব স্রোত) ভারতবর্ষকে সঞ্জীবিত ও পরিবর্তিত করেছে তিনি তার উৎপত্তি স্থানে দন্ডায়মান। ভাবের সম্পদ ও বৈচিত্র্যে তিনি মিন্টন, গেটে, কান্ট ও তলটেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।"
অশ্বঘোষ বুদ্ধ-চরিতের পাশাপাশি সৌন্দরানন্দ কাব্য, সূত্রালঙ্কার ও বজ্রসূচীরও প্রণেতা একত্রে।

সম্প্রতি সারিপুত্রপ্রকরণ নামক অশ্বঘোষের একটি নাট্যকাব্যের আবিষ্কার হয়েছে, যা বুদ্ধ-চরিত মহাকাব্যের ধরনে লেখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- এই কাব্যটির সম্পূর্ণটুকুর উদ্ধার সম্ভব হয়নি, সামান্যটুকু কাব্যাংশের উদঘাটন সম্ভবপর হয়েছে। এই কাব্য একদিকে যেমন কবি বাল্মীকি ও অন্যদিকে কবি কুলচূড়ামণি কালিদাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অশ্বঘোষের অলংকরণ ও শব্দ প্রয়োগ কালিদাস ও বাল্মীকির মতোই সমতুল্য। কোথাও কোনো শ্লথের লেশ মাত্র নেই।

তাঁর ভাষা ও ভাব প্রকাশের ভঙ্গী কতটা সুগঠিত, মধুর, প্রাঞ্জল, সংযত, বলিষ্ঠ, ও প্রশান্ত তা তাঁর নাট্যের প্রথম সর্গে বুদ্ধদেবের মাতার বর্ণনা দেখেই চয়ন করা যায়-
"সমগ্র দেবী নিবহাগ্রদেবী বভূব মায়াপগতেব মায়া" অর্থাৎ তিনি সমস্ত রাণীকূলের রাণীস্বরূপ। "মায়াপগতের মায়া" মৃচ্ছকটিক নাটকের প্রধান নায়িকা বসন্তসেনার বর্ননা "বসন্তশোভেব বসন্তসেনা" অর্থাৎ, বসন্ত শোভার ন্যায় বসন্তসেনা।
বুদ্ধদেবের জন্মের পর অসিত মুনি এসে নবজাত শিশুর সমন্ধে ভবিষ্যৎ বাণী করেন, সেই জায়গা থেকে অনেকেই দুটি বিখ্যাত শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন, যা থেকে অশ্বঘোষের কবি-প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। উল্লেখ্য-

" দুঃখার্ণবাদ্ব্যাধি বিকীর্ণফেনা
জরাতরঙ্গান্মরণোগ্রবেগাৎ।
উত্তারষিষ্যত‍্যয় মূহ‍্যমানমার্ত‌‌নং  জগজ্জ্ঞান মহাপ্লবেন ।।।"

অর্থাৎ, ব্যাধিরূপ বিক্ষিপ্ত ফেনা, জরারূপ তরঙ্গ, মৃত্যুরূপ উগ্র স্রোতবেগ- সমন্বিত দুঃখ সাগরে প্রবাহিত আর্ত জীবসকলকে তিনি জ্ঞানরূপ মহানৌকা দ্বারা উদ্ধার করবেন।

" প্রজ্ঞাম্বুবেগাং স্থিরশীল বপ্রাং সমাধিশীতাং ব্রত চক্রবাকাং ।
অন্যোত্তমাং ধর্মনদীং প্রমৃত্তাং তৃষ্ণার্দিত‍ঃ পাস্যতি জীবলোকঃ।। "

অর্থাৎ, তৃষ্ণার্ত জীবলোক তাঁর ধর্মনদীর জলপান করে পিপাসা দূর করবে, সেই নদীর স্রোত প্রজ্ঞা তার নীতি ও সৎ স্বভাব, শীতলতা সমাধি এবং চক্রবাক ব্রতস্বরূপ।

প্রবাদ আছে মহাভিনিষ্ক্রমণের পূর্বে সিদ্ধার্থ তিন দিন শহর দেখতে বেরিয়েছিলেন। তিনি যেদিন প্রথম ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন, জানা যায়, তাঁকে দেখার জন্য প্রচুর মেয়ের ভিড় জমেছিল। তার বর্ণনা আমরা তৃতীয় সর্গে পাই। মহারাজ অজ সয়ম্বর সভা থেকে ফিরে এলে তাঁকে দেখবার জন্যও নাকি মহিলাদের বেশ ভিড় জমে ছিল। তার বর্ণনা আমরা কালিদাসের রঘুবংশে পেয়ে থাকি। ওই যে পূর্বেই উল্লেখ ছিল অশ্বঘোষের লেখা পড়লেই কালিদাসের লেখা ভেসে ওঠে।

ছন্দক যখন বুদ্ধদেবকে রেখে ফিরে আসেন, সেই সময়কার ছন্দকের বর্ণনা ও শকুন্তলার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নগরে ফিরে যাওয়ার পরবর্তীতে দুষ্মন্তের মানসিক অবস্থার যে সাদৃশ্য পেয়ে থাকি, তা এক কথায় অতুলনীয়।

"ততো নিরাশো বিলপন্মুহুর্ষু হুর্ষযৌ শরীরেণ পুরং ন চেতসা " (বুদ্ধ-চরিত ষষ্ঠ সর্গ)"
অর্থাৎ, অতঃপর নিরাশ হৃদয়ে বারবার বিলাপ করতে করতে শরীর মাত্র বহন করে নগরে ফিরলেন, কিন্তু তাঁর চিত্ত সেইখানেই রয়ে গেল।

"গচ্ছ্তি পুরঃ শরীরং ধাবতি পশ্চাদসংস্থিতং চেতঃ" (অভিজ্ঞান শকুন্তলম, প্রথম সর্গ)
অর্থাৎ, শরীর সামনে যায় বটে কিন্তু চঞ্চল মন পেছন দিকেই ধাবিত হয়।

এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, অশ্বঘোষ কতটা উঁচুদরের কবি। বৌদ্ধসন্ন্যাসীদের চিন্তাধারা সংস্পর্শ যা তাঁর চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে পারেনি না কোথাও কোনো বিন্দুমাত্র খর্ব করতে পারেনি। তাই তিনি বুদ্ধচরিতে সর্বোতোভাবেই কবি।

(ক্রমশ..........)
পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments