জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /গৌতম বাড়ই

পশুপাখি আর একটি আয়নার কথা
গৌতম বাড়ই

বাঘ

লোকটিকে বাঘের মতন দেখতে নয় অথচ তার 'টাইগার' নাম। বাঘ জানে মানুষ কখনও টাইগার হতে পারে না। টাইগার হতে গেলে ঠিক যতটা বাঘ হতে হয় মানুষ তার নখকুণি-ও নয়। বাঘ কখনও শহরের ঘরে ঢুকে মানুষকে খায়নি কিন্তু মানুষ জঙ্গলে ঢুকে বাঘকে শিকার করেছে নির্বিচারে। লোকটি বাঘের মতন দেখতে নয় আর স্বভাব চরিত্রে তো বিন্দুমাত্র মিলও নেই অথচ তার নাম "টাইগার"। 


হাতি

তৃণভোজী হাতি।  সবুজ ঘাস- পাতা খায় আর  বুদ্ধিমান জীবের বশ্যতা স্বীকার করেছে। হাতি কখনও কখনও প্রকাশ করে ফেলে তার অসম্ভব গায়ের জোরে শক্তিশালী প্রাণী। সেইসব দেখে শুনে মানুষ এদের দেবতা বানিয়ে ফেলে। বুদ্ধিমান প্রাণী বলে একটু আধটু পরিচিতি পায়। হাতি যখন দেবতা হয়ে ওঠে ওর পিঠে বসা পুঁচকে একরত্তি মাহুতের আর মালিকের দুটো খোরাকী জোটে। 'জাম্বো সার্কাসে'  আপ্পু হাতি-কে দিয়ে বেশ একজোড়া বড়সড় সাইজের নারকেল ভাঙ্গিয়ে ছিল ম্যানেজার কাম মালিক টি এস চন্দ্রণ।

হরিণ

হরিণের মায়াবী চোখে যাদু ঝরে পড়ে। হরিণ না এলে নাকি মহাকাব্যে গড়বড় থাকত। নিরীহ সুন্দরী কিন্তু কেন লুকিয়ে রেখেছিলি মোহময় চামড়ায় ঢাকা দেহের অভ্যন্তরে ওরকম সুস্বাদু নরম ভোগের মাংস? হরিণ চোখও পেয়েছিল সাথে। মানুষের মতন ভোগী পৃথিবীতে কেউ নেই। চাহিদার শেষ নেই। দুঃখের- ও শেষ নেই। মানুষ একহাতে নরম মাংস চাখে আর এক চোখে হরিণ চোখ খোঁজে। হরিণ- বনে বাঁকা- বাঁকা শিঙের চারুকলা।


ময়ূর

বহুবর্ণে পেখম তুলে নেচেছে আর মানুষ কাব্যে মশগুল থেকেছে। কন্ঠ পায়নি কিন্তু নৃত্য পেয়েছে। ময়ূরের মেঘ হেমন্তে এক চিলতে রোদ্দুর এনে প্রকৃতিকে দিয়েছে ঢেলে। ময়ূর সিংহাসন টলমল করেছে বারবার আর ততবার পেখম তুলেছে সে, দুলেছে সে। বাগানের সবুজ ঘাসে। ময়ূর আদতে একটি পাখি, সবাই জানে। ময়ূর- বসন্ত হয় কিনা জানা নেই, ময়ূরের মতন স্বপ্ন থাকে জানি। ময়ূরের পালক তুলে মস্তকচূড়ায় লাগিয়েছে মানুষ, দেবতাকেও দিয়েছে লাগিয়ে। ময়ূর একটি পাখির মতন কিছু বা আরও কিছু।


আয়না

আরশি বা দর্পণ বললে কেমন যেন লাগে। সাধারণের বলে মনে হয় না। এ আয়নার বয়স চার-পুরুষের।  চার-পুরুষে শুধু ভাঙ্গা, গড়া আর দেখল কৈ? বার্মা টিকের বাহারী কাজে ফ্রেমে বেলজিয়ামের গ্লাস। হাত বদল হতে গিয়েও অনেকবার হাত বদল হয়নি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এ খন্ডহরের মাঝে। সামনে দাঁড়াতেই ঝরঝর করে বলে উঠবে ইতিহাস। এক- একটা মুখ স্মৃতি রেখে কেমন সরে গিয়েছে! আয়নায় জমে আছে অনেক জন্ম আর তারচেয়ে বেশি মৃত্যু। সন্ধে প্রদীপের আলো পড়ত এক সময়। সিঁথে লাল হয়ে উঠত। সিঁথে সাদা-কালো বর্ণহীন। রাত হলে কেউ- কেউ কেঁদে উঠত আয়নার মুখে। একটা আয়না ধরে রাখত অনেক যৌবন প্রৌঢ়ত্ব। আয়না এখন গভীর রাতের বিষাদ সিন্ধু। আয়নায় জমে আছে মৃতেরা। বহুবছর আর আয়নার মুখোমুখি হইনি। কাছে গেলে মায়ের মুখ মনে পড়ে। আশেপাশে হাত বুলিয়ে দেখি, মুখোমুখি হইনা আর আয়নার। এ বাড়িতে শুধুমাত্র একজন কনফেস করেছিল-  "হরিণের মাংস সুস্বাদু এ এক সর্বৈব মিথ্যে কথা"।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments