জ্বলদর্চি

কাঁথির ঈশ্বর মধুসূদন /সন্তু জানা

অনুসন্ধানীর ডায়েরি -৭ 
অখণ্ড মেদিনীপুর পর্ব

কাঁথির ঈশ্বর মধুসূদন 
 সন্তু জানা

কাঁথি শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি সুন্দর সাজানো সরু উপ-রাস্তা চলে গেছে পুরনো নিমক মহলের দিকে । নাম মধুসূদন জানা সরণি। রাস্তার শুরুতে সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত একটি মর্মর মূর্তি। বিখ্যাত চিকিৎসক ও প্রকাশক মধুসূদন জানার আবক্ষ মূর্তি। সদা ব্যস্ত মানুষের দৈনন্দিন যাত্রাপথের চির সঙ্গী তিনি। হয়তো মনে মনে বলছেন " দাঁড়াও পথিকবর "। কিন্তু তিনি তো মধু-কবি নন। কেউ কি শুনছেন তাঁর কথা !!

       মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের অশ্রুস্রোত ধারা আটকে রাখতে পারলাম না। ইনিই মেদিনীপুর জেলার সেই কীর্তিমান মহাপুরুষ মধুসূদন জানা। ১৯০১ সালে তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল অতীতের সুবিখ্যাত "সাপ্তাহিক বার্তাবহ -নীহার"। কেবল আঞ্চলিক কাগজ বললে বিলকুল ভুল হবে। বরং আস্ত ইতিহাস বলা ভালো। দীর্ঘ প্রায় সাত-আট দশক ধরে এই কাগজটি যেন মেদিনীপুর জেলার আত্মকথা। আজকে সেই মানুষটির একটি মাত্র মূর্তি অখণ্ড মেদিনীপুরের একটি মাত্র স্থানে কেমন যেন একলা, সঙ্গীহীন। তাঁর সাধের 'নীহার প্রেস' থেকে মেরেকেটে খুব জোর ২০০ মিটার দূরে।

    বহু দিন আগে ব্রিটেনে প্রাচীন ইংরেজি যুগে (৪৫০ - ১০৬৬ খ্রি) রাজা অ্যালফ্রেড যেমন anglo - Saxon chronicle লিখে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অতীতের ব্রিটেনকে সজীব করে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছিলেন, ঠিক  তেমনই মেদিনীপুরের জন্য করেছিলেন দূরদর্শী মধুসূদন জানা। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ১২ আশ্বিন ১২৬৪ বঙ্গাব্দে তমলুক মহকুমার বিরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এই  মহান মেদিনীরত্ন। ইংরেজি ১৮৭০ সাল নাগাদ কাঁথি মধ্য-ইংরেজি স্কুলে সরকারি শিক্ষক রূপে চাকুরীতে যোগদানের সুবাদে কাঁথি শহরে চলে আসেন তিনি। ঠিক তার পর থেকেই কাঁথি তে শুরু হয় নতুন ইতিহাস। 

       সেযুগে গ্রাম্য মেদিনীপুরের গঞ্জে গঞ্জ তিনি ভরসাযোগ্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রূপে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন । ১৮৭৫ সালে কাঁথিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়। দীর্ঘ ছয়-সাত দশক ধরে প্রায় ১৯৪৫ সাল অবধি সেই  "আদি ও অকৃত্রিম " হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয় সমগ্র দক্ষিণ মেদিনীপুরের মানুষের নিকট যত্নশীল চিকিৎসা পাওয়ার বিশ্বস্ত কেন্দ্র রূপে জনপ্রিয় ছিল। কেবল তাই নয়, ওই ঔষধালয়টি সেযুগে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সমস্ত প্রকার ওষুধ, যন্ত্রাদি, গ্রন্থ তথা মারাত্মক অলাউঠা, বসন্ত রোগ, হাঁপানি ও সুপ্রসবের পরীক্ষিত সঠিক ওষুধ সযত্নে এবং সাবধানে সংরক্ষিত ও বিক্রীত হত। মেদিনীপুর জেলার একটি প্রান্তের সাধারণ মানুষের চোখে মধুসূদন জানা দ্রুত হয়ে উঠেছিলেন সাক্ষাৎ "ঈশ্বর"। বাংলার ০৪ কার্তিক ১৩৪৫ সালে এই মহান আত্মা ইহলোক ত্যাগ করেন।

      হা ঈশ্বর, এমন মহান মানব- ঈশ্বরের একমাত্র মূর্তিটির কাছে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে রাস্তা জুড়ে চলমান শত শত মানুষের মধ্যে কজন একবারটি ঘুরে চায়? একবারটি জানতে চায় তিনি কেমন আছেন ??

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments