Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ১১
অসীম ভুঁইয়া
অনুসর্গের কেরামতি
শব্দশ্রেণির অন্যতম অঙ্গ অনুসর্গ। বাক্যে যা মূলত শব্দের পরে বসে কখনো বিভক্তির কাজ করে, কখনো বা স্বতন্ত্রভাবে একাধিক পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে। এরা স্বতন্ত্র শব্দ হিসেবেও নিজস্ব অর্থ বহন করে। সাধারণভাবে দেখা যায় এরা কোনো শব্দের পরে বসে সেই শব্দের অর্থকে স্পষ্টতা দেয় বা শব্দের মাত্রাগত পরিবর্তন করে।
অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ বিশেষ্য বা বিশেষ্য স্থানীয় শব্দের পরে (কখনো আগে) স্বতন্ত্রভাবে বসে কারক বিভক্তির কাজ করে বা অন্যান্য পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে অনুসর্গ বা পরসর্গ বলে। একে পুরনো ব্যাকরণে কর্মপ্রবচনীয় বলা হত। যেমন- থেকে, অপেক্ষা, করে, বিনা, ছাড়া, মতো, প্রতি প্রভৃতি।
বাক্য - i. সবাই তোমার "মতো" নয়।
ii. ওকে "দিয়ে" কিছুই হবে না।
এই উদ্ধৃতি দেওয়া শব্দগুলিই অনুসর্গ।
অনুসর্গকে শব্দের একটি বিশেষ শ্রেণি হিসেবে আমরা গ্রহণ করেছি। মানে আমরা বলতে চাইছি, বিশেষ্য বিশেষণ প্রভৃতির সমান্তরালেই শব্দশ্রেণি হিসেবে অনুসর্গকে স্থাপন করেছি। একটি অদ্ভুত ব্যাপার, প্রথাগত ব্যাকরণে বিশেষ্য,, বিশেষণ,, সর্বনামকে পদ হিসেবে বলি; কিন্তু কখনো অনুসর্গের সঙ্গে পদ কথাটি যুক্ত করে বলি না। এর কারণ অজ্ঞাত।
যাইহোক অনুসর্গ যেহেতু একটি শব্দ, তাই তারও নানা শ্রেণি এসে পড়ে। তবে এর শ্রেণিবিভাগও কিছুটা সমস্যার দাবি রাখে। তা সত্ত্বেও আমরা, মোটামুটি একটি শ্রেণি নির্ণয় করতেই পারি।
অনুসর্গকে প্রাথমিকভাবে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়।
এক: উৎস ও প্রকৃতি অনুসারে।
দুই: গঠন অনুসারে ও
তিন: সম্পর্ক স্থাপনের পার্থক্য অনুসারে।
এক: উৎস ও প্রকৃতি অনুসারে অনুসর্গ: উৎস ও প্রকৃতি অনুসারে অনুসর্গকে দু ভাগে ভাগ করছি।
১। নাম অনুসর্গ বা শব্দ জাত অনুসর্গ এবং
২। ক্রিয়াজাত অনুসর্গ।
১। নাম অনুসর্গ বা শব্দজাত অনুসর্গ : বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় পদগুলিকে নামপদ বলা হয়। আর এই বিশেষ্যস্থানীয় পদগুলি থেকে যে সমস্ত অনুসর্গ এসেছে, তাদের নামজাত অনুসর্গ বলে। নামজাত অনুসর্গের তিনটি শ্রেণি
i. সংস্কৃত বা তৎসম অনুসর্গ। ii. তদ্ভব বা বিবর্তিত অনুসর্গ এবং
iii. বিদেশি অনুসর্গ।
i. তৎসম বা সংস্কৃত অনুসর্গ: যে অনুসর্গগুলি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে তাদের তৎসম বা সংস্কৃত অনুসর্গ বলে। যেমন- অপেক্ষা, অভিমুখে, উপরে, কারণে, জন্য, নিমিত্ত, প্রতি, সঙ্গে, দিয়ে প্রভৃতি।
সংস্কৃত অনুসর্গের কিছুগুলি বাংলায় এসে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে অথবা চলিত বাংলায় কিছুটা রূপ পরিবর্তন করেছে। যেমন সহিত> সঙ্গে, সমীপে>কাছে বা নিকট প্রভৃতি।
ii. তদ্ভব বা বিবর্তিত অনুসর্গ: যে সমস্ত অনুসর্গ সংস্কৃত থেকে পরিবর্তনের ধারায় বাংলায় এসেছে, তাকে তদ্ভব বা বিবর্তিত অনুসর্গ বলে। যেমন- আগে, কাছে, কাজে, চেয়ে, ছাড়া, পাশে, পানে, তরে, বই, বিনা, ভেতর, মাঝে, সাথে, তরে ইত্যাদি।
এদের সম্পর্কে দুটি বক্তব্য:
ক। এই অনুসর্গগুলি সংস্কৃত থেকে বিবর্তনের ধারায় বাংলায় এসেছে।
যেমন- সন্ন> সনে, সার্থ>সাথে, মধ্য > মাঝে, অগ্র>আগে, কক্ষ >কাছে, অন্তরে> তরে। এছাড়াও সংস্কৃত অনুসর্গগুলি উচ্চারণগত ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন সমার্থক শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন- লগে >সঙ্গে অগ্রে> আগে।
খ। পানে, লগে, তরে প্রভৃতি অনুসর্গগুলি শুধু কবিতায় ব্যবহৃত হত। এখন তাও হয় না।
iii. বিদেশি অনুসর্গ: যে সমস্ত অনুসর্গ বিদেশ থেকে এসে বাংলায় গৃহীত হয়েছে, তাদেরই বিদেশি অনুসর্গ বলে।
উল্লেখ্য, বিদেশি অনুসর্গ সাধারণত ফারসি অনুসর্গকেই ধরা হয়।
যেমন- দরুণ, বদলে, বনাম, বাদে, বাবদ, বরাবর।
"হুজুর" নামক ফারসি অনুসর্গটি সমীপে বা নিকটে অর্থে ব্যবহৃত হলেও চলিত বাংলায় প্রয়োগ নেই।
আরো কিছু শব্দজাত অনুসর্গ: অভিমুখে, অবধি, কাছে, পর্যন্ত, বাইরে, মাঝে, তলে, তলায়, উদ্দেশ্যে, প্রতি, মারফত, সম্মুখে, মতন প্রভৃতি।
২। ক্রিয়াজাত অনুসর্গ:
ক্রিয়া থেকে তৈরি অনুসর্গগুলিকেই ক্রিয়াজাত অনুসর্গ বলে।
সংক্ষিপ্ত লিস্ট- থেকে, দিয়ে, করে, বলে( জন্য), নিয়ে প্রভৃতি। এই অনুসর্গগুলি সমস্তই অসমাপিকা ক্রিয়াজাত।
দুই, গঠন অনুসারে অনুসর্গকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
i. বিভক্তিহীন অনুসর্গ ও ii. বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ।
i, বিভক্তিহীন অনুসর্গ-
গঠনগত ভাবে যে অনুসর্গগুলি বিভক্তিহীন, তাকে বিভক্তিহীন অনুসর্গ বলে। যেমন- অপেক্ষা, কর্তৃক, পর্যন্ত, অবধি, প্রতি, মতন, বনাম প্রভৃতি।
ii, বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ: যে অনুসর্গে বিভক্তি যুক্ত করা যায়, তাকে বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ বলে।
শব্দজাত অনুসর্গে সাধারণত "এ" বিভক্তি যুক্ত করা হয়। যেমন- নিচে - নিচ + এ, ওপরে- ওপর+ এ, এভাবে কাছে, পাশে, বাইরে, ভেতরে, সাথে, সামনে, পেছনে প্রভৃতি।
তবে "তলায়" অনুসর্গে "য়" বিভক্তি রয়েছে।
বিভক্তিযুক্ত অনুসর্গ বিভক্তি ছাড়াও ব্যবহৃত হয় যেমন- ওপর / ওপরে। পাশ / পাশে। জন্য / জন্যে প্রভৃতি।
ক্রিয়াজাত অনুসর্গগুলি "এ" বিভক্তিযুক্ত। যেমন- করে, বলে প্রভৃতি। তবে ক্রিয়াজাত অনুসর্গগুলি "এ" বিভক্তি ছাড়া অনুসর্গ রূপে ব্যবহৃত হতে পারে না।
তিন, সম্পর্ক স্থাপনের পার্থক্য অনুসারে অনুসর্গের শ্রেণিভাগ:
সম্পর্ক স্থাপনের পার্থক্য অনুসারে অনুসর্গকে দু ভাগে ভাগ করা হয়।
i, কারক সম্পর্কবাচক অনুসর্গ।
ii, কারক সম্পর্কহীন অনুসর্গ। i, কারক সম্পর্কবাচক অনুসর্গ- যে অনুসর্গ কারক সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য বাক্যে বিভক্তির মতো কাজ করে, তাকে কারক সম্পর্কবাচক অনুসর্গ বলে।
যেমন- দ্বারা, দিয়ে, কর্তৃক, হতে, থেকে, চেয়ে, জন্য অপেক্ষা, নিমিত্ত, উদ্দেশ্য।
ii, কারক সম্পর্কহীন অনুসর্গ- যে অনুসর্গ কারক সম্পর্ক ছাড়াই বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে অন্যান্য পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে কারক সম্পর্কহীন অনুসর্গ বলে।
যেমন- নিচে, ওপরে, পাশে বদল, সামনে, নিকট প্রভৃতি।
মোটকথা, কারক সম্পর্কযুক্ত অনুসর্গ বাদে বাকি সবগুলোই এই শ্রেণিতে পড়ে।
অনুসর্গের বৈশিষ্ট্য:
১। অনুসর্গ বাক্যে কারক- সম্পর্ক বা অন্যান্য পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে।
২। অনুসর্গ মূলত বিভক্তিরই কাজ করে।
৩। অনুসর্গ সাধারণত শব্দের পরে বসে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে আগে বসে। যেমন "বিনা" কারণে কেন অ্যারেস্ট করা হল?
৪। অনুসর্গ বিভক্তিযুক্ত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
৫। শব্দের পরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বা স্বতন্ত্রভাবে থাকে।
৬। অনুসর্গের নিজস্ব অর্থও রয়েছে।
৭। শব্দে বিভক্তি যুক্ত হওয়ার পরও অনুসর্গ যুক্ত হতে পারে।
৮। অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ থাকায় অনেক সময় অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
যেমন- তুমি "ছাড়া"( অনুসর্গ) হবে না।
কিন্তু হাত "ছাড়া"( ক্রিয়ার অংশ) হয়ে গেল চোরটি।
তবে এই দুটো "ছাড়া"র উৎস এক কিনা সন্দেহ!
অনুসর্গের বিচিত্র প্রয়োগ:
i. অনুসর্গের দ্বিত্ব প্রয়োগ
দিকে দিকে
কাছে কাছে
পাশে পাশে
সঙ্গে সঙ্গে
নিচে নিচে
ii একাধিক অনুসর্গের পাশাপাশি প্রয়োগ:
নিচ থেকে
উপর হতে
বাইরে হতে
ভেতর দিয়ে
সঙ্গে সঙ্গে পাশে পাশে
iii. বিভক্তি ও অনুসর্গের পাশাপাশি প্রয়োগ:
দের দিয়ে- তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না।
কে দিয়ে- তোকে দিয়েই করাব।
এর থেকে- নিচের থেকে নিয়ে এসো।
মনে রাখতে হবে, অনুসর্গও একপ্রকার সংযোজকেরই কাজ করে।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
2 Comments
সুন্দর!খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteএইটা লিখছেন তো,বইটা কবে নাগাদ বের হতে পারে যদি বলেন!!!
2021 এ বেরোবে আশা করছি
Delete