জ্বলদর্চি

গুচ্ছ ছন্দ কবিতা/ তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

গুচ্ছ ছন্দ কবিতা
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

অনঙ্গ অঙ্গনা

১.
শ্বাসরোধী শাসকের বিস্মৃত সন্ধি-
অন্দরে অন্তরা এখনো তো বন্দি!
নাশ হোক নাশকতা মনে মনে ইচ্ছে,
এমনই ইচ্ছে আরো অশান্তি দিচ্ছে।
মন্ত্রের মন্ত্রণা অনেক অনন্ত,
যন্ত্রের যন্ত্রণা বড় ষড়যন্ত্র।
মন্দিরে মন্দিরা, বন্দনা, ক্রন্দন,
ধর্মে পূরণ করো ছিন্ন এ বন্ধন।
বৃষ্টিরা থেমে গেছে, সৃষ্টিরা বন্ধা,
ঘূর্ণির তেজে ঝরেছে রজনীগন্ধা।
দিন নয় দুর্দিন, বাকি কালরাত্রি,
লজ্জিত, রক্তিম, বিরক্ত যাত্রী।
ঘুম নেই, চুম নেই, যেন গতিরুদ্ধ-
বসন্ত বুকে নিয়ে হতে হবে শুদ্ধ।
মরুতে বিলীন নদী নিয়ে আয় বন্যা,
প্রেম নাই, প্রেম চাই- ভাবনায় কন্যা।

.
যেমনটা চায় মন, স্বপ্নয় অঙ্কন,
বেনারসি শাড়ি দাও, নূপুর আর কঙ্কন।
ঠোঁটে শয়তানি, চোখে কামনা এ রমণীর,
হৃৎস্পন্দন বেড়ে কাঁপ শিরা-ধমনীর।
সমীরণে খুনসুটি, উড়ে যায় আবরণ,
বক্ষের উঁচ-নীচে বিক্ষত নিউরোন।
সুনামির ঊর্মিরা নৃত্যে পাগলপ্রায়,
উন্নত পৌরুষ ভাঙে এক ধাক্কায়।
আয়নায় অনুভব পিঠ উন্মুক্ত,
নাভির গভীরে নাকে নেশা এসে ঢুকত-
যদি না দীপ্তি এসে পড়ত অজান্তেই,
মসৃণ যৌবন যেত শেষপ্রান্তেই।
শুক্রের বিক্রম, স্রোতে মাৎসর্য,
নিমেষেই কোমলতা হতো পরিহার্য।
অসময়ে শ্লথ হয় যৌনতা বন্য,
নিমগ্ন মন থেকে নগ্নতা শূন্য।

৩.
শোনো মেয়ে তুমি যেন সাহসিনী হয়োনা,
সুবাসিত কেশদামে উষ্ণীষ ছুঁয়োনা।
শুনেছি উপার্জন এভাবেই গণিকার,
রমণী, রমণ জানি সাময়িক, ক্ষণিকার।
স্নানে যেও সাবধানে, ঢাকা দিও অঙ্গে,
আমি যে গ্রামের ছেলে পশ্চিমবঙ্গে।
সাজাব তোমায় আমি অন্য অনন্যায়,
যখন যেমন খুশি যদি ভাব অন্যায়!-
তবে বলি এস তুমি তোমার পছন্দেয়,
প্রেম দেব, প্রেম দিও- দিন ভাল-মন্দেয়।
জুঁই দেব, পুঁই দেব, পিঁড়ি এক চৌকো,
গান দেব, ধান দেব, পালতোলা নৌকো।
একবাটি দুধ, মাছভাতে আলুপোস্তো,
কম কম পেয়ে বেঁচে হৃদয় প্রশস্ত।
রুপায়িত হয়োনাগো বেমানান অরূপে,
সেই রূপই নিও যা সে যায় স্বীয় স্বরূপে।


লুপ্ত লাবণ্য

১.
বৈধ লাগামে লেগে থেকে থেকে ক্লান্ত,
উল্কিতে চুমু দিয়ে ক্ষিপ্রতা ম্লান তো!
অশ্লীল লিপ্সায় লালায়িত লগ্ন,
কল্মষ হিল্লোলে ইন্দ্রিয় মগ্ন।
প্রেম জ্বলে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলকিত উল্কায়,
সুললিত লাস্যেই যৌবন চুলকায়।
ছলভরা কলসিতে ঢিল ছুঁড়ে খোলতাই,
দিলখোলা হয়েছিল, ভেবেছিলো ফুল, -তাই।

২.
কোল ছেড়ে ভালোবাসা ভুল পথে লুপ্ত,
ভালো হত ফুলমালা রাখা হলে গুপ্ত।
কলকে আলোয় এলে দোষারোপ কূল-কে,
তেল নেই সলতেয়, কম পড়ে শুল্কে।
কলুষিত হলে হত কল্পিত গল্পে,
কালো দাগ ফেলা যেত আলগোছে, অল্পে।
আলতার আলপনা জলে ঠিক গুলতো,
লোকালয়ে জল্পনা যতো লয়ে খুলত।

৩.
শ্যাওলায় দেহ ঢাকে অবৈধ শয্যায়,
আলনার আড়ালেতে লালমুখ লজ্জায়।
বালিয়াড়ি লাগে যেন লৌকিক জঙ্গল,
শীতল শিউলি দাও দোয়েল-এর দঙ্গল।
কলমিতে সুখ ছিল, লাভে গলগণ্ড,
লোভনীয় ইল্লতে খেলাঘর পণ্ড।

বিরহ-বিহার

দৃশ্যরা একই, রোজই যেমনটা দেখি, প্রজাপতি-ফুলে আহ্লাদী শৈলী-
অসহায় দ্রৌপদী, আসে কই মন অবধি! আক্রম হিমায়িত রইলি!
দৃষ্টিতে আসে- হাসে- কেউ চুপ ত্রাসে,- যেন স্বাভাবিক অনাবিল অভিনয়-
শপথেরা মেকী, পথে ফিরবেনা সেকি! চেতনায় ফিরে পুনরায় তন্ময়।
পরিপাটি খালি পায়, মাটি ছুঁই মন চায়, আবরণ সাধারণ সজ্জায়,
দেখেও না দেখা যারা, কি আদরে টেনে ধরা! অহমিকা বিহ্বল লজ্জায়।
যদি কেড়ে নেবে,- তবে দাও কিবা ভেবে! দেবতার প্রতি রোজ রোজ বিস্ময়,
যথেষ্ট সান্ত্বনা, তবু মন মানতোনা, জানতোনা প্রেম নির্বিষ নয়।
ঘুমে প্রচণ্ড রাগী, দিনোমানে বৈরাগী,- পছন্দ নয় মধুছন্দা,
ক্ষমায় কমে প্রকোপ, লঘু তাই দোষারোপ, রুপে তার ধীরে ধীরে সন্ধ্যা।
দায়িত্ববোধ যত, হঠাৎই মনের মত, মুক্তির স্বাদে যেই ব্রাত্য-
সত্যি সে প্রেম হলে, বিরোধে উঠত জ্বলে, অনুভব হল এইমাত্র।
সম্পর্কের ঢেউ, এ মনে অন্য কেউ! সময় দিওগো হতে সুস্থ,
প্রতারিত হলে ফের, সে আঘাত সহ্যের, ক্ষমতা শূন্য, অতি দুঃস্থ।
প্রথমা কৃতঘ্ন, দ্বিতীয়া কি তীক্ষ্ণ?- বেশিটাই সমঝোতা হয়তো!
বিতর্কে ঢলে মাস, সতর্ক থ্যালামাস, এমনই শাস্তি হবে নয়তো।
যদি যত সংশয়, এক্ষুনি দূর হয়, বেশ হতো এলে দূরদর্শী,
সকলের অগোচরে, অনেক ভেজার পরে, হাওয়া দিয়ে গেল সাড়া স্পর্শী।
“বিধবা-বিপত্নীক, ধ্বংসের পথ নিক, যদি বলো বেঁচে থাকা কষ্ট-
সাজুগুজু সেঁজুতি, প্রায় নিভে ঋজু ঠিক,-খুশি কেন এক অশিবে নষ্ট?
প্রেমের প্রণালিটির আর্তি ফেরায় তীর, মোহনাতে মোহের আরোগ্য-
হিল্লোলে হিল্লোলে নদী বারবার বলে,- “বিরহ-বিহারও উপভোগ্য।”


বাদুড়ঝোলা

শব শোয়ানো বাঁশের মাচায়, বাঁশের ওপর আঁকা
‘মদত দিলেন মদন তেলি- মদের ঠেকের কাকা’।
প্রবাদপ্রতিম প্রতিমা তাঁর বাপের বাড়ি এলে
 মহিষাসুর লেলান মিছেই কুমোরটুলির লেলে।
হড়কে খেঁদা খেঁদির ওপর, কে দেখে দোষ গাড়ির?
হাল ফ্যাশনের খিস্তি খেউর সুশিক্ষিতা নারীর।
তোর বাগানের আম ঝেড়ে ফের তোকেই যখন বেচা
বাগিয়ে কোঁচা রোজ সকালে যত পারিস চেঁচা।
অনুকৃত ছায়াছবি, ভুরুর ভাঁজে টাকা?
গৌরী সেনের পরম্পরা ঠিকই নেবেন ঠেকা।
পণের ঠেলায় স্বর্গাভিমুখ, কৃপণ শ্বশুর হাসে
বোঝালো সে এমন জীবন নিতেই ভালবাসে।
চাষ করা সব অযোগ্যরাই আস্কারা পায় মাসে
সংরক্ষণ মাত্রাছাড়ায় অসম উল্লাসে।
খরার পরে বৃষ্টির জল এক গেলাসে খাওয়ায়
ধর্মযাজক আঁচর কাটেন জাতের দাবিদাওয়ায়।
শাসক-শোষক পৃষ্ঠপোষক তোষক চাপা অস্ত্রে
ভোট না দিতেই কুল দুলালী দুলছিল বিবস্ত্রে।
ধর্ষণই যার শখের বরাত অবকাশের ভুলে
তার নেতা বাপ শাঁখের করাত কারার কপাট খুলে -
দাঁত দেখিয়ে ফেরেন বিজয়-সুখেরই খয়রাতে,
রাজ্য পুলিস পেট খুলে শোয় ঘুষমন্ত্রের রাতে।
আড়ৎ বাঁটে আঁশবঁটিতে মাছ নয়তো মাদক 
সাধ করে স্বাদ, অসাধ্য বাদ খাদ্য থেকে খাদক।
গুহ্যদেশে বম খেয়ে খুন স্তন্যপায়ী প্রাণী
গুলতি লুকায়, গুল মেরে যায় পড়শি দেশের রানী।


প্রতর্ক্য

ব্যর্থ প্রেমের চিঠি, নতুন গেলাস-বাটি ঝেঁপে শিক্ষক কেটে পড়লে,
ও মাসের মাইনে তো দেওয়া হয়েছিলো তবু কেন ছোঁড়া এমনটা করলে!
বাড়ন্ত বাচ্চার হাঁয়ে বিড়ি বিরিয়ানি, আশা নেই ডিম্বে বা শিম্বে?
আকাশে শকুনি কটা গুণে নেয় ওরা নাকি টাকে ফুটে ওঠা প্রতিবিম্বে।
নিরামিষ আঘাতেই নাস্যাৎ নাসিকার ডগে বসা মশাটার স্ফূর্তি,
এ বারের বর্ষায় ফ্ল্যাটবাড়ি গলে জল না হতেই দু-বছর পূর্তি।
আমি বলি, তুমি বলো, ওরা বলে, বলে বলে ছলে-বলে হতবাক দুর্বল,
তারপরে খোঁজ শুরু কে শুনেছে কার কথা, সেই নিয়ে পুনরায় শোরগোল।
ভীত যত গোবেচারা মানুষের সারি থেকে এসেছিলো যে পা দুটো সামনে,
সে পা দুটো নেই তার, পোড়া ঘরে হাহাকার - পারিসতো কান্নারও দাম নে।
অগা-বগা ডাক্তার দেখিয়ে দেখিয়ে হল সামান্য ব্যাধি দুরারোগ্য,
নিজের ও নিজেকে ছাড়া যে সাজায় অন্যকে, প্রত্যাশা তারই কাছে যোগ্য।
আমি নই তুমি, ফের ‘তুমি’ ঘুরে অন্যতে, দোষারোপ এগুলেই ঠোক্কর,
সুন্দরী বউ দেখে টপাটপ চোখ মারে আজকালকার যত ফক্কড়।
পাঁচতারা তাড়া করে আঁখিতারা শেষে স্থির রাস্তায় - ফুচকা বা ঘুগনি,
কাজ নেই, লাজ নেই, গোলমতো মুখ নিয়ে ঘরে বসে বড় বড় বুকনি।
কেন হয়, কিসে হয়, কি উপায়, অসহায় ভেবে বসে যেই মাথা কুটকুট,
ডাকা তো হয়নি তবু কার পোষা ষাঁড় এসে দুয়ারে গোবর করে মাঠছুট!

পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments