জ্বলদর্চি

ভুটানের লোকগল্প (বুড়ো ঠাকুরদার বুদ্ধি )/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প -- ভুটান 
বুড়ো ঠাকুরদার বুদ্ধি 


চিন্ময় দাশ 

ভাঙবো বটে, কিন্তু আমি মচকাবো না। 
হোক না কঠিন নিড়ানির কাজ, 
কিছুতেই তা ছাড়বো না।
কাজ না সেরে থামবো না...
ক্ষেতের মাটি তৈরী করছে, আর নিজের মনে বিড়বিড় করে ছড়া কাটছে একটা বুড়োমানুষ।
বুড়ো মানে, একেবারেই বুড়ো। এমনই জিরজিরে শরীর, হাড়-পাঁজরা গুণে নেওয়া যায় এক এক করে। ল্যাকপেকে বেঁকে যাওয়া দু'খানা পা, গুলি আছে কি নেই, বোঝাই যায় না, কোন রকমে ধরে রেখেছে তার শরীরটাকে।
  ওয়াং ছু (বাংলায় যে নদীর নাম-- রায়ডাক) নদীর মোহনায় আর এক নদী-- পারো ছু। সেই পারো ছুয়ের উজানে, যেখানে বাম দিক থেকে হা ছু এসে মিশেছে, সেখানেই গ্রাম এই বুড়োর।
  উলুঝুলু চেহারা, কিন্তু গাঁয়ের মানুষজন ভারী ভালোবাসে বুড়োটাকে। হাতে গোনা যায়, কয়েক গাছা মাত্র চুল তার থুতনিতে। অনেকটা বুড়ি ছাগলের দাড়ির মত। যেখানে যখনই লোকজনের জমায়েত, সেখানে দেখা যায় তাকে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে, আর দাড়ি চুলকাচ্ছে। না-ই বা হল সে গাঁয়ের মোড়ল, তাকে কিন্তু মান্য করে সবাই। 
  দুনিয়ায় কিছুই নাই তার। এমনকি, একটা ইয়াক গাইও নাই মানুষটার। থাকবার মধ্যে এক ফালি পতিত জমি শুধু। পাঁচজনের দয়ার দানে বেঁচে আছে বুড়োটা। 
  একে তো এই বয়স, তাতে মাথার উপর এই রোদ। নিড়ানি নিয়ে কাজ করছে, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। হঠাৎই শক্ত মতন কিছু একটা ঠাওর হল নিড়ানির মাথায়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখা গেল, একটা গাছের গুঁড়ি। আরে, ক্ষেতের একেবারে মাঝখানটিতে এই বেখাপ্পা জিনিসটা উদয় হোল কোথা থেকে! কি করা যায়, কী করা যায়? তার বিখ্যাত ছাগল-দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগল সে।
না, না। তুলেই ফেলতে হবে এটাকে। বাজরা বুনতে হবে ক্ষেতে। মাঝখানে এমন একটা বেখাপ্পা জিনিস রাখা যায় নাকি? 
  পাথুরে মাটি। একটু একটু করে খুঁড়ে চলল বুড়ো।  কোনো মতেই ছাড়া চলবে না একে। ঘাম ঝরছে সারা মুখ বেয়ে। কাজের কিন্তু বিরাম নাই। ঢলতে ঢলতে সূর্য যখন একেবারে পিছনের টিলাটার মাথায় গিয়ে ঠেকল, কাজ শেষ হল বুড়োর। শরীরের সব জোর এক করে, একটা হ্যাঁচকা টান লাগাতে, উপড়ে এল গুঁড়িটা। 
  অমনি চোখ কপালে উঠে গেল তার। এ কী দেখছে সে! গর্তটার ভিতরে চকচকে কী একটা বস্তু। দেখতে অনেকটা ছোট গোল থালার মত। শেষমেশ তুলেই ফেলল জিনিসটা। ফিরোজা (সবজে নীল) রঙ পাথরটার। সেটা আসলে একটা নীলকান্ত মণি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না মানুষটার। এতো বছরের জীবনে এমন জিনিস কখনো দেখেনি সে। কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল জিনিসটার দিকে।

চমক কেটে যেতেই, চেঁচিয়ে উঠল সে-- বড়লোক, অনেক বড়লোক হয়ে গেছি আমি। আর আমার গতরে খাটতে হবে না। হাত পাততেও  হবে না আর কারোও কাছে। এটা বিক্রি করলেই, অনেক টাকা পেয়ে যাবো আমি।
আনন্দে নাচতে নাচতে ঘরে ফিরে এল বুড়ো। সেদিন রাতে ঘুম হল না ভালো করে। সকালে হতেই মণি নিয়ে বাজারে রওনা দিল সে। 
যেতে যেতে একজনের সাথে দেখা। ঘোড়া থামিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল-- কী ঠাকুরদা, কোথায় চললে?
-- রাখো তোমার ঠাকুরদা। হয়েছে কী, সেইটা শোনো। বুড়োর যেন ধৈর্য ধরে না। বলল-- নিড়াচ্ছিলাম ক্ষেতের মাটি। নিড়ানি ঠেকল এক মরা গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি উপড়ে পেয়ে গেলাম এই দামী পাথর। হাটে যাচ্ছি এটা বেচব বলে, তোমার সাথে দেখা। তা, তোমার ঘোড়া আমাকে দিয়ে, তুমি কি এটা নিতে চাও?
  লোকটা তো পড়ল আকাশ থেকে। বলে কী মানুষটা? সামান্য একটা ঘোড়ার বদলে, অত দামি মণিটা দিয়ে দেবে! সে এক কথায় রাজী। কথা না বাড়িয়ে, ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে, লাগামটা বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিল। মণি নিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল ফিরতি পথে ঘরমুখো হয়ে। বলা যায় না, বুড়ো যদি মন বদলে ফেলে।
  বুড়ো কিন্তু টগবগ খুশি। ওইটুকুন একটা পাথর! তার বদলে কি না, অত বড় একটা ঘোড়া। কী ভাগ্যি, কী ভাগ্যি।
  ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটছে বুড়ো। আবার একজনের সাথে দেখা। একটা বলদ নিয়ে হাটে  যাচ্ছে লোকটা। লোকটা বলল-- কীগো, ঠাকুরদা! কোথায় চললে?
ঠাকুরদার সেই একই কথা-- রাখো তোমার ঠাকুরদা ডাক। বলছি কী, সেইটা শোনো। নিড়াচ্ছিলাম ক্ষেতের মাটি। নিড়ানি ঠেকল এক মরা গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি উপড়ে পেয়ে গেলাম একটা দামী পাথর। হাটে যাচ্ছি সেটা বেচব বলে, একজনের সাথে দেখা। তাকে পাথরটা দিয়ে এই ঘোড়াটা পেয়েছি। তা, তোমার এই বলদটা আমাকে দিয়ে, তুমি কি ঘোড়াটা নিতে চাও?
লোকটার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তার এই হাড় জিরজিরে একটা বলদের বদলে, এমন টগবগে একটা ঘোড়া পাওয়া যাবে? সাথে সাথে, বলদটা বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, চটপট ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল লোকটা।
বলদ নিয়ে বাজারের পথে চলেছে বুড়ো। আবার একজনের সাথে দেখা। নিজের একটা ভেড়া বেচবে বলে হাটে যাচ্ছে সে। লোকটা বুড়োকে বলল-- কিগো, ঠাকুরদা! বাজারে চললে না কি?
  বুড়ো তাকেও বলল-- রাখো তোমার ঠাকুরদা ডাক। কী বলছি, শোন। নিড়াচ্ছিলাম ক্ষেতের মাটি। নিড়ানি ঠেকল এক মরা গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি উপড়ে পেয়ে গেলাম একটা দামী পাথর। হাটে যাচ্ছি সেটা বেচব বলে, একজনের সাথে দেখা। তাকে পাথরটা দিয়ে একটা ঘোড়া পেয়েছিলাম। তার পর সেই ঘোড়া একজনকে দিয়ে, এই বলদটা পেয়েছি। তা, তোমার এই ভেড়াটা আমাকে দিয়ে, তুমি কি বলদটা নিতে চাও?
  লোকটা তো চমকে গেল এমন কথা শুনে। একটা ভেড়ার বদলে, আস্ত একটা বলদ পাওয়া যাবে? ভারী খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল। বুড়োর হাতে ভেড়ার দড়ি ধরিয়ে দিয়ে, বলদ নিয়ে হনহন করে বাড়ির ফিরতি পথ ধরল সে।
  বুড়ো হাটে চলেছে। সাথে নতুন পাওয়া একটা ভেড়া। ব্যা-ব্যা করতে করতে নতুন মালিকের পেছন পেছন চলেছে সেটাও।
একটা মোরগ বগলদাবা করে হাটে যাচ্ছিল একজন। বুড়োকে দেখে বলল-- কেমন আছো, ঠাকুরদা?
বুড়োর সেই একই কথা-- রাখো তোমার ঠাকুরদা ডাক। কী বলছি, শোন। নিড়াচ্ছিলাম ক্ষেতের মাটি। নিড়ানি ঠেকল এক মরা গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি উপড়ে পেয়ে গেলাম একটা দামী পাথর। হাটে যাচ্ছি সেটা বেচব বলে, একজনের সাথে দেখা। তাকে পাথরটা দিয়ে একটা ঘোড়া পেয়েছিলাম। তার পর সেই ঘোড়া একজনকে দিয়ে, তার বলদটা নিয়েছিলাম। সেই বলদ একজনকে দিয়ে, এই ভেড়াটা পেয়েছি। বলছি কী, তোমার এই মোরগটা আমাকে দিয়ে, তুমি কি ভেড়াটা নিতে চাও?

  প্রথমে তো বিশ্বাসই হল না লোকটার। বলে কী, বুড়ো! এই বুড়ো মোরগটা নিয়ে, ভেড়াটা দিয়ে দেবে? এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না কি? সাথে সাথেই অদল বদলে রাজি হয়ে গেল সে। মোরগ দিয়ে, ভেড়া নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ির পথ ধরল। 
মোরগ নিয়ে, হাটে চলেছে বুড়ো। মাঝে মাঝেই চেয়ে চেয়ে দেখছে বগলের পাখিটাকে। আহা, লেজের কী বাহার! আর, ঝুঁটিখানাও কী বাহারি! যেমন টকটকে লাল রঙ, তেমনি নক্সাকাটা।
হঠাৎই ভালো লাগার ঘোর কেটে গেল বুড়োর। পথের ধারে বসে গান গাইছিল একটা লোক। সুর কানে যেতেই বুড়োর পা থেমে গেল। বুড়ো  থামতেই, গানও থেমে গেল। লোকটা বলল-- আরে, ঠাকুরদা যে! আছো কেমন?
  কথার উত্তর না দিয়ে, ফ্যাল-ফ্যাল করে লোকটার দিকে চেয়ে রইল বুড়ো। একেবারে উলুঝুলু চেহারা এই লোকেরও। সেটা গ্রাহ্যই করল না বুড়ো। অবাক হয়ে ভাবতে লাগল-- কী করে, অমন মিষ্টি সুর বেরোয় মানুষটার গলা দিয়ে।
 নিজের স্বভাবে এবারও বলল--  রাখো তোমার ঠাকুরদার খোঁজ-খবর। আমি কী বলছি, সেটা শোন। গতকালের কথা। হয়েছে কী, নিড়াচ্ছিলাম ক্ষেতের মাটি। নিড়ানি ঠেকল এক মরা গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি উপড়ে, পেয়ে গেলাম একটা দামী পাথর। হাটে যাচ্ছি সেটা বেচব বলে, একজনের সাথে দেখা। তাকে পাথরটা দিয়ে, একটা ঘোড়া পেয়েছিলাম। তার পর সেই ঘোড়া একজনকে দিয়ে, তার বলদটা নিয়েছিলাম। সেই বলদ একজনকে দিয়ে, পেলাম একটা ভেড়া। একটু আগে একজনকে ভেড়াটা দিয়ে, এই মোরগটা পেয়েছি। বলছি কী, এখন আমার এই মোরগটা তোমাকে দিতে চাই আমি। তার বদলে ...
লোকটা বলল-- দাঁড়াও, দাঁড়াও। মোরগের বদলে তোমাকে দেবোটা কী আমি? আছে কী আমার? রাস্তার ধারে বসে গান গাই। লোকে দু-চার পয়সা দিয়ে যায়। তাতেই আমার পেট চলে।
  বুড়ো ভারী খুশি। বলল-- আরে, ওই গানটাই তো চাইছি আমি। মোরগটা দিলাম তোমাকে। তার বদলে, আমাকে গান শিখিয়ে দাও তুমি। এই বলে, লোকটার কাছে গান শিখতে বসে গেল বুড়ো। আনন্দে সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।
  গান শেখা শেষ হল। মোরগ রেখে দিয়ে, উঠে পড়ল বুড়ো। মনে এখন ভারী আনন্দ। আর বিড়বিড় করে ছড়া কাটা নয়। খালি হাতে, গুন্ গুন্ করে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে চলল বুড়ো।
এজন্যই, আজও কারও বোকামি দেখলে, পাহাড়ের লোকেরা বলে থাকে-- "আরে ভাই, তুমিও তো বুড়ো ঠাকুরদার ব্যবসা শিখে ফেলেছ, দেখছি।"

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments