Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
বিমল মণ্ডল
পর্ব-১৭ /তৃতীয় অধ্যায়
রূপতত্ত্ব (Morphology)
১১.সর্বনামজাত বিশেষণ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় মান্যচলিত বাংলাভাষার মতো সর্বনামজাত বিশেষণের প্রয়োগ রয়েছে। তবে এই সর্বনামজাত বিশেষণ গুলি তুলে ধরছি যা মান্যচলিত থেকে সামান্য আলাদা। যেমন-
১.দেশবাচক সর্বনামজাত বিশেষণ— কাই, কুন্ ঠি, সেঠি, সেটি, সৌঠি, শউটি, এইঠি, এঠি, জেঠিটা, জেইঠি ইত্যাদি।
২.সময় বাচক সর্বনামজাত বিশেষণ —জখঁ, তখঁ, এখঁ, কখঁ, অখুনি, তোখুনি, কিমা, কুমা যুমা, সুমা ইত্যাদি।
৩.পরিমাণবাচক সর্বনামজাত বিশেষণ— কদ্ গা, অদ্ গা, যত্ গা, ততগুয়া, অতগুয়া, কতগুয়া, অত্তো, কত্তো ইত্যাদি।
৪.সাদৃশ্যবাচক সর্বনামজাত বিশেষণ — জেমনি, তেমনি, যুমা-সুমা, যৌঠি -সৌঠি,যতবা -ততবা ইত্যাদি।
১২. ক্রিয়া বিশেষণ
এই জেলার কথ্যভাষায় চালু বাংলার মতো বেশ কিছু নতুন নতুন ক্রিয়া বিশেষণ ব্যবহার হয়। যেমন—
i. পঁক (তাড়াতাড়ি বা দ্রুত অর্থে ) — নোকানু লোকটা পঁক কইয়া আইলো আবার পঁক করিয়া পালিলো। (নৌকা থেকে লোকটা তাড়াতাড়ি এলো আবার তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল।)
ii. ঢপ (তাড়াতাড়ি অর্থে) —তারুরে মেইঝিটা ঘরে ঢুকি যায়্যা ঢপ করিয়া মরিয়ালো। (তার ঘরের মেয়েটা ঘরে ঢুকে গিয়ে তাড়াতাড়ি মরে গেল।)
iii.গপ্ (তাড়াতাড়ি অর্থে) — তুই মাছ ভাজাটা গপ্ করিয়া খাইলিলু?(তুই মাছভাজা তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নিলি?)
iv.থপথপ(আস্তে আস্তে অর্থে)— নৌকাটা থপথপ করিয়া যাইটে কেনিরে? (নৌকাটা এতো আস্তে আস্তে যাচ্ছে কেন?)
v.গড়িয়া গড়িয়া (আস্তে আস্তে অর্থে) - তোকে কি কইবা তুই তো গড়িয়া গড়িয়া কাজ করু। (তোকে কি আর বলবো তুই তো ধীরে ধীরে কাজ করিস।)
১২. লিঙ্গ
চলিত বাংলার মতো এই জেলায় কথ্যভাষায় তিন প্রকার লিঙ্গের ব্যবহার রয়েছে। তবে চলিত বাংলা ভাষার মতো এখানেও এই লিঙ্গ অর্থ নির্ভর। যেমন-
১২.১ পুংলিঙ্গ
i.পূর্বমেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষা যে পুরুষবাচক লিঙ্গের ব্যবহার দেখা যায় তা সাধারণত আ বা অ্যা প্রত্যয় যোগে। যেমন- টকা(ছেলে), কটিয়্যা(ছেলে), কোচিয়া( ছেলে), বেটা(পুত্র), কুত্ তা (কুকুর), খুড়া (কাকু),নানা(মাতামহ) , ফুফা (পিশে) , ভাগ্ না (ভাগিনা) , বুড়া (বৃদ্ধ), প্যাসা (পিশে মশাই), মাউশা (মেশো) ,ছোঁড়া (বালক),ছুড়া (যুবক),পুত্রা(ভাইপো), বায়া (ছেলে), শালা (স্ত্রীর ভাই) ইত্যাদি।
ii. এই জেলার কথ্যভাষায় পুরুষবাচক শব্দে 'জামি'যোগ করেও পুংলিঙ্গের রূপ গঠিত হয় । যেমন-কচিজামি(ছোট জামাই), ভাগনীজামি(ভাগ্নিজামাই), ঘরজামি (ঘরে থাকে যে জামাই),লাতিজামি (নাত জামাই), ঝিয়ারিজামি( ভাইঝি জামাই) ইত্যাদি।
iii.এছাড়া এই জেলার পুলিঙ্গ কিছু আলাদা শব্দ ব্যবহার হয়। যেমন- ভেঁই(বোন বা দাদার বর), বেই(মেয়ে বা ছেলের বাবাকে বোঝায়) ,নানা (মায়ের বাবা),মাউশা (মেশো), প্যাসা (পিসেমশাই), আজা (মায়ের বাবা), আইবুড়া (আইবুড়ো), ভাতার (স্বামী) , নাং (পরপুরুষ) ইত্যাদি।
১২.২ স্ত্রীলিঙ্গ
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় কিছু স্ত্রীলিঙ্গ বাচক প্রত্যয় ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
i.'ই' প্রত্যয় যোগে-
বেটি(মেয়ে) , মেইঝি(মেয়ে) নানি(মায়ের মা), চাচি(কাকি মা) , খুড়ি(কাকি মা) জেঠি(জেঠাইমা), দাদি(মার মা), কাকি, ছেই (ছাগল), ভেঁড়ি(মেয়ে ভেঁড়া), ঝউড়ি(মেয়ে), শাউড়ি( শাশুড়ী) , বউড়ি (ঘরের বউ), পেসি (পিসি),বইদি(বৌদি),ঝিয়ারি (ভাই ঝি) ইত্যাদি।
ii.'আন' বা 'আনি প্রত্যয় যোগে-
বিয়ান (ছেলে বা মেয়ের মা), বেয়ানি (মেয়ে) , নজরানি(যে নজর দেয়),নজরানা (নজর যে রাখে) , মালকিনি(মালিকের বৌ) ইত্যাদি।
iii.' ইন'বা 'ঈনী' প্রত্যয় যোগে -
বহিন(বোন), মালকিন (মালিকের স্ত্রী), মায়্যাবিনী (মায়াবিনী) , ম্যাধাবিনী (মেধাবিনী) ইত্যাদি।
iv. এছাড়া এই জেলার উপভাষায় বেশ কিছু স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
আইমা (মায়ের মা) , আম্মা (মা), মায়্যা (স্ত্রী), শালি (স্ত্রীর বোন), মাগি ( বেশ্যা) , খানকি (গালিগালাজ বিশেষ), ঢেমনি (গালিগালাজ বিশেষ) ইত্যাদি।
১২.৩. বিশেষ্য মূলক রূপিমের লিঙ্গান্তরকরণ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপভাষায় চলিত বাংলার মতো বেশ কিছু বিশেষ্য মূলক রূপিমের লিঙ্গান্তরের ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন-
১২.৩.১ অন্তপ্রত্যয় যোগে
i. /ই/ - মুক্ত রূপিম লিঙ্গান্তর
হাওড়া হাউড়ি (পাগলি)
খুড়া খুড়ি(কাকি)
টকা টকি (মেয়ে)
পুত্রা ঝিয়ারি (ভাইঝি)
কচিয়া কচিয়াঞিঁ(মেয়ে)
ব্যায়্যা/বায়া বেয়াঞিঁ (মেয়ে)
ছোকরা ছোকরি( যুবতি)
চাচা চাচি (কাকি)
প্যাসা পেসি (পিসি)
দাদা বইদি(বউদি)
শালা শালি( স্ত্রীর বোন)
নানা নানি(পিসি)
ভঁদা ভঁদি (মোটা মেয়ে)
আজা আই (দিদি মা)
ব্যাটা বেটি (মেয়ে)
পো ঝি (মেয়ে)
মাউসা মাসি
ভাঞ্জা ভাঞ্জি( ভাগ্নি)
জামাই ঝি
ii /নি/ - জালি জালিনি (জেলের বউ)
লাতি লাতনি (নাতনি)
মাশটার মাশটারনি(মাষ্টারের স্ত্রী)
বেদে বেদিনি (বেদেনি)
পেত পেতনি(প্রেতনি)
বামোন বামনি (ব্রাহ্মণের স্ত্রী)
ব্যাধ ব্যাধিনি (ব্যাধের বউ)
বেদেশী বিদেশিনী
পিশাচ পিশাচিনী
পাপি পাপিনি
সুখি সুখিনি
iii./ আ/ - প্রতিপালক প্রতিপালিকা
বালক বালিকা
মৎসি মৎস্যা
পতিত পতিতা
বৎস্য বৎস্যা
মঙ্গল মঙ্গলা
ভাসুর বড়ো জা
প্রিয় প্রিয়া
মৃত মৃতা
iv /উ/ - ভাই বোনু (বোন)
খোড়া খোড়ু(পা ভাঙা)
দাদা দিদু (ঠাকুমা)
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে লিঙ্গান্তর করা হলো তা চলিত বাংলার থেকে সামান্য আলাদা হলেও এই বৈশিষ্ট্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষায় ব্যবহার হয়।
১২.৪ উভয় লিঙ্গ
এই জেলায় মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বেশি না হলেও কিছুক্ষেত্রে উভয় লিঙ্গের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন-
টকা (ছেলে- মেয়ে), মধ্যস্ত (ঘটক) , জালি( পুরুষ -মহিলা জেলে), কুটুম (আত্মীয়), ইত্যাদি।
মান্যচলিত বাংলা ভাষার মতো পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সর্বনামজাত বিশেষণের শ্রেণিগুলি যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে - তা চলিত বাংলার থেকে একটু স্বাতন্ত্র্য। তা ছাড়া এই উপভাষায় লিঙ্গের শ্রেণিবিভাগও উদাহরণ সহ আলোচিত হল। পরবর্তী পর্বেও এখানকার উপভাষায বচনের শ্রেণিগুলি আলোচিত হবে। মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা নির্ভর রূপতত্ত্বগত দিক থেকে।
পেজ- এ লাইক দিন👇
0 Comments