জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা-১৮/ বিমল মণ্ডল


Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
        
পর্ব-১৮ তৃতীয় অধ্যায় 
রূপতত্ত্ব(Morphology) 

১৩.বচন

এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় চলিত বাংলার মতো একবচন ও বহুবচনের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। স্ত্রী-পুরুষ, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার কথ্যভাষায় একবচন ও বহুবচনে বিশেষ্যের পৃথক রূপই  এই জেলায় প্রচলিত। যেমন- 

একবচন                                 বহুবচন    

নৌকা,                                  নৌকাগুয়া।        
মাঝি                                     মাঝিনে      
মেসিন                             মেসিনের মাচা       
নৌকায় তক্তা              নৌকায় তক্তার সারি


আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এই জেলায় বিশেষ্যের  আগে বহুত্তবোধক বিশেষণের ব্যবহারেও দেখা যায়। যেমন- 

 একবচন                                বহুবচন      
    
নৌকা                                 কতগা নৌকা 
মাছ                                   একঝড়া মাছ
ইলিশ                              কাড়িকাড়ি ইলিশ  
জাল                                  অতগা জাল

এখানে একবচন ও বহুবচনে উপরিউক্ত শব্দগুলো একই রূপ। তবে সর্বনামের ক্ষেত্রে এখানে বচনের প্রভাব যথেষ্ট। তাই এখানে বচন ভেদে সর্বনামের রূপ পৃথক পৃথক হয়। যেমন-

একবচন                বহুবচন    

মুই                          মোনে       
আমি                    আমানে
তুই                        তোরমনে
সে                          তানে
তার৷                     তারমনকে
তুমি            তুমানে /তুমারমনকে

  এখানে সর্বনামের রূপতত্ত্বের ব্যবহার থাকলেও বিশেষণ ও ক্রিয়ার রূপ  নিয়ন্ত্রণে বচনের কোন ভূমিকা নেই। কখন কখনও বিশেষণের দ্বিত্ব সাধন করে কখনো তার দ্বারা বহুবচনের কাজ করা হয়।  মান্যচলিত বাংলা ভাষার মতো বচন এই জেলার কথ্যভাষা  দুভাগে ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন - 

১৩.১ একবচন -

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায়  সাধারণত একবচন নির্দেশক বিভক্তি  রূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন - খানি, খানা, টা, টি গোটে ইত্যাদি। সাধারণ ভাবে এই নির্দেশকগুলি প্রত্যয়ের মতো পদান্তে বসে। প্রাণীবাচক, বিষয়বাচক এবংং বস্তুবাচকের শেষে এই বিভক্তিগুলি বসিয়ে ব্যবহার করা হয়। যেমন-

i. গোটায় নৌকা আইসেঠে। (একটা নৌকা আসছে) 
ii. আইজকে এ্যকটাও মাছ পড়লানি। (আজ একটিও মাছ পড়ে নি) 
iii.জালটা ফেলা না রে! (জালটি মার না রে)
iv. একখানা মেসিন বুসসে নৌকায়। (একটি মেসিন বসছে নৌকায়।) 
v. মুই একখানি জাল লি কি যাবা। (আমি একটি জাল নিয়ে যাব) 

১৩.১. ১ নির্দেশক সর্বনাম

এই জেলার  মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় চলিত বাংলার প্রভাবে নির্দেশক সর্বনাম হিসেবে ব্যবহার দেখা যায় ঔউটা, এটা, সউটা,  ইত্যাদি। এই  বিভক্তিগুলি নির্দেশক সর্বনামে একবচন হিসেবে  প্রয়োগ দেখা যায়।  যেমন-
i.   এঠিনু   ওউ  নৌকাটা লিযা। (এখান থেকে এই নৌকাটা নিয়ে যা) 
ii.সবুমাছ উঠিলিয়ালু আর ওউটা পড়ি রইলা। (সব মাছ নিয়ে গেলে কিন্তু এইটা পড়ে থাকলো।) 
iii. অতগুয়ার মাঝুনু সৌটা লি যা। (এতগুলোর মাঝখান থেকে সেইটা নিয়ে যাও।) 

১৩. ২.  বহুবচন

ক. পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় যে বহুবচন ব্যবহার হতে দেখা যায় তাতে  'গুয়া ', 'গুলা',বিভক্তি বহুবচন নির্দেশক হিসেবে প্রাণীবাচক, বস্তুবাচক, বিষয়বাচকএর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। যেমন- 

 i.নৌকাগুয়া কাই যাবে?(নৌকাগুলো কোথায় যাবে?) 
ii.এতোগুয়া মাছ লিয়া আসবি। (অনেকগুলো মাছ নিয়ে আসবি।) 
iii.মাজু গাঙে মাঝিগুলা নৌকায় বুসিয়া জাল ফেলাইছে। (মাঝ সমুদ্রে মাঝিগুলি নৌকায় বসে জাল ফেলিয়েছে।) 
iv..ঘরের মায়্যাগুয়া আইজ সারাদিন গাঙে মাছ ধরেটে। (ঘরের বৌ গুলো  আজ সারাদিন সমুদ্রে মাছ ধরছে।) 
v. কতগুয়া দিন চালি গেলা। (কতগুলো দিন চলে গেল) 

খ.  এছাড়া এখানকার কথ্যভাষায় যে বহুবচন ব্যবহার হয় তাতে অনেকত্ব বোঝাতে  'মেলল্যা', 'কত্ত', 'গাদাগাদা', 'বহুত', 'কাড়িকাড়ি'  ইত্যাদি বহুবচন শব্দগুলো ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন-
i. কালকে মেলল্যা মাছ পড়থালা। (কাল অনেক মাছ পড়েছে।) 
ii. তুই রাঁধু আর কাড়িকাড়ি মাছ ফেলাউ। (তুই রাঁধিস আর অনেক মাছ ফেলাস।) 
iii.কত্তগুয়া মাছ লিয়্যা আইসেটে দেখ। (অনেক মাছ নিয়ে আসছে দেখ।) 
iv.নজু বহুত কথা কয়। (নজু প্রচুর কথা বলে।) 
v.গাদাগাদা মাউস  কাই যাটে?(এতো এতো মানুষ কোথায় যাচ্ছে?) 
                                      
গ.চলিত বাংলার মতোই বিশষ্যের পূর্বে বহুত্ব  বোধক বিশেষণের প্রয়োগ এবং দ্বিরুক্তির সাহায্যে বা যুগ্ম শব্দ দ্বারা বহুবচনের রূপ গঠিত হয়। তাছাড়া সমষ্টিবাচক বিভিন্ন শব্দ পূর্বপদ রূপে ব্যবহৃত হয়ে বহুবচনের রূপ গঠিত হয়। যেমন-          

i. এতগুয়া মাউস খাবে?(এতোগুলা মানুষ খাবে?)
ii.করুনা ভাইরাসে সব্বাই মরিয়াবো রে। (করোনা ভাইরাসে সবাই মারা যাবো।) 
iii.  আমানকের জালি পাড়ায় আইজ চার-পাঁচ জঁয়ের করুনা হইছে। (আমাদের জেলে পাড়ায় চার-পাঁচজনের করোনা হয়েছে।) 
iv.সব মাছ কটবুনি, কিছুকিছু মাছ গোটা গোটা  রাখবু। (সব মাছ কাটবি না,কিছু কিছু মাছ পুরোটা রাখবে।) 
v.পাতলা পাতলা তক্তা নৌকায় দুয়া আছে। (সুরু সুরু তক্তা নৌকায় দেওয়া আছে।)
vi.কতগা মাস কাটি গেলা আমানে ঘরে বুসিয়া আছি।(কতগুলো মাস কেটে গেল আমরা ঘরে বসে আছি।)
vi.গোটা বছরটা চলিয়ালো  মোদের আয় নেই। (একটা বছর চলে গেল আমাদের আয় নেই।) 

ঘ.এই জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সর্বনাম পদের ব্যবহার। এই সর্বনাম পদে -কের, -রা,- নে  ইত্যাদি বিভক্তি যোগে বহুবচন নির্দেশিত হয়। যেমন-
i.মোদের ঘরে বারোমাস অভাব। (আমাদের ঘরে বার মাস অভাব।) 
ii.মোনকের গাঙে সব সময় থ্যাকতে হয়। (আমাদের সমুদ্রে সব সময় থাকতে হয়।) 
iii.আমানে নৌকা লিয়া আইজু মাছ ধত্তে যাবা। (আমরা নৌকা নিয়ে আজ মাছ ধরতে যাবো।) 
iv.ওনে কবে আসবে কইছে? (ওরা কবে আসবে বলেছে?) 
v.মোরমোনকের নৌকায় মাছ নেই। (আমাদের নৌকায় মাছ নেই।) 
vi তুমরা আইজকে পাই যাও। (তোমরা আজ চলে যাও।) 
ঙ. এই জেলায় চলিতবাংলা ভাষার মতো  মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সর্বনাম পদ দ্বিরুক্ত  করেও বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন- 
i. কাই কাই ঘুরুটু?(কোথায় কোথায় ঘুরছিস?) 
ii.তোরে টকাটা কুমা কুমা যাইথলো জিসা কর।(তোর ছেলেটা কোথায় কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা কর।) 
iii. কুন্ ঠি কু্ন্ ঠি জাল ফেলাইবু ঠিক করি লে। (কোথায় কোথায় জাল  মারবি ঠিক করে নে।) 
iv.তোনকের ঘরনু কে কে যাবু? (তোদের ঘর থেকে কে কে যাবে?) 
v. আইজ কাইনু কাইনু মাছ ধরলু? (আজ কোথায় কোথায় মাছ ধরলি?)  

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায়  রূপতত্ত্বগত দিক থেকে যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে তা মান্যচলিত বাংলা ভাষা থেকে একটু স্বাতন্ত্র্য । পরবর্তী পর্বে  বিশেষণ ও বিশেষ্যের রূপতত্ত্বগত  বিভিন্ন  দিক উদাহরণ সহ  আলোচিত হবে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments