জ্বলদর্চি

জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় নেতাজি/ দুর্গাপদ মাসান্ত

জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় নেতাজি

দুর্গাপদ মাসান্ত

ভারত ভূ-খণ্ডে বহু জাতির মানুষ বাস করলেও, ভারতীয় জাতি এক ঐক্যবদ্ধ বিচিত্র জাতি। কারণ বিভেদের মধ্যে, বৈচিত্রের মধ্যে, ঐক্যসাধনের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠাই ভারতীয় জাতির মূলমন্ত্র। আর তাদের ঐক্য ও অখণ্ডতাই জাতীয় সংহতির মূল বুনিয়াদ।

  এই ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় নেতাজি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে আন্তরিক। কারণ তিনি চেয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা। আসলে নেতাজি; স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দুটি জিনিসের সমন্বয় করেছিলেন। একটি দেশপ্রেম, অপরটি আত্মত‍্যাগ। এই আত্মত‍্যাগের মানসিকতা গড়ে তুলতে গান্ধিজির কিছুটা ইতস্তত ভাব থাকলেও সুভাষচন্দ্র ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। গান্ধিজি গোটা ভারতবর্ষে জাতীয় চেতনার উন্মেষ করেছিলেন, আর নেতাজি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই চেতনাকে এক বলিষ্ঠ বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। গান্ধিজি হলেন শিব, সুভাষচন্দ্র ছিলেন রুদ্র। ভারতবর্ষ থেকে সাম্রাজ্যবাদ নষ্ট করেছিলেন গান্ধিজি, আর এশিয়া থেকে তাকে সমূলে উৎপাটিত করেছিলেন নেতাজি। তাই নতুন দিল্লিতে এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র আজও যে বিভিন্ন   সম্মেলন বসান; এর মূলমন্ত্র আমরা লাভ করেছি এই বিপ্লবী নেতার জীবন থেকে।

  রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'দেশনায়ক' আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ তাঁর আদর্শের মধ্যে ছিল জাতীয়তাবাদ রক্ষার বীজ। তাই সাম্প্রদায়িক মিলনের কোন সম্ভাবনা দেখা দিলেই ইংরেজরা যখন তা সুকৌশলে চূর্ণ করে দিত ঠিক তখনই এই কলকাতা শহরের পৌরসভায় নেতাজি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মিলন সম্ভব করেছিলেন। এজন্য বাংলার মুসলমান তাঁকে অশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখত। শুধু তাই নয় দিল্লির শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের জাতীয়তাবাদ কাহিনি সুভাষচন্দ্রই আমাদের সামনে উদঘাটিত করেন। বিরাট এশিয়া মহাদেশের অসংখ্য পরাধীন জাতির অন্তরে তিনি জাতীয় চেতনার আকর তৈরি করতে পেরেছিলেন  বলেই প্রাচ‍্য ভূখণ্ডে তিনি 'নেতাজি' নামে অভিহিত। 

   ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ব্রিটিশ প্রস্তাবগুলির সামনে জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও পাঞ্জাবের শিখদের পার্টিগুলি পরস্পর বিরোধী দাবি উত্থাপন করেছিল। কিন্তু হিন্দু, মুসলমান, শিখ সৈন‍্যদের নিয়ে গঠিত 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' সারা ভারতে যে ঐক্যবদ্ধ মোর্চা তৈরি করেছিল তাতেই ব্রিটিশ বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। কারণ শাসকবর্গ বুঝেছিল ১৯৪৭ আর ১৮৫৭ সাল এক নয়। কারণ ১৮৫৭ সালে ভারতের ঐক্যবদ্ধ রূপ অনুপস্থিত ছিল।

   নীলবিদ্রোহ, সন্ন‍্যাসীবিদ্রোহ, মাঝিমাল্লার ও কৃষকদের বিদ্রোহ- এ সবই ছিল বিচ্ছিন্ন আন্দোলন। কোনটারই ভারতীয় রূপ ছিল না। এমনকী বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলন, সমাজসংস্কার আন্দোলন - এসব প্রয়াসকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয় এগুলো কখনওই জাতীয় আন্দোলনের রূপ নেয়নি। কিন্তু নেতাজির হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন মুহুর্তে বিদ‍্যুৎ গতিতে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেজন্যই সেদিন স্বতঃস্ফূর্ত ধ্বনি উঠেছিল - 'জয়হিন্দ'। এটি কোন একক জাতি নয়, সমগ্র জাতিরই ধ্বনি ছিল। হ‍্যাঁ, ৪২- এর আন্দোলনও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কিন্তু মনে রাখতে হবে একইসঙ্গে গোটা দেশ কুচকাওয়াজ করেনি।

  জাপানিরা 'আজাদ-হিন্দ-ফৌজ'-কে যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র দেয়নি, সামরিক শিক্ষা দেয়নি, সাজ-পোশাক দেয়নি, বিমান বাহিনীর সাহায্য দেয়নি, দিনের পর দিন অভুক্ত রেখেছে; তথাপি ফৌজের বাহিনীগুলির অসাধারণ বীরত্ব সম্ভব হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম সৈন্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

  নেতাজি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেননি। জাতীয় পুনর্গঠনের জন্য একটি 'ন‍্যাশনাল প্ল‍্যানিং কমিটি' গঠন করেন। কিন্তু অত‍্যন্ত দুর্ভাগ্যের যে, এই কমিটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখার জন্য স্বয়ং গান্ধিজি তাঁর অনুগামীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ গান্ধিজি আধুনিক ভারি শিল্প এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। অথচ নেতাজি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে এই কমিটিতে রাখলেন - বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী, অধ্যাপক, ট্রেড ইউনিয়ন ও গ্রামীণ শিল্পের প্রতিনিধি, কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসী প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধি অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষকে। ফলে দলমত নির্বিশেষে সারা দেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই কমিটি সম্পর্কে যে উৎসাহ দেখাল, এর আকর্ষণ পরিহার করা খুব সহজ ছিল না।

  তাই আজ সুভাষচন্দ্রকে বড়ো দরকার। কারণ এখানে বহু নেতাকে দেখি, কিন্তু সত্যিকারের নেতৃত্ব নেই। তিনি আসুন আমাদের ক্ষতবিক্ষত জীবনে, আমাদের মনে, আমাদের চিন্তায় ও আদর্শে।

পেজ- এ লাইক দিন👇
 আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments