জ্বলদর্চি

ফুটপাথের বই/ রাজীব চৌধুরী


ফুটপাথের বই

রাজীব চৌধুরী

একটি বই লেখকের টেবিল থেকে শুরু হয়ে প্রকাশকের টেবিলে, সেখান থেকে কম্পোজিটর প্রুফ রিডার হয়ে ছাপাখানায়, সেখান থেকে বাঁধাই হয়ে বইয়ের দোকান, সেখান থেকে পাঠকের খাটে, টেবিলে, বইয়ের তাকে, হয়তো তার কোন বন্ধুর বাড়ি, বাসাবদল বা চিরতরে বাসাছাড়া---শেষে কাগজওয়ালার হাত ঘুরে ফুটপাথের বইয়ের দোকান৷ সন্ধানী চশমার আতসকাঁচে ধরা পড়ে আবার অবিচলিতভাবে নতুন কোন জার্নি৷ হাতে হাতে পাঠে পাঠে যে বই মলিন একদিকে, মার্জিনের নোটে নোটে সে বইই উজ্জ্বল অপরদিকে৷ লাইব্রেরির বই অন্যের হাতে হাতে ঘোরে, আমিও যে অসংখ্য অন্যের একজন, অনন্য নই৷ তার সঙ্গে যুগপদ গোয়েন্দাগিরি ও জহুরিপনা৷ তার আবার অমূল্যকে মূল্যে কেনা এবং প্রায়শই তা প্রায় কিছু নয় বলা চলে৷
  বই তো দরাজদিল পাঠকেরই দেরাজে থাকে৷ ফুটপাথের বই, দরাজতর লোকের৷ বই ফুটে বসুধৈব কুটুম্বকম্৷ এমন অনেক কিছুই পুরোনো খুঁজে কেনার শখ বা নেশা থাকে মানুষেরই৷ ফুটপাথের বই সেখানে তৃতীয় দুনিয়ার অর্থনীতির মাপেও শিক্ষিত হয়ে ওঠার অপরিহার্য উপায়৷ সেই শিক্ষা কমিকস থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র, বাৎসায়ন থেকে নোয়ম চমস্কি পর্যন্ত এক সাবলটার্ন ইতিহাসেরও ক্ষেত্র৷ পাঠক সেখানে ক্রেতা, আবার অন্য কোনো পাঠক তার বিক্রেতাও৷ অক্ষরজ্ঞানহীন বিক্রেতা সাক্ষর হয় বই কিনে বেচে৷ এখানে এক অন্য তন্ত্র, অন্য ইতিহাস তৈরি হয়৷
এই ইতিহাস আবার হারানো বা অচেনাকে পাঠেরও ইতিহাস৷ নানা তাৎপর্যের এমন এক পাঠের ইতিহাস সংগ্রহ করেছে ‘উড়োপত্র’ প্রকাশন সংস্থা৷ ‘বই যখন বই’ নামক আকর্ষণীয় বইয়ের লেখক অনির্বাণ রায় এই বইটির সম্পাদক৷ ফুটপাথের সৌজন্যে পাওয়া বই তাই ‘কেয়ার অফ ফুটপাথ’৷ একদিক থেকে লেখাগুলি সবই গ্রন্থ সমালোচনা গোত্রের৷ তবে পার্থক্য হল: এগুলি সমকাল নয়, বরং পিছিয়ে পড়া কিছু বই ফিরে পড়া৷ তাই এ এক পুনর্পাঠ৷ আবার, চেনা নয়, বরং অচেনা বা অল্পচেনা হবার গৌরবে এই বইপড়াগুলি প্রথমে আবিষ্কার এবং পরে প্রিয়পাঠ বটে৷ লেখাগুলি প্রথম প্রকাশিত হয় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকায়৷ পরে একাই একশো অনির্বাণদা ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে যেভাবে এই বইটি তৈরি করেছেন, তার কথা প্রকাশকের নিবেদন থেকে জানা যায়৷
বইটির সূচনায় বিনয় ঘোষের লেখাটি এই ইতিহাস সঞ্চয়ের যুক্তি ও প্রযুক্তিকে খাড়া করে৷ এখানে লিখেছেন শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, বিজয় কুমার দত্ত, শামিম আহমেদ,  কৌশিক চক্রবর্তী, শুভঙ্কর দাস, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর ঘোষ, অনির্বাণ রায় নিজে এবং আরো অনেকে৷ রয়েছে মোট ২৭টি লেখা৷ কেউ কেউ এসব বইপাঠের স্বতন্ত্র নাম দিলেও অনেকেই কিন্তু নিজের হারানো কোনো বইপড়ার স্মৃতিকে ‘কেয়ার অফ ফুটপাথ’ নামই দিয়েছেন৷ তার সঙ্গে ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ দীর্ঘ কিছু মূল্যবান উদ্ধৃত লেখায় অনির্বাণ রায় চেষ্টা করেছেন এহেন বই পাঠের গুরুত্বের পরম্পরাটা বোঝাতে৷
  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় ‘রেকর্ড’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে! এই কলকাতারই ফুটপাথের এর পুরোনো রেকর্ড বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা একটি রেকর্ড৷ অচেনা অথচ চমৎকার সম্মোহক সেই সুর শোনার অভিজ্ঞতা৷ অথচ কেউই বলতে পারেন না এই সুরের জন্ম বা গোত্র, নাম, পরিচয় কিছুই৷ শেষে জানা যায় নাজিদের হাতে নিশ্চিতভাবে নষ্ট করে দেওয়া, বাজেয়াপ্ত এক প্রতিবাদী সুরসৃষ্টির একমাত্র নমুনা রেকর্ডটি৷ কেউ জানে না কিভাবে তা কলকাতার ফুটপাথে এক রেকর্ড বিক্রেতার কাছে পৌঁছলো! দমন পীড়ন ফ্যাসিজমের আক্রমণে টিকে থাকে মানুষের সৃষ্টি! যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা নেই অনেকসময়৷ ফুটপাথে পাওয়া গেছে এমনই কত বই! ইতিহাস তা নাকি রূপকথা!

কেয়ার অফ ফুটপাথ ৷ সম্পাদনা: অনির্বাণ রায়৷ ‘উড়োপত্র’ প্রকাশন৷ ২০০ টাকা
বইটি সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ: ৯৪৩২১৬৫১৬৯

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments