জ্বলদর্চি

অতিমারিরোধী মাস্কের উদ্ভাবককেও চরম হেনস্থা হতে হয়েছিল/ দুর্গাপদ মাসান্ত



                        দুর্গাপদ মাসান্ত

অতিমারিরোধী মাস্কের উদ্ভাবককেও চরম হেনস্থা হতে হয়েছিল। কবে এবং কোথায়?


১৯১০ সালের শরৎকাল। চিন ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহরে শুরু হল প্লেগ রোগ। মূলত দক্ষিণের দিকে মাঞ্চুরিয়ার হারবিন ও অন্য শহরে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল এই রোগ। মৃত্যুহার প্রায় ১০০ শতাংশ। যারাই আক্রান্ত হচ্ছে তারাই মারা যাচ্ছে। রাস্তায় যেন মৃতদেহের স্তূপ। সেই সময় মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল চিন, জাপান ও রাশিয়ার অধীনে ছিল। তিন সরকারই পড়ল ঘোরতর দুশ্চিন্তায়। কোনও ভাবে রোগ ছড়ালে বিপদে পড়বে গোটা বিশ্ব, এই ভেবে ইউরোপ ও আমেরিকাও চিকিৎসক দল পাঠানো শুরু করল। চিনের ইম্পিরিয়াল কোর্ট, প্লেগ মোকাবিলার জন‍্য যে দলকে পাঠাল তার প্রাধান নিযুক্ত হলেন কেম্ব্রজ-পাশ চিনা চিকিৎসক   উ লিয়েন থে। তারিখটা ১৯১০-এর ১৯ ডিসেম্বর। আক্রান্ত এলাকা সরজমিনে ঘুরে দেখে লিয়েন থে জানালেন, এই প্লেগের ধরন অন্য প্লেগের থেকে আলাদা। এটা অসুস্থ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এলেও রোগ ছড়ানোর জন্য কোনও না-মানুষ বাহকের আর প্রয়োজন হচ্ছে না।  রোগ ছড়াচ্ছে বাতাস বাহিত হয়ে। এটি নিউমোনিক প্লেগ। আর সেজন্যই রোগ আটকাতে নাক-মুখ ঢাকতে হবে। ততদিন পর্যন্ত  ধারণা ছিল, প্লেগ ছড়ায় ইঁদুর বা মাছির মতো প্রাণীর মাধ্যমে। এজন্য জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের অনেকেই বিদ্রূপ করতে লাগলেন এই চিনা চিকিৎসককে। 

    সমালোচনার জেরে লিয়েন থে-কে সরানো হল চিনা মেডিক্যাল টিমের প্রধান পদ থেকে। সেই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি ফরাসি চিকিৎসক-অধ‍্যাপক জেরাল্দ মেনি এসে পৌঁছলেন মাঞ্চুরিয়ায়। প্লেগ মোকাবিলায় তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও, তিনি কিন্তু কছুতেই লিয়ন থে-র বাতাসবাহিত সংক্রমণ তত্ত্ব মানলেন না। শুধু তাই নয় মাস্ক নিয়েও মতভেদ চরমে উঠল। একটা কাপড়ের টুকরোতে জীবাণু আটকাবে!   গনগনে চোখে আঙুল তুলে হুমকি দিলেন, "এই যে চিনাম‍্যান, তোমার এত সাহস যে, তুমি আমার মত খারিজ করে আকাশকুসুম তত্ত্ব আওড়াচ্ছ!   দেখে নেব তোমাকে।"

    যে রাতে তিনি লিয়েন থে-কে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন, তার পরদিন সকালেই প্লেগ হাসপাতালে গিয়ে, চৈনিক চিকিৎসককে ভুল প্রমাণিত করতে মাস্ক ছাড়াই এক প্লেগ-আক্রান্তের অস্ত্রোপচার করলেন। এর দিনকয়েকের মধ্যেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল মেনি-র। গোটা বিশ্ব চমকে উঠল। বায়ুবাহিত জীবাণু-সংক্রমণ আটকাতে মাস্কের অপরিসীম গুরুত্ব নিমেষে স্বীকৃতি পেল। প্রশাসন থেকেও মাস্ক পরার জন্য ব‍্যাপক প্রচার শুরু হল। হারবিনের রাস্তায় নাকে-মুখে মাস্ক বা কাপড়ের আচ্ছাদন ছাড়া কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। লিয়েন থে-র দৌলতে সে যাত্রায় জিতে গিয়েছিল চিন। প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মূত‍‍্যুর পর মাঞ্চুরিয়ায় ধীরে ধীরে কমতে লাগল প্লেগের প্রকোপ। শেষ কেস নথিভুক্ত হয়েছিল ১৯১১-র ১ মার্চ। সংক্রামক রোগ মোকাবিলার ইতিহাসে সংযোজিত হল এক নতুন অধ‍্যায়-'মাস্ক'।

   এই মাস্ক তৈরির জন্য লিয়েন থে সাহায‍্য নিয়েছিলেন ন'ইঞ্চি চাওড়া দুটি সার্জিক্যাল গজ কাপড়ের। তাদের মাঝখানে ছ'ইঞ্চি-চার ইঞ্চির একটা তুলোর টুকরো রেখে সেলাই করে দেওয়া হল। সার্জিক্যাল গজের দু'প্রান্ত দড়ির মতো করে কাটা থাকত, যাতে কানের উপর দিয়ে নিয়ে মাথার পিছনে বাঁধা যায়। নাক থেকে শুরু করে থুতনির নীচ পর্যন্ত  যাতে ঢাকা থাকে সেটা  নিশ্চিত করা হত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কাপড়ের মাস্ক ব‍্যাবহারের পদ্ধতির জনক হিসেবে লিয়েন থে-কে কুর্নিশ করে পৃথিবীর চিকিৎসক মহল। তার আগে পযর্ন্ত মাস্কের ব‍্যাবহার ছিল শুধু অস্ত্রোপচারের সময়।

     নিউমোনিক প্লেগ রোগের উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালনের জন্য তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এই চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর দেখানো পথ ধরেই এখনও গোটা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্প‍্যানিশ ফ্লু থেকে শুরু করে হালের সার্স বা করোনা রুখতে  কাপড়ের মাস্ক ব‍্যবহৃত হয়। ১৯৬০ সালে মারা গিয়েছিলেন অতিমারিরোধী মাস্কের এই আবিষ্কারক।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments