জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত-৫/ সুদর্শন নন্দী

সংক্ষিপ্ত মহাভারত

পর্ব-৫

সুদর্শন নন্দী

এবার সংক্ষেপে জরাসন্ধ কথা। জরাসন্ধ  ছিলেন মগধের (বর্তমানে পাটনা গয়া আর বাংলার কিছু অংশ)  রাজা। তিনি ছিলেন বৃহদ্রথ রাজবংশধর। তার পিতা বৃহদ্রথ এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। জরাসন্ধ একজন মহাবীর ও মহারথী হিসেবে মহাভারতে চিহ্নিত হয়েছেন। তার সাথে যাদবদের শত্রুতা ছিলো। তিনি বহু রাজাকে নিজের কারাগারে আটক করে রেখেছিলেন যাদের তিনি বলি চড়ানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন।তার প্রবল পরাক্রমের জন্য আর্যাবর্তের বহু রাজা তার প্রতি ভীত ছিল।

  জরাসন্ধ নামকরণ নিয়ে জানা যায় যে জরাসন্ধ শব্দটি দুটি  জরা ও সন্ধ শব্দের বন্ধন। সন্ধ  অর্থ হলো যুক্ত করা। জরা  নামক এক রাক্ষসী জরাসন্ধের দুটি অর্ধাংশ জুড়ে পুর্ণ মানবাকৃতি দিয়েছিল। তাই তার নাম জরাসন্ধ।
জরাসন্ধের পিতা রাজা বৃহদ্রথের বিয়ে হয়েছিল কাশীর রাজার যমজ দুই কন্যার সাথে। রাজা তার দুই স্ত্রীকেই সমান ভালোবাসতেন, কিন্তু কারো কোন সন্তান ছিল না। ঋষি চন্দকৌশিক একবার তার কাছে একটি মন্ত্র পড়া আম দিয়ে বর দিয়েছিল যে আম স্ত্রীদের খাওয়ালে তারা  সন্তান জন্ম দিতে পারবে। বৃহদ্রথ আমটি দুই ভাগ করে দুই স্ত্রীকে খাওয়ান। এর ফলে দুই স্ত্রী অর্ধেক বাচ্চার জন্ম দেয়। রাজা রেগে গিয়ে অর্ধাংশ দুটি বনে ফেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। সেই বনে জরা নামক এক রাক্ষসী বাস করত। সে দুটি অর্ধাংশ দেখতে পেয়ে  যুক্ত করে একটি সম্পূর্ণ বাচ্চার আকার দেয়। জরা বাচ্চাটিকে রাজাকে ফেরত দিল। জরা বাচ্চাটির দুটি অংশ জুড়ে দিয়েছিল, তাই বাচ্চাটির নাম রাখা হয়েছিল জরাসন্ধ। জরাসন্ধ দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে উপস্থিত হয়, কিন্তু প্রতিযোগীতায় হেরে যায়। ভীমের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যু হয়।

 এরপর শিশুপালের স্বল্প বিবরণ দিয়ে আমরা স্বয়ম্বর সভায় যাব।

  শিশুপাল ছিলেন চেদী রাজ্যের  (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে) রাজা দমঘোষ এবং বসুদেব ও কুন্তীর ভগিনী শ্রুতস্রবার পুত্র৷ রাজসভায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের সময়ে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের প্রতি শিশুপাল অষ্টোত্তর শততম কটুক্তির দ্বারা অপমানের সময়ে কৃষ্ণ চক্র দ্বারা তাঁকে হত্যা করেন৷ চেদী রাজ্যের রাজবংশের সন্তান হওয়ার দরুন শিশুপাল চৈদ্য নামেও পরিচিত ছিলেন৷

 মহাভারত থেকে পাই যে শিশুপালের জন্মের সময় তিনটি চোখ ও চারটি হাত ছিল৷ তাঁর বাবা ও মা এমন  অস্বাভাবিক সন্তান লাভ করায় মেরে ফেলতে চাইলে দৈব আকাশবাণী হয় যে শিশুটির মৃত্যুর সময়  হয়নি৷ ভবিষ্যতবাণী করা হয় যে সদ্যোজাত শিশুপালের অস্বাভাবিক দেহাংশগুলি এক বিশেষ মানুষের সংস্পর্শে লুপ্ত হবে ঐ একই জনের হাতে শিশুপাল ভবিষ্যতে মারা যাবে৷ এবার সদ্যোজাত শিশুপালকে দেখতে তাঁর মামাতো ভাই কৃষ্ণ চেদীরাজ্যে এলে নিজের হাঁটুতে সদ্যোজাতকে রাখলেন৷ এসময় শিশুপালের তৃতীয় চোখ ও বাড়তি দুটি হাত মিলিয়ে যায়। তবে উপস্থিত সকলে নিশ্চিত হন যে শিশুপালের মৃত্যু হবে কৃষ্ণের হাতেই ।  সমস্ত ঘটনা আন্দাজ করতে পেরে শিশুপালের মাতা শ্রুতস্রবা ভাইপো কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণ যেন শিশুপালের এক শত আটটি পর্যন্ত পাপ ক্ষমা করে দেন৷

 বিদর্ভের রাজপুত্র  তথা ভীস্মকের পুত্র রুক্মীর শিশুপালের সাথে যথেষ্ট ঘনিষ্টতা ছিল৷ তিনি তার বোন রুক্মিণীর বিয়ে চেদীরাজ শিশুপালের সাথে দিতে চাইলে কৃষ্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই তাঁকে অপহরণ করে বিয়ে করেন৷ শিশুপালের কৃষ্ণকে ঘৃণা করাও এটিও অন্যতম কারণ৷

 এদিকে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে তিনি ভীমকে চেদীদেশে নররাজা শিশুপালের কাছে যুধিষ্ঠিরের আনুগত্য স্বীকার করার কথা বললে শিশুপাল নির্বিরোধে তা স্বীকার করেন ও ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে আসা আমন্ত্রন গ্রহণ করেন৷ সেই যজ্ঞে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষ্ণ৷ এতে শিশুপাল ক্রুদ্ধ হন। সভায় উপস্থিত সকলের সামনে তিনি কৃষ্ণকে অপমান করতে থাকেন৷ তিনি কৃষ্ণকে ভীরুচিত্ত ও রাজা হওয়ার অযোগ্য বলে অবমাননা করেন৷ 

  পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষ্ণ শিশুপালের একশত আটটি পাপকে ক্ষমা করেন৷ মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও পাপবাক্য শিশুপাল বলায় ঐ সভাস্থলেই সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের শিরোচ্ছেদ করেন৷  

 ফিরে আসি দ্রোপদীর স্বয়ম্বরের কথায়। যদিও দ্রুপদ অর্জুনের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন তবুও অর্জুনকেই জামাই হিসেবে পেতে তিনি এই কঠিন পরীক্ষার আয়োজন করেন। শর্ত ছিল শূন্যে ঘুরন্ত মাছের চোখে জলে প্রতিবিম্ব দেখে যে তীর বিদ্ধ করতে পারবে তাকেই কন্যা দান করবেন। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে কেউ তা পারেননি। আগেই বলেছি  কর্ণকে  দ্রৌপদী সুযোগ দেন নি।  এতে কর্ণ রাগে অপমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে  ধনু ত্যাগ করেন। অথচ দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতার অনুমতি নিয়ে সকল বর্ণের পুরুষকে আমন্ত্রণ জানান। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশী অর্জুন এই কাজ সম্পন্ন করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন। কিন্তু বাসায় ফিরে যখন ভীম কুন্তীকে তারা কী এনেছে তা দেখার জন্য বলেন কুন্তী তখন অজ্ঞাতসারে তাদের বলেন তারা যা এনেছে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে। কুন্তী না দেখেই মন্তব্য করেন, “যা পেয়েছ, পাঁচ ভাই মিলে ভাগ করে নাও।” ধর্মসংকটে পড়েন পাণ্ডবেরা। অতঃপর দ্রৌপদীকে পঞ্চপাণ্ডবেরই স্ত্রী হিসেবে পরিচিত হতে হয়।
           
  দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী গ্রহণ করার পিছনে রয়েছে অন্য কাহিনী। পূর্বে উল্লেখ করেছি যে দ্রৌপদী তার পূর্বজন্মে পতি লাভের জন্য তপস্যা করছিলেন এমন সময় মহাদেব তাকে বর দিতে আসেন। দ্রৌপদী এ সময় পাঁচ বার "পতিং দেহি" বলেন যার অর্থ পতি দিন। তখন মহাদেব তথাস্তু বলেন। পাঁচজন পতি লাভ করেন তিনি। এজন্য পরবর্তী জন্মে তার পাঁচজন স্বামী হয়। 

   এদিকে পাণ্ডবদের জীবিত থাকার সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সিংহাসন নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু হয়েছে ভেবে যুবরাজ পদবী দুর্যোধন পেয়েছিলেন। দুর্যোধন তার পদ ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের পুত্রের কাছ থেকে কোন কিছু কেড়ে নিতে অসমর্থ হওয়ায় এবং দুর্যোধন ও শকুনির বারণাবত অগ্নিকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা ফাঁস হওয়ায় ভীষ্ম রাজ্যকে বিভাজিত করার উপদেশ দিলেন। কৌরবরা হস্তিনাপুর ও পাণ্ডবরা খাণ্ডবপ্রস্থের (যমুনা তীরবর্তী একটি বনাঞ্চল)অধিকার নিলেন। অনুর্বর, সাপের প্রাচুর্য যুক্ত, গাছপালা ও ডোবা - নালায় পূর্ণ খাণ্ডবপ্রস্থ পাণ্ডবদের জন্য খুব ভালো কোন উপহার ছিল না। অবশ্য, কৃষ্ণ, বলরাম ও ময়দানব (দানবকুলের বিশ্বকর্মা যিনি অর্জুনের কাছে খাণ্ডব দহনের সময় তার জীবন বাঁচানোর জন্য ঋনী ছিলেন) এর সহায়তায় পাণ্ডবরা খাণ্ডবপ্রস্থকে ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত করেন। এর প্রধান আকর্ষণ ছিল সভাগৃহ যা ময়দানব তার মায়ার সাহায্যে অনবদ্য রূপে গড়েছিলেন।  শুধু তাই নয় পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করার পর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলের প্রভুত্ব পেয়েছিলেন। প্রধান প্রধান শক্তি যেমন মদ্র, দ্বারকা, কাশী, মগধ ও পাঞ্চাল পাণ্ডবদের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছিল। পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে কৌরবরা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন। ওদিকে পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে দ্রৌপদীর সুখের সংসার। তবে এখানে বসবাসকালে নারদের নির্দেশে প্রতি পান্ডব এক বছর দ্রৌপদীর সাথে সহবাস করত। অবশ্যই দ্রৌপদীর সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের বিভ্রান্তি এড়াতে। পাণ্ডবগণের ঔরসে দ্রৌপদীর গর্ভে পাঁচ পুত্র জন্মায়।

 পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments