জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত- ৭/সুদর্শন নন্দী


সংক্ষিপ্ত মহাভারত
পর্ব- ৭

সুদর্শন নন্দী

এরপর পাণ্ডবরা ১২ বছর বিভিন্ন বনে ভ্রমণ করতে থাকেন। ঘোরেন কাম্যকবন, দ্বৈত বন। এই সময় তাদের নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, কখনো সত্যি দানব, কখনো দানব, ব্যাধের সাজে দেবতা সবার মুখোমুখি হতে হয়। তবে এই বনবাসকালে দেবতাদের আশীর্বাদে বিভিন্ন অস্ত্রের জোগাড় যন্ত্র পাণ্ডবেরা করে নেয়। ওদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের ছলে কর্ণ হারায় নিজের প্রাণ রক্ষাকারী কুণ্ডল ও কবচ। সমস্ত বিপদকে জয় করে পাণ্ডবরা তাদের বনবাসকাল সম্পূর্ণ করেন। সত্যি বলতে কি বনবাস পর্ব মহাভারতের বড় পর্বগুলোর একটি। এই পর্বে পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাস কাল,  বিভিন্ন ঋষির সাথে তাঁদের অর্জিত শিক্ষা এবং সেসব শিক্ষা তাদের চরিত্র গঠনে কীভাবে সাহায্য করেছিল তা বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এই পর্বে নানা উপাখ্যান যেমন "অজগর - যুধিষ্ঠির সংবাদ", "শ্যেন - কপোত উপাখ্যান", "নল - দময়ন্তীর উপাখ্যান" ও “সাবিত্রী - সত্যবানের উপাখ্যান” বর্ণিত হয়েছে।
   কাম্যকবনে বসবাসকালে বকরাক্ষসের ভাই কির্মীর প্রতিশোধ নিতে পাণ্ডবদের আক্রমণ করলে, ভীম তাকে হত্যা করেন।  বদরিকাশ্রমের কাছে বসবাসকালে, গঙ্গায় সুগন্ধী পদ্মফুল ভেসে যেতে দেখে দ্রৌপদী ঐ পদ্ম সংগ্রহের জন্য ভীমকে বললে ভীম পদ্ম সংগ্রহের জন্য গন্ধমাদন পর্বতে আসেন। সেখানে হনুমানের সাথে তাঁর দেখা হয়। পদ্ম সংগ্রহের জন্য ভুল করে মানুষের অগম্য স্বর্গপথে ভীম রওনা দিলে, হনুমান রুগ্ন বানরের বেশে তাঁর পথরোধ করে বসেন। ভীম হনুমানকে পথ ছেড়ে দিতে বললে, হনুমান তাতে রাজী হলেন না।  পবন পুত্র হনুমান। ভীমও তো পবনেরই পুত্র। সেই হিসেবে হনুমানের ভাই। ভীম দাদাকে চিনতে না পেরে আস্ফালন করতে থাকলে, হনুমান তাঁর লেজ বিছিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি এই লেজ সরিয়ে তবে যাও।  ভীম চেষ্টা করেও লেজ সরাতে পারলেন না। এবার  হনুমান নিজের  পরিচয় তুলে ধরলেন ভীমকে। হনুমান পদ্মবনের প্রকৃত পথও দেখালেন। এরপর ভীম কুবেরের জলাশয় থেকে কুবেরের অনুচরদের পরাজিত করে দ্রৌপদীর চাওয়া পদ্ম তুলে আনেন।
 
   আরেকটি ঘটনা। জটাসুর নামক এক রাক্ষস পাণ্ডবদের সাথে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বাস করতেন। একদিন ভীম মৃগয়ায় গেলে, এই রাক্ষস যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীকে অপহরণ করে। ভীম ফিরে এসে প্রকৃত বিষয় অবগত হয়ে এই অসুরকে হত্যা করেন। 
   বারো বছর বনবাস শেষ হলে শুরু হল একবছরের অজ্ঞাতবাসের অজ্ঞাতবাসে ধরা পড়লে আবার বারো বছর বনবাস। বড়ই চিন্তার অজ্ঞাতবাসের সময়কাল। অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবেরা ছদ্মবেশে মৎস্যদেশে বিরাট রাজার রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিরাট এক  হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র বিশেষ।
   তিনি মৎস্যদেশের রাজা ছিলেন বলে, মৎস্যরাজ নামে পরিচিত ছিলেন। বিরাটের স্ত্রীর নাম ছিল সুদেষ্ণা, ভাইয়ের নাম ছিল শতানীক এবং শ্যালকের নাম ছিল কীচক। তাঁদের তিন পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রদের নাম - শঙ্খ, শ্বেত ও ভূমিঞ্জয় (উত্তর) এবং কন্যার নাম ছিল উত্তরা। ইনি কুবেরের মত ধনী ছিলেন। বিরাটের মুখ্য সম্পদ ছিল তাঁর বিশাল সংখ্যক গবাদি পশু। পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় এঁর রাজদরবারে ছদ্মনামে ও ছদ্মবেশে আশ্রয় নেন। এই সময়ে পাণ্ডবরা যে ছদ্মনামে ও ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন।যুধিষ্ঠির কঙ্ক ছদ্মনামে   সভাসদ ছদ্মবেশে। ভীম বল্লভ ছদ্মনামে  পাচক ছদ্মবেশে, অর্জুন  বৃহন্নলা ছদ্মনামে বিরাটরাজ কন্যা উত্তরার সঙ্গীতশিক্ষক ছদ্মবেশে নকুল তন্তিপাল ছদ্মনামে, গোশালার অধ্যক্ষ ছদ্মবেশে, সহদেব গ্রন্থিক ছদ্মনামে, অশ্বশালার প্রধান ছদ্মবেশে দ্রৌপদী সৌরন্ধ্রী ছদ্মনামে, রানী সুদেষ্ণার পরিচারিকা ছদ্মবেশে। এদিকে শালা কীচক দ্রৌপদীকে কামনা করে ব্যর্থ হয়ে প্রকাশ্যে দ্রৌপদীকে অপমান করেন। এর প্রতিশোধ হিসাবে ভীম তাঁকে হত্যা করেন। একবার বিরাটরাজ তাঁর এই শ্যালক কীচকের সহায়তায় ত্রিগর্তরাজ সুশর্মাকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্য অধিকার করেছিলেন। রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে সুশর্মা দুর্যোধনের আশ্রয় নেন। কীচকের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, সুশর্মা দুর্যোধনের সৈন্যের সাহায্যে বিরাটরাজ্যের দক্ষিণাংশ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিরাট সুশর্মা'র হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। 

এরপর যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম সুশর্মা'র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। যুদ্ধে ভীম সুশর্মাকে পরাজিত করে বন্দী করে নিয়ে আসেন এবং সেই সাথে বিরাটকে উদ্ধার করেন। এই সময় দুর্যোধন, কর্ণ, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখের নেতৃত্বে বিরাটরাজ্যের উত্তরাংশ আক্রমণ করে সমস্ত গো-সম্পদ অধিকার করেন। এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিরাটপুত্র উত্তর, বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে রথের সারথি করে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাল কৌরববাহিনী দেখে উত্তর পলায়নের চেষ্টা করলে- অর্জুন তাঁকে থামিয়ে উত্তরাকে সারথি বানিয়ে নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অর্জুন এই যুদ্ধে কৌরববাহিনীকে পরাজিত করে গো-সম্পদ উদ্ধার করেন। যুদ্ধজয়ের সংবাদ শুনে বিরাট তাঁর পুত্রের বিষয়ে অহঙ্কার প্রকাশ করলে- যুধিষ্ঠির বলেন যে, সারথি বৃহন্নলা'র (অর্জুন) জন্যই যুদ্ধজয় হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের এই কথা শুনে বিরাট অহঙ্কার করে বলেন যে- নপুংশক ভীষ্ম ও দ্রোণের মত বীরকে পরাজিত করতে পারে না। এই সময় বিরাট তাঁর হাতের পাশ দ্বারা যুধিষ্ঠিরের মুখে আঘাত করে রক্তপাত ঘটান। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে,- বিনাযুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের কেউ রক্তপাত ঘটালে- তিনি তাঁকে হত্যা করবেন। এই জন্য যুধিষ্ঠির এই ঘটনা অর্জুনের কাছ থেকে গোপন করেন। পরে উত্তরের কাছে সকল বিষয় অবগত হয়ে বিরাট যুধিষ্ঠিরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অজ্ঞাতবাসকালের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে, পাণ্ডবরা বিরাটের কাছে আত্মপ্রকাশ করেন। বিরাট তাঁর কন্যা উত্তরার সাথে অর্জুনের বিবাহের প্রস্তাব দিলে- নিজ কন্যাস্থানীয়া বিবেচনা করে অর্জুন তাঁর পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনে ইনি দ্রোণাচার্যের হাতে নিহত হন। 
   এবার পাণ্ডবেরা তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেতে চাইলে কৌরবরা তা ফেরত দিতে না চাইলে  পাণ্ডব ও কৌরবের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments