জ্বলদর্চি

ফেব্রুয়ারি কেন আঠাশ দিনের/ মুক্তি দাশ

ফেব্রুয়ারি কেন আঠাশ দিনের

মুক্তি দাশ

হ্যাঁ। ইংরেজি বর্ষের দ্বিতীয়মাস ফেব্রুয়ারির কথাই বলা হচ্ছে। ভেবে দেখুন তো, ফেব্রুয়ারিকে বাদ দিলে আর সবক’টা মাসই দিব্যি কেমন তিরিশ বা একতিরিশ দিনে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। শুধু ফেব্রুয়ারির বেলাতেই আঠাশ দিন? এটা একধরনের পক্ষপাতিত্ব নয়? যেন সবার কাছে ফেব্রুয়ারিকে হেয় প্রতিপন্ন করার একটা হীন এবং সুকৌশল প্রচেষ্টা।

   এই অবহেলিত ফেব্রুয়ারির বরাবর কিন্তু এরকম দৈন্যদশা ছিল না। বিশ্বাস করুন, একসময় এই মাসটিও ছিল অপরাপর মাসগুলিরই সমগোত্রীয়। অর্থাৎ, তিরিশ দিন সম্বলিত। আগেকার দিনের রাজরাজড়াদের নিছক অহেতুক খামখেয়ালিপনার বশে আজ ফেব্রুয়ারির এই দুর্গতি।

   সে অনেককাল আগের কথা। ইংরেজি বর্ষ তখন শুরু হতো মার্চ মাস থেকে। সেই হিসেব অনুসারে দ্বাদশ বা শেষতম মাস স্বভাবতই ফেব্রুয়ারি। আর সেটাই বোধহয় ফেব্রুয়ারির কাল হয়ে দাঁড়ালো।
   সে-সময় রোমের সম্রাট ছিলেন জুলিয়াস সীজার। আর জুলিয়াস সীজারের জন্মমাস হলো বছরের পঞ্চম মাস। তার মানে, মার্চকে প্রথম মাস হিসেবে ধরলে পঞ্চম মাস হচ্ছে জুলাই। তখন অবশ্য জুলাইর নাম ‘জুলাই’ ছিলো না। জুলাই মাসকে বলা হতো, ‘কুইন্টিলিস’। আর আগস্টকে, ‘সেক্সটিলিস’। এখন তো কি জুলাই, আর কি আগস্ট – দুটো মাসই একতিরিশ দিনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগে কিন্তু মোটেই এরকম ছিল না। জুলাই ওরফে কুইন্টিলিস ছিল তিরিশ দিনের মাস। আগস্ট ওরফে সেক্সটিলিস মাসও তাই। অর্থাৎ তখনকার ইংরেজি মাসগুলির দিনসংখ্যা ছিল এইরকম –

মার্চ – ৩১ দিন
এপ্রিল- ৩০ দিন
মে -৩১ দিন
জুন – ৩০ দিন
কুইন্টিলিস (জুলাই) – ৩০ দিন
সেক্সটিলিস (আগস্ট) – ৩০ দিন
সেপ্টেম্বর – ৩০ দিন
অক্টোবর – ৩১ দিন
নভেম্বর - ৩০ দিন
ডিসেম্বর – ৩১ দিন
জানুয়ারি - ৩১ দিন 
ফেব্রুয়ারি – ৩০ দিন

   এই হলো ইংরেজি বছরের ৩৬৫ দিনের তৎকালীন হিসেব।

   হ্যাঁ, যা বলছিলাম। রোম-সম্রাট জুলিয়াস সীজার জন্মেছিলেন ১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কুইন্টিলিস মাসে। আর মারা যান ৪৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। মানে, খুন হয়ে যান আততায়ীর হাতে। জুলিয়াস সীজার বিলাসী, আমুদে এবং জাঁকজমকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। রাজা-মহারাজারা যেমন হয়ে থাকেন আরকি! প্রতি বছর খুব ঘটা করে সারামাস ধরে নিজের জন্মোৎসব পালন করতেন। পুরো একটি মাস সমগ্র রোম সাম্রাজ্যের প্রতিটি মানুষ আনন্দের আতিশয্যে একেবারে বিভোর হয়ে থাকতো। 

   এতেও জুলিয়াস সীজারের মন ভরে না। আচ্ছা, তাঁর জন্মমাস কুইন্টিলিস-এর পুরো নামটাই যদি বদলে তিনি নিজের নামে এই মাসের নাম রাখেন, তাহলে কেমন হয়? তাহলে কি তাঁর জন্মমাসের গুরুত্বটা বেশ একটুখানি বেড়ে যাবে না? অতএব সেই থেকে কুইন্টিলিস-এর নাম হয়ে গেল ‘জুলিয়াস’। কালক্রমে বহু উচ্চারিত হতে হতে এখন যা ‘জুলাই’তে এসে দাঁড়িয়েছে।

   জুলিয়াস সীজার কিন্তু এতেই ক্ষান্ত হলেন না। করলেন কি, তিনি তাঁর জন্মমাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কুইন্টিলিসকে তিরিশ দিন থেকে একদিন বাড়িয়ে একতিরিশ দিনের করে দিলেন।

   কিন্তু একটা দিন শুধু এমনি এমনি বাড়িয়ে দিলেই তো হলো না। একটা দিন বাড়ানো মানে বছরটা আবার তিনশো ছেষট্টি দিনের হয়ে যাবে যে! সেটা কি উচিৎ হবে? তাহলে এখন উপায়? এ-তো আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল! ছলে-বলে-কৌশলে বছরটাকে তো তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে এনে দাঁড় করাতেই হবে। স্বভাবতই চোখ গিয়ে পড়লো একেবারে শেষের মাস ফেব্রুয়ারির দিকে। 

   তারপর আর কি! অত্যাচারী উৎপীড়ক রাজারা যেভাবে অনায়াসে খেলাচ্ছলে দুর্বল অসহায় প্রজাদের মুন্ডু খচাখচ কেটে ফেলেন, অবিকল সেইরকমভাবে শেষতম মাস ফেব্রুয়ারি থেকে শেষতম দিনটি টুক করে ছেঁটে দিলেন রোমাধিপতি জুলিয়াস সীজার। অতঃপর ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল ঊনতিরিশ দিনের।
   এরপর পরবর্তীকালে রোমের সম্রাট হয়ে বসলেন অগাস্টাস সীজার। এবং যেহেতু তিনিও এই 
পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, সুতরাং এই মহাপুরুষেরও একটা জন্মমাস থাকতেই হবে। আর সেই মাসটি হলো ‘সেক্সটিলিস’। অর্থাৎ, বছরের ষষ্ঠ মাস। এবং ইনিও জুলিয়াস সীজারের থেকে কোনো অংশে কম না। জুলিয়াস সীজার যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন অগাস্টাস সীজারও অন্ধভাবে তারই অনুসরণ করে গেলেন মাত্র। তার অর্থ, ইনিও তাঁর জন্মমাস সেক্সটিলিস-এর নাম বেমালুম পাল্টে দিয়ে নাম রাখলেন, অগাস্টাস বা আগস্ট। এবং একেও সসম্মানে তিরিশ থেকে একতিরিশ দিনে উত্তীর্ণ করা হলো। আবার সেই একই সমস্যা। তিনশো ছেষট্টি দিনে বছর? হতেই পারে না। অগত্যা বছরটাকে যথাযথ অবয়বে অর্থাৎ তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের পরিপূর্ণতায় ফিরিয়ে আনার অজুহাতে পুণর্বার ছুরি চালানো হলো সেই ছাই আনতে ভাঙা কুলো ফেব্রুয়ারির ওপর। আরো একটি দিন অক্লেশে ঝরে গেল ফেব্রুয়ারির শরীর থেকে। সেই থেকে অদ্যাবধি ফেব্রুয়ারি, বছরের দ্বিতীয় মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও, আঠাশ দিনের মাস।

   অবশ্য এখন চার বছর অন্তর অন্তর লিপইয়ারের দৌলতে ফেব্রুয়ারি আঠাশ থেকে ঊনতিরিশ দিনের হয়ে যায়। সে এক ভিন্ন কাহিনী। পরে সময় ও সুযোগমতো আলোচনা করা যাবে। এইযে চার বছর বাদে বাদে আঠাশ থেকে ঊনতিরিশ দিনের হওয়া--এটা তবু মন্দের ভালো। এতে ফেব্রুয়ারির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার হলো কিনা কে জানে, তবে তার ক্ষত-বিক্ষত শরীরে এবং মনে (যদি থেকে থাকে) যে সামান্যতম সান্ত্বনার প্রলেপ পড়ে--একথা সুনিশ্চিত।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments