জ্বলদর্চি

প্রতিবিম্ব /অতনু ঘোষ

প্রতিবিম্ব

অতনু ঘোষ

স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজ জীবনে কোনো ছেলে বা মেয়ে পদার্পন করে তখন তার মনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রেমের ঘন্টা বেজে ওঠে। আবার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আঠারো বছর বয়স সম্পর্কে যথার্থই বলে গেছেন--' আঠারো বছর বয়সের নেই কোনো ভয়...'

    মেয়েটির দোহারা ছিপছিপে গড়ন অপূর্ব ! গায়ের রং অপূর্ব!  মুখের চেহারা অপূর্ব!   কটিদেশ লম্বিত কেশবিন্যাস অপূর্ব !  সবচেয়ে অপূর্ব চোখ জোড়া !  চোখে চোখে চাইলে যেন নেশা লেগে যায়। জয়িতা অর্থাৎ জয়ি। বয়স বছর উনিশেক, তার বেশি নয়।
    সবেমাত্র সে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কলেজের অনতিদূরেই একটি ছাত্রী আবাসনে ভাঁড়া ঘরে থাকতে হয়। বাড়ি মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় হলেও যাতায়াত সমস্যার কারণে তাকে কলেজের নিকটেই থাকতে হয়। কলেজের সামনে একটি দিদিবাড়ি থাকায় মেয়েটি তথা জয়ি আরও একটু সাহস পায়। তার অধিকাংশ সময় দিন কাটে কলেজে এবং দিদিবাড়িতে। তাই নিজের পড়াশোনা করার একমাত্র সময় হল রাত্রিবেলা। নূতন জায়গায় পড়াশোনা করতে এসে আবার বাধ সাধল জয়ির। ছাত্রী আবাসনের অন্যান্য মেয়েরা তাকে ভূত, প্রেত ইত্যাদির ভয় দেখায়। ভয় হয়তো সে করতো না বটে, কিন্তু নতুন জায়গা বলে কথা-- হয়তো এই ভয়েই একটু গা ছমছম করবেই-সে ভূত থাক আর নাই থাক। তাই রাতের বেলাও তার পড়াশোনার পাট চুকল।

    প্রথম প্রথম কলেজ যাওয়া জয়িতার খুব ভালোই লাগে। বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা, মশকরা তো লেগেই থাকে। একই কলেজের একই বৎসরের ভূগোল বিষয়ের একটি ছেলে সুখেন্দু'র খুবই ভালো লাগে জয়িতাকে। প্রথম প্রথম কোনো মেয়েই পাত্তা দেয় না কোনো ছেলেকে। এক্ষেত্রেও তাই। সুখেন্দু কি পারবে জয়িতাকে জয় করে সুখের প্রকোষ্ঠে ইন্দুর জ্যোৎস্না প্রবেশ করাতে?

    সুখেন্দু অর্থাৎ সুখেন সাহা। পড়াশোনায় খুবই ভালো। অথচ বেশিরভাগ সময় কাটায় কলেজের কমন রূমের আড্ডায়। একদিন তার বান্ধবীদেরকে জয়িতাকে ভালোলাগা সম্পর্কে আনুপূর্বিক বলে। অনার্সের সঙ্গে পাশে রাখা বিষয়গুলির নোটসপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমেই প্রেমের রশ্মিতে গিঁট পড়তে থাকে। আদান-প্রদান হয় ফোন নম্বরও। জয়ি প্রথমে একটু সংকোচবোধ করেছিল কেননা নিকটেই থাকা দিদি কিংবা জামাইবাবু বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলে এখানেই হয়তো পড়াশোনায় ছেদ পড়বে। তবুও সেই ভয়কে উপেক্ষা করেই চলতে থাকে ভাব বিনিময়। জয়িতা যে প্রেম করবে এটা সে জীবনেও কল্পনা করেনি কারণ তার বাবা-মা যদি দিদিদের মারফৎ জানতে পারে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। সুখেন্দু খুব ভালো গিটার বাজায়। যথারীতি জয়িতার বন্ধু-বান্ধবীরা নানান ছলাকলায় জয়িতাকে সুখেন্দু সম্পর্কে বোঝাতে থাকে। যাতে তার প্রেমের পাষাণ হৃদয় গলে জলে পরিণত হয়। সুখেন্দুর বাড়ির অবস্থা খুব ভালো না থাকলেও কলেজের নানান ট্যুরে তাকে যোগদান করতে হয়েছে। এইরকম কোনো এক ট্যুরে জয়িতাকে সঙ্গে নিয়ে সুখেন্দু যাবে বলে সংকল্প করে। কিন্তু জয়িতার ঐ একটাই ভয়-বাড়ি লোক।৷ কিন্তু তার অবস্থাটা সুখেন্দু বোঝে না। তার খুব পরিচিত কিংবা বন্ধু সম্পর্কীয় স্যার বলাই যায়- যার নাম নিতাই রায়; তিনিও একপ্রকার জয়িতাকে ট্যুরে (সিকিম) যাবার জন্য অনুরোধ করে। একথা শোনার পর জয়ি নাকচ করে দেয়। অগত্যা সেবার জয়িতাবিহীন সুখেন্দুকে যেতে হয় ট্যুরে। একবার কলেজে সুখেন্দু জয়িতার গা ঘেঁষে কাঁধের উপরে হাত রাখায় জয়িতা সুখেন্দুকে চড় কষিয়েছিল। আসলে জয়িতা এগুলো পছন্দ করে না-- এই যেমন ধরো-- হাত ধরে টানাটানি, চুম্মা খাওয়া, দেহের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেওয়া, কোথাও ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি। এইজন্যই সেদিন বোধহয় চড় মেরেছিল। জয়িতার অপর এক বান্ধবী বুল্টি সুখেন্দু সম্পর্কে নানা মন গলানো কথা বলে। অবশেষে জয়ি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন সুখেন্দু-কে সে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু তাতে অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। এদিকে সুখেন্দু'র তখন একশো আটটা সখী। যেন জয়িতা এখানে রাধা অর্থাৎ সুখেন্দুর জীবনে চাঁদের আলো প্রবেশ করেছে ঠিকই কিন্তু তার আগেই অনেক রং-বেরঙের আলো প্রবেশ করে গেছে যা ঐ চাঁদোয়ার থেকেও প্রখর, তীব্র।

    জয়িতার বাড়ির সদস্যরা যে সুখেন্দু-কে মেনে নেবে না, এটা জয়ি ভালো করেই জানে। তার কারণ সুখেন্দু সে তার পারিবারিক বিবাদ সূত্রে পিতার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে মাতার সঙ্গে মাতুলালয়েই দিন অতিবাহিত করে। জয়ি'র কাছে এটাই হয়তো মুখ্য কারণ।

    অ্যানথ্রোপলজি'র প্র্যাকটিক্যাল রুমে একদিন প্র্যাকটিক্যালরত অবস্থায় জয়িতা অসাবধানতাবশত একটি লাইট ভেঙে ফেলে। যার ক্ষতিস্বরূপ একটি লাইট কিনে দিতে হয় তার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে। পরে দ্বিতীয়বার আবারও একটি লাইট ভেঙে ফেলে জয়িতা। এবার সে তার বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে লজ্জিত বোধ করলে সুখেন্দু তাকে কিনে দেয়। অথচ সুখেন্দু-কে এ ব্যাপারে জয়িতা কোনো কিছুই বলেনি। তাহলে কি সুখেন্দু ভালোবাসার স্বরূপ উদঘাটন করছে? জয়ির ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। 

    সুখেন্দু ছিল খুবই স্মার্ট এবং চতুর। সুখেন্দুর থেকে জুনিয়র মীনাক্ষী নামের একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। যথারীতি ভালোভাবে কথাবার্তাও চলতে থাকে। কলেজে যখনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তখনই মীনাক্ষীর আশ্রয় নেয় সুখেন্দু এবং সুখেন্দু মীনাক্ষীকে পড়াশোনার ব্যাপারে প্রচুর সাহায্য করে। এদিকে মীনাক্ষী যে অন্য ছেলের সঙ্গে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে সেটা সুখেন্দু ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। মীনাক্ষী-র সঙ্গে সুখেনের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে মীনাক্ষীর বয়ফ্রেণ্ড কল্যান সুখেন-কে ফোন করে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো যোগাযোগ না রাখে। তখন রাত সাড়ে এগারোটার সময় সুখেন জয়ী-কে ফোন করে এবং বলে যে, " আমি কি তোকে ভালোবাসি না?" -- হঠাৎ রাতে এই ধরণের কথাবার্তা শুনে জয়ি তো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার উপক্রম। তখন জয়িতা বলে--"তুই এই ধরনের কথা বলছিস কেন? তোর কি সমস্যা হয়েছে বল?" তখন আগাগোড়া ব্যাপারখানা বলতে বাধ্য হয় সুখেন। জানি না এই ধরনের কথাবার্তায় সুখেন-জয়ির ভালোবাসার নীড় কতটা দৃঢ় হচ্ছে। 

    প্রেম মানেই নানান ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণা, হাসি-কান্না, উত্থান-পতন-- এ যেন তরকারিতে লঙ্কা-মরিচ। এগুলো না থাকলে প্রেম মূল্যহীন। সেটা এই যুগলের কেউই ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারে না।
 
    হঠাৎ এক রাত্রে জয়ির পাশের রুমে মণিকা নামের একটি মেয়ের তীব্র পেটের যন্ত্রণা শুরু হয় যেন প্রাণ বিয়োগ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এদিকে বাড়ি মালিক কোনো সুরাহা করতে না পারায় জয়ি দু'চার জনকে সঙ্গে নিয়ে অদূরবর্তী একটি গ্রামীন হাসপাতালে ভর্তি করায়। দণ্ড চার চিকিৎসা করানোর পর মণিকার দেহের কোনো উন্নতি না ঘটায় সকলেই জঙ্গলাকীর্ণ পথের মধ্য দিয়ে একটি গাড়িতে করে অন্য এক হাসপাতালে ভর্তি করে। এদিকে জয়িতা বাড়ির লোক সবাই চিন্তিত। কারণ দস্যু-ডাকাতদলের প্রাদুর্ভাব খুবই বেশি ছিল। জয়িতা'র পিসি মীরা জয়িতাকে ঐখান থেকে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য জোরপূর্বক ছাড়িয়ে আনে। এতে জয়িতার মনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। তার বন্ধুবান্ধবরা তার বাবা এবং পিসি মীরা সম্পর্কে জানি না কীরকম মত পোষণ করবে...। দু-দিন পর জয়িতা হাসপাতালে মণিকাকে দেখে এলে পর মনের মধ্যে ওঠা ঝড় কিছুটা শান্ত হয়।

    ধীরে ধীরে উভয়েই এগিয়ে যায় কলেজ জীবন ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সিধু-কানু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সুখেন্দু রিমোর্ট সেন্সিং ও জয়িতা ইতিহাসে এম. এ নিয়ে। এরপর জয়িতার জন্মদিনে সুখেন এক পার্টির আয়োজন করে, যা কিন্তু জয়িতা প্রথমে জানত না। সেদিনে বিকেল বেলায় ফোন করে নির্দিষ্ট স্থানে জয়িতাকে ডাকে সুখেন। কথামতো হাজিরও হয়। আর সেই পার্টিতে সুখেন তার বেশ কিছু বন্ধু এবং জয়ি'রও বেশ কিছু বন্ধুকে আমন্ত্রণ করে। আর এসব মোটেই পছন্দ করত না জয়ি। তা সত্ত্বেও সুখেনের পাল্লায় পড়ে আজ তাকে আসতে হয়েছে। এখন আর দিদি, জামাইবাবুর ভয় নেই; এখন অনেকটাই স্বাধীন। তবুও যেন কোথাও একটা ভয় থেকেই যায়। সেদিনকার জন্মদিনের পার্টির পুরো খরচটাই অবশ্য জয়িতা মিটিয়ে দেয়।

    জয়িতা যখন সুখেনের প্রেমে আকন্ঠ ডুব দিয়েছে অমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এসে সেই ডুবের বুদবুদ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। তার কারণ শুধু যে মীণাক্ষী নয়, একাধিক নারী। নারীরা যদি এক পুরুষে তৃপ্ত হতে না পারে, তবে পুরুষরাই বা হবে কেন?---একথা সত্যি।

    জয়িতা বেশ কয়েকবার বাসা বদল করে, তার কারণ সে তার প্রেমের কথা অন্য কাউকে ব্যক্ত করত না, আর তারাও নাছোড়বান্দা হয়ে উঠত। এইরকম পূর্বের একটি মেসে রিমদি নামের একটি মেয়ের ছেলেবন্ধুর সঙ্গে জয়ি'র সম্পর্ক বাঁধাবার চেষ্টা করে। কারণ জয়ি বলেই দিয়েছিল যে,-- 'আমি কোনো প্রেম-ট্রেম করি না।' যার জন্য রিমদি এইরকম অনুঘটকের কাজটি করতে গিয়েছিল, কিন্তু পরে অবশ্য ব্যর্থ হয়। বন্ধুর ঘনিষ্ঠতার সূত্রে মীণাক্ষী সুখেন্দুকে একটি ল্যাপটপ কিনে দেয় তার রিমোর্ট সেন্সিং -এ কাজে লাগার জন্য। একথা জয়ি জানতে চাইলে সুখেন্দু তাকে মিথ্যা কথা বলে যে--'আমার মামা এটা কিনে দিয়েছে।' তখনকার মতো একথা মেনে নিল জয়িতা। হঠাৎ একদিন কলকাতা যায় সুখেন্দু মীণাক্ষীকে ডাক্তার দেখাতে। মীণাক্ষীর সমস্যা ছিল ওভারি-তে। যথারীতি বাড়ি ফিরতে বিলম্ব হলে কাকতালীয়ভাবে জয়ি হঠাৎ ফোন করে সুখেনের অবস্থান জানতে চায়। তখন ট্রেনে পাশে বসে থাকা মীণাক্ষী'র কন্ঠের আওয়াজ পেলে, নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সুখেন্দুকে। জয়ি বলে--'তোর পাশে আমি পরিষ্কারভাবে মীণাক্ষীর কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি।' তখন সত্যি সত্যিই শীতকালেও ঘামতে শুরু করে সুখেন। সে নিশ্চুপ, নিরুত্তর--প্রথমটা এইরকম হলেও বলে যে, 'আমি কলকাতায় বেশ কয়েকটা বই কিনতে গিয়েছিলাম।' এবার সুখেন জয়িকে ঠকালেও জয়ি অবশ্য নিজে ঠকতে চায়নি।

    জয়ি এবার ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে--কার কাছ থেকে কত টাকা ধার নিয়ে আর শোধ করেনি, সুখেনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সুন্দরী অধ্যাপিকা শ্রীতমা সুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কসহ একাধিক কু-কীর্তি। জয়ি এখন তার ভাগ্যকেই দোষ দিতে চায়। সুখেন্দু-কে বিয়ে করে সুখের নীড় বুনতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই সুখেন এখন জয়িতার কাছে 'ডুমুরের ফল'। জয়িতা যেন তার প্রেমের দর্পনে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল।                      
পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments