জ্বলদর্চি

আমার নীরস কৈশোর/তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার নীরস কৈশোর

তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

ঠিক প্রেমেরও না, আবার অপ্রেমেরও না, এ হবে নাতিশীতোষ্ণ স্মৃতিগদ্য। প্রেমে ধপাস হন সকলেই, বহুবার না হোক একবার হলেও, বহুতরফা না হোক একতরফা হলেও, বছর-বছর না হোক, সত্তর বছরে একবার হলেও। যে বয়সে ছেলে মেয়েরা একে ওপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে, একে অপরের দেহসৌষ্ঠব সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হয়, সেই বয়সে আমি ছিলাম একটু চাপা স্বভাবের, রক্ষণশীল। ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের মতো ফিলোফোবিয়া (প্রেমে পড়তে ভয়), বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মতো গাইনোফোবিয়া (নারীভীতি) আর ভিনাস্ট্রাফোবিয়ার (সুন্দরী মেয়েদের প্রতি ভয়) হালকা একটা মিশ্রণ (ব্যাপারটা প্রগাঢ় ছিলোনা অবশ্যই) ছিলো হয়তো মস্তিষ্কে তখন। মেয়েদের কাছে কি বিরক্তিকরই না ছিলাম ভাবুন! কি ভাবছেন এখন আক্ষেপ হয় কিনা? আমার ওইধরনের ভীতিগুলো পরে কেটেছে। তার জন্য আমার সকল বান্ধবীদের অসংখ্য ধন্যবাদ দেবো। এই সংখ্যায় যে বয়সের ঘটনা বলবো সেটা আমাদের কৈশোরের- সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ের। এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে অমন প্রেমাকর্ষণ অনুভব করার বয়স বোধহয় আরেকটু কমে গেছে,- পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছেলেমেয়েরাই প্রেম-টইটুম্বুর। আগামীতে কমে কমে কোন বয়সে গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল!

  যাইহোক, যা বলছিলাম, আমি সেইসময় সমবয়সী মেয়েদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকারই চেষ্টা করতাম। আমাদের ছেলেদের ভাঙামোড়া এন.কে.এন.সি.এম ইন্সটিটিউশন বিদ্যালয়ের পাশেই ছিল মেয়েদের  ভাঙামোড়া সারদামণি বালিকা বিদ্যালয়। প্রেম নামক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যই বোধহয় প্রবীণ মানুষেরা দুই বিদ্যালয় শুরু হওয়ার সময় আধ ঘণ্টা আগুপিছু করে রেখেছিলেন। আমাদের বিদ্যালয় শুরু হতো বেলা ১১ টায় আর মেয়েদের বিদ্যালয় ১০ টা ৩০ এ। সময়দুটো এক হলেও হয়তো তখনকার সাইকেলে যাওয়া ‘আমি’র ডানহাত, উল্টোদিক থেকে সাইকেলে আসা কোনও মেয়ের বাঁহাতে ছোঁয়াছুয়ি হতে পারতো। আমার মতে সব বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা (কো-এড) করে দেওয়া উচিৎ। গোটা দশেক প্রেম ঠোকাঠুকি হবে, দু-তিনবার ফেল হবে পরীক্ষায়, তবু মেয়েদের সাথে সহজ হয়ে যাবে অগাকান্ত ছেলেগুলো।

   যাইহোক, আমার বিরক্তি উদ্রেককারী কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করি। তখন আমি প্রথম হতাম প্রত্যেক শ্রেণীতে। আমার এক বান্ধবী, মেয়েদের বিদ্যালয়ে প্রথম হতো। সপ্তম, অষ্টম, নবম করে করে যতো উঠতে লাগলাম, একজন করে ব্যক্তিগত শিক্ষক বাড়তে লাগলো। সেই বান্ধবীও পড়তে যেতে লাগলো সেখানে। এমন হিংসুটে ছিলাম যে একদিন তাকে বলেই ফেললাম, “আমি যেখানে পড়তে যাবো, তোকেও সেখানে যেতে হবে!” মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলো সে। যেখানে ওই বয়সের ছেলেরা চায় যে কোনও মেয়ে আসুক, পাশে পড়তে বসুক, তাতে পড়া হোক-না-হোক বেশ রোমাঞ্চকর লাগবে ব্যাপারটা, সেখানে আমি সমমেরু হয়ে করেছি বিকর্ষণ! অনেক পরে বোধোদয় হতে ক্ষমা চেয়েছিলাম সেই বান্ধবীর কাছে।

   আরেকদিনের ঘটনা। পড়তে যাচ্ছি পাশের গ্রামে। কিছুদূর যাওয়ার পর যোগ দিলো সেই বান্ধবী। খালের বাঁধে একটি বড় গর্ততে বান্ধবীর সাইকেলের সামনের চাকা গেলো ঢুকে আর বান্ধবী ধপাস। আমি হাত এগিয়ে দিয়ে তাকে উঠতে সাহায্য করার জায়গায় সব দাঁত বের করে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলাম। যাতা কাণ্ড একেবারে!

   নবম শ্রেণীতে ইংরাজি পড়তে যেতে হতো গ্রাম থেকে একটু দূরে, তারকেশ্বরে। অনেকটা পথ বাসে করে যেতাম-আসতাম। যতদূর মনে পড়ছে, আমি আর আমার এক বন্ধু ছাড়া বাকি তিনজনই ছিল মেয়ে। আমার ছেলে-বন্ধুটি পুরোটা পথ সাইকেলেই যাতায়াত করতো। সন্ধেয় বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় মেয়েগুলো স্বাভাবিকভাবেই চাইতো কোনও ছেলে (বাকি থাকা আমি) সঙ্গে থাকুক, কমপক্ষে বাড়ির আশেপাশে পৌঁছনো পর্যন্ত। ওদের অমন চাওয়াতে কোনও ভুল ছিলো না। কিন্তু, আমার মতো বিরক্তিকর, অবুঝ প্রাণীর তখন মাথায় আসতো না ওসব। আমি পড়া শেষ হলেই গোঁয়ার-গোবিন্দের মতো হনহন করে বেড়িয়ে যেতাম মেয়েদের দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে। এমনিই ছিলাম রোগাপ্যাটকা, তার ওপর মেয়েদের প্রতি ভয়। একদিন মেয়েগুলো শিক্ষককে অভিযোগ করেই বসলো যে আমি ওদেরকে সঙ্গ দিইনা। ব্যাস! মাস্টারমশাইয়ের ধমক খেয়ে দায়িত্ব নেওয়া শুরু হল। ফেরার বাসগুলোতে যেখানে পিঁপড়ে গলবার জায়গা থাকতো না, সেখানে আমি আর ওই তিনটি মেয়ে যে কিভাবে গলতাম আর পথপ্রদর্শকের (কন্ডাক্টর) পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতাম, সে অবস্থা অবর্ণনীয়। প্রায়শই এমন হতো, ভিড়ের ঠ্যালায় বাসচালকের খুপরি-বিভাজক দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনও এক বান্ধবী আর আমি মুখোমুখি। মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চাওয়া সতর্ক কিন্তু সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, কর্তব্যপরায়ণ আমি, বাকি ভিড় থেকে বা অপরিচিত-চ্যাংড়া-বোধ-হওয়া-ছেলে বা পুরুষদের থেকে তাকে রক্ষা করতে চুপিচুপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোনও কোনও দিন অমন অবস্থাতেই আমার দুহাত বান্ধবীর মাথার দুপাশ দিয়ে সামনের দেওয়ালে ঠেক দিয়ে (যাতে তার ওপর না পড়ে গিয়ে মুখ-অরোচক খিস্তি খাই), আমার পিছনের অসহনীয় ধাক্কা সহ্য ও প্রতিহত করতে করতে, ‘তুষারিত গতিহীন ধারা’র মতো, কুড়ি মিনিটের পথ এসেছি। বান্ধবীর মাথার ওপর দিয়ে আমার দৃষ্টি সামনের দেওয়ালে সাঁটানো মা কালীর ছবিতে স্থির রাখতাম। বান্ধবীর চোখে অতক্ষণ নিষ্পলক চোখ রাখলে যদি প্রেমের মতো অদ্ভুতুড়ে কিছু তাড়া করে! অতো কাছাকাছি থেকেও উত্তেজনা আসার জায়গায় আসতো অসম্ভব ভয়, প্রেম হয়নি। আরও ভয় পেতো বাস চালক যদি হচাং করে ব্রেক কষে দেন কি খিচুরিই না তৈরি হবে! ঠোঁট মুখ সব একাকার হয়ে যাবে তো! তারপর যদি আমারই দোষ ছিলো বলে আমায় এক থাপ্পড়ে দাঁতকপাটি ঝরিয়ে দেয় সেই মেয়ে! ওরে বাবা! দুঃস্বপ্ন। আসলে দুরুদুরু বুক কখনো প্রেম হওয়ায়ইনি। এমন আকাট মূর্খ দেখেছেন কোথাও? তখন বুঝতামই না মেয়েরা সবার প্রতি গরম হয়না, কারোর কারোর প্রতি নরমও হয়।

   তবে আমি অনেকের প্রেমে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলাম, চিঠিবাহক হিসেবে কাজও করেছি ওই বয়সেই। একবার তো এক বন্ধু তার তৎকালীন প্রেমিকাকে পাঠানোর জন্য লেখা প্রেমপত্র আমায় দিয়েছিলো, ঠিক মনে নেই,- হয় প্রেমপত্র কেমন হয়, নয়তো কেমনভাবে লিখতে হয় সে পাঠ শেখানোর জন্য বা এমনিই গচ্ছিত রাখতে। বলেছিল,- “ঘরে গিয়ে খুলে দেখবি গোপনে”। আমি ভুলে যাই দেখতে। পরেরদিন প্যান্ট কাচতে গিয়ে আমার মা পকেটে পান সেই প্রেমপত্র। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো এই কারণে যে সেই প্রেমপত্রে আমার সুচতুর বন্ধুটি কারোর কোনও নামোল্লেখ করেনি। ওপরে প্রাপককে সম্বোধনের জায়গায় লেখা ছিল “প্রিয় আমার তুমি”। আর পত্রপ্রেরকের নামের জায়গায় রক্ত দিয়ে লেখা ছিল,- “ইতি তোমার আমি” আর সাথে একটি বড় করে পানপাতার মতো হৃদয়ের চিহ্ন। পত্রগর্ভে যে সব স্বপ্নরাজ্য আঁকা ছিল সেসব কাপড়কাচা সাবানের জলে ধুয়ে গিয়েছিলো। আমার মায়ের রাগ হয়েছিল এই কারণে যে আমি নাকি না জানিয়ে প্রেম করছি ওই ‘আমার তুমি’র সাথে, আর তার চেয়েও বড় কথা হাত কেটে রক্তদানের মতো অমন অতুলনীয় কাজ করেছি।

   সরস্বতী পুজো ছিলো একটা অন্যরকম পুলকের বিষয়। চেনা মেয়েগুলোকেই অন্য অচেনা রূপে দেখতে বের হতো ছেলেগুলো বিশৃঙ্খল ভাবে। ওইদিনই মেয়েদের বিদ্যালয়ে ঢোকা যেতো। যদিও আমি ভয় পেতাম- যদি দিদিমণিরা পূজোর ফল রাখার বারকোশ হাতে তাড়া করেন! এক ডেঁপো, এঁচোড়েপাকা, অকুতোভয় বন্ধু আমায় টেনে হিঁচড়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকিয়েছিল একবার। বাইরে থেকে সরস্বতী প্রতিমার খানিকটা দূরদর্শন হয়েছিলো বটে, তবে বাকিটা হয়েছিলো শ্রীমতীদর্শন।
কখনো মন্দিরের পিছনে বা কখনো বালির চড়া পড়া দামোদর-নদীখাতে, আমার কিছু প্রেমিক বন্ধু আর তাদের তখনকার প্রেমিকাদের কিছু চুমু-মুহূর্ত উপহার দেওয়ার আর গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদে,- কখনো কোনও অপরিচিত লোকের আলু-জমি মাড়িয়ে আলের ওপর অথবা কখনো দামোদর-নদীতটে সতর্ক হয়ে (কেউ ওদিকে আসছে কিনা লক্ষ্য রাখতে) ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়েও থেকেছি আমি আর আমার মতো নীরস-বিরস, আহাম্মক, গদ্যময়, গতানুগতিক দর্শকবন্ধু কয়েকজন। আমার সেইসব প্রেমিক বন্ধুগুলোকে ধন্যবাদ দেবো বৈচিত্র্যময় এইসব স্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. প্রেম একটা সহজাত ব্যাপার। আর ভয় একটা অমূলক জিনিস। কেউ আরশোলা দেখলে ভয় পায় আর কেউ তাহলে অনুচ্চারিত শব্দে গান গেয়ে চলে প্রে"একবার এসেছিল নীরবে" তথাগত এরকম কমবেশি প্রেমময় স্মৃতিকথা সবার আছে। তারা এ লেখা পড়ে একবার ডাউন মেমোরী লেন হবে- বলে দিচ্ছি। (গৌতম বাড়ই)

    ReplyDelete