জ্বলদর্চি

প্রেম ভুবনের একটি প্রেম/গৌতম বাড়ই

প্রেম ভুবনের একটি প্রেম

গৌতম বাড়ই

(১৪- ই ফেব্রুয়ারি প্রেম দিবস‌ উপলক্ষে) 

সেইসময়ে দুরন্ত সব প্রেম ছিল কিন্তু প্রেমের জন্য বছরের একটা বিশেষ দিন বরাদ্দ ছিল না। এখন কোথায় সেই প্রেম ভুবন! প্রেম নেই, প্রেম নাই। অথচ প্রেমের নামে দুরন্ত প্রেম বন্দনায় একটা বিশেষ দিন। ভ্যালেন্টাইনস ডে। প্রেম দিবস- ই বলব গোদা বাংলায়। ১৪- ই ফেব্রুয়ারী। পৃথিবীর সব প্রেমগুলো হারিয়ে আজ প্রেম দিবসে স্মৃতির সেইসব দুরন্ত প্রেমগুলো খুঁজে বের করি। 

  একটা মিষ্টি প্রেমের আর দুরন্ত প্রেমের গল্প দিয়েই আমার স্মৃতিরএকটি প্রেম ফিরিয়ে আনছি। আমার কিশোরবেলায় এক স্কুলের বন্ধু ছিল, নাম তার প্রদীপ। তখন আমরা ক্লাস নাইন আর প্রদীপ ক্লাস নাইনে ফেলের হ্যাটট্রিক করবে এবারে পাস না করলে এবং আমাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত হবে সে। তাতে কী? কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। 

  প্রদীপের কাছ থেকেই হরদম সেই নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প শুনি আমরা। ও মাঝে- মাঝেই এক একটা মেয়ের প্রেমে পড়ত। আর প্রেম শব্দটি শুনলেই আমরা সবাই যেন  কেমন কুঁকড়ে উঠতাম। প্রেম শব্দটি বড় নিষিদ্ধ ছিল, চট করে বড়দের সামনে তখন ঐ শব্দটি উচ্চারণ করা মানে গর্হিত কোন কাজ। বরং ভালবাসা শব্দটি অনেক বেশি মোলায়েম। তাই প্রেম মানেই নিষিদ্ধ। প্রদীপ দু- চারদিন স্কুলে মাঝেমধ্যেই ডুব মারে। স্যারেরা ওকে বাতিলের খাতায় রেখে দিয়েছেন। ওকে ক্লাস টেনে প্রমোট করা মানেই স্কুলের বহুত বদনামী। মাধ্যমিকে যে ফলের ঝুড়ি মাথায় করে আনবেন তাতে আমাদের হেডস্যার তেজনারায়ণ সাহার সম্মান হবে পুরে মিট্টি মে মিলা দিয়া!

  একবার এরকম ডুব মারবার তিন- চারদিন পর  ক্লাসে মিটিমিটি হাসতে হাসতে মহারাজ ঢুকলেন। আমরা প্রেম কৌতূহলে তাকিয়ে রয়েছি। আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে সেই মস্ত দাঁড়ি গোঁফের প্রদীপ বললে-- "সব টিফিন পিরিয়ডে হবে। আমি ভাই প্রেমে পড়েছি আবার। একদম বিজয়েতা পন্ডিতের মতন দেখতে"। প্রসঙ্গে বলি তখন "লাভ -স্টোরি" বলে একটা বেজায় হিট হিন্দী ছবি বাজারে চলছে। তাতে টিন এজার নায়ক- নায়িকা কুমার গৌরব আর বিজয়েতা পণ্ডিত। আবার সেই নায়িকার মতনের সাথে প্রদীপের প্রেম। আমরা ওয়াও! করে উঠি। প্রদীপ বলে নায়কোচিত কায়দায়-- "ইয়ে বাত সহী হ্যায় দোস্ত"। কথার কায়দায় আর সাজগোজে প্রদীপকে দুবারের নাইন ফেলটু  মনেই হত না। বচ্চনের মতন কান ঢাকা চুল। দুর্গা স্যার বলতেন-- "তোর পড়ালিখা করে কাম নাই। বাবার গালামালের (মুদিখানা) দোকান সামলাগা যা"। শহরের এক বড় নামকরা মুদিখানার মালিক ওর বাবা। আড়ালে সবাই বলে, নাড়ুবাবুর বাড়িতে বস্তা-বস্তা টাকা আছে কিন্তু এক ছটাক সরস্বতী নাই। আমরা আড়ালে বলতাম -- আর লক্ষ্মীর সাথে আরও আছে কিছু প্রেম- প্রেম এই নাড়ুলালের বাড়িতে। টিফিন পিরিয়ডে গল্প শুরু হল।

  জবার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি রে। তিনদিন তো ওদের বাড়িতেই ছিলাম। ---- প্রদীপ শুরু করল এই বলে।

  আমরা বললাম-- মানে ? তুই প্রেম শুরু করতে না করতেই প্রেমিকার বাড়ি? 

  -- না রে! তার কারন আছে। আমার মেজ মামার শালী তো জবা। মেজ মামার বিয়েতে গিয়ে পরিচয়। বিবেকানন্দ পল্লীতে। তারপর রোজ যাই। দুপুরে থাকি। বিকেলে আসি। বিকেলে যাই। রাতে ফিরি। একটাই সমস্যা উঁচু ক্লাসে পড়ে। কলেজে। নো সমস্যা। আমিও পাস দিলে ঠিকঠাক কলেজেই যেতাম। একদম বিজয়েতা রে! আহ! কী বলব তোদের সেইথেকে  ঘুম নেই, খাওয়া নেই। কী করে যে সময় কাটছে! আজ জোর করে ছোটোমামা এসে কানটি মুলে দিয়ে স্কুলে পাঠাল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে জবার সাথে দেখা করে যাব। জবাকে ছাড়া বড় শূন্য শূন্য লাগে এ পৃথিবী।

  কাম সারছে। আমরা প্রদীপের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম। তারপর সব শোনার পর বললাম- কিন্তু তোর মামার শালী যে? 

  প্রদীপ ঘাড় সোজা করে বলল--- তাতে কী? পিড়িতে মজিলে মন কিবা হাড়ি কিবা ডোম। পিরিতী কাঁঠালের আঁঠা শুনিস নি পূর্ণ বাউলের গান? মেজোমামা আর মামী ওদের মতন থাক। জবা আমার লাভার।

  লাভার! এই নতুন শব্দে আমরা আনকোড়া প্রেমহীন সব ভড়কে গেলাম। তারপর পুরো জবাময় হয়ে দিন সাতেক প্রেমের হর কিসিমের গল্প শুনি নেশার মতন প্রদীপের কাছে আমরা স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে।

  প্রদীপ আবার ডুব মেরেছে। আমরা প্রদীপের নতুন কোন প্রেমের গল্পের অপেক্ষায় রয়েছি। জবা পর্ব বোধহয় অন্যান্য টিয়া, কবিতা এদের মতন যবনিকা টানল। একমাস হয়ে গেল কোন খবর নেই। তবে প্রদীপ কি মামাদের মারধোর গেল? ওর ছোটোমামা আর রাঙাকাকা তো শহরের ষণ্ডামতন চেহারার গুন্ডালোক। দু-জনেই। আমরা এবার চিন্তা করছি। প্রদীপের কী হল? সরস্বতী পুজোর দিনে কলেজের মাঠে শেষবারের মতন প্রদীপ আর জবাকে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল- ক্লাস নাইন সেকশন বি- র সন্দীপন এ- খবরটা দিয়েছিল আমাদের। পরে জানলাম একদম সত্যি এ কথাটি।

  তারপর পাকাপাকি ভাবে যে খবরটা এল তা পিলে চমকে দেবার মতনই। দুর্গা স্যারের মুখেই শুনলাম।
স্যার বললেন তার সেই জমিয়ে কথা বলবার ঢঙ্গে বাঙাল টানে -- তোরা কী জানিস প্রদীপ তো এখন হিরো হীরালাল? মামার শালীরে নিয়া ভাইগ্যা গ্যাছে। বিয়া করছে দূর দেশের কোথাও। থানা- পুলিশ, হৈ- হুজ্জোত ম্যালা ব্যাপার-স্যাপার। এই শুনে তোদের কি বিয়া করনের সাধ জাইগ্যা উঠলো না তো? ভয় পা। এই বয়সে এই বিয়া- করন কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যাকরণ বহির্ভূত ব্যাপার। আইন লাইগে যাবে পেছনে। 

  তারপর অনেকগুলো বছর। মাঝে অনেক ঘটনা। প্রদীপ আর জবার তিনটি বড়-বড় ছেলেমেয়ে। বড় মেয়ে আর বড় ছেলের বিয়েও হয়েছে। ছোটো ছেলেটি পড়াশোনা করছে রাজ্যের বাইরে অন্য শহরে। আমাদের  শোনা  সেই ভ্যালেন্টাইন ডে- ছিল সরস্বতী পুজোর দিনে। সেইসব দূরন্ত প্রেম নেই। কিন্তু রীতিমতন প্রেম দিবস বরাদ্দ এখন- ১৪- ই ফেব্রুয়ারী। বেঁচে থাকুক প্রেম। তবে রবি ঠাকুর যে বলেছিলেন-- "প্রেমের মৃত্যু হয় বিবাহে"। প্রদীপ আর জবাকে এখনও দেখলে তা কিন্তু মনে হয় না। কারণ কর্মসূত্রে অন্য শহরে বাস করলেও, যখনই নিজের শহরে ফিরে আসি ভূমির টানে, মুদিখানার  জিনিসপত্র কিনি  আমিও যে এখন ঐ প্রদীপ- জবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে।  নাড়ুলাল আর ঝড়ুলাল রায়ের ঐ বিশাল মুদিখানাও ভেঙ্গে দু- টুকরো হয়েছে। প্রদীপ- জবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস- এ জবা কাউন্টারে ক্যাশ সামলায়। প্রদীপ দেখাশোনা করে। আমাদের দেখলে মুচকি হাসে, কখনও গল্প করে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments