জ্বলদর্চি

একজন পত্রলেখক বা নষ্টপ্রেমের গল্প/মুক্তি দাশ

একজন পত্রলেখক বা নষ্টপ্রেমের গল্প

মুক্তি দাশ

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিক। সেসময় প্রেম ব্যাপারটা এখনকার মতো এমন জলভাতের মতো সহজলভ্য ছিল না। আজকালকার মতো কথায় কথায় প্রকাশ্য দিবালোকে প্রেমের ছাড়পত্রও ছিল না। সে-যুগের ভুক্তভোগী প্রেমিক বা প্রেমিকামাত্রই মাত্রই তা অনুধাবন করেছেন। তখনকার প্রেম বলতে গেলে এক দুঃসাহসিক অভিযান। সেকালের কত অনুচ্চারিত প্রেমেরই যে আঁতুড়েই সমাধি ঘটেছে, তার ইয়ত্বা নেই। তাই তখনকার দিনের প্রেমে সুখের চেয়ে বেদনার প্রাবল্য ছিল বেশি। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ববন্দিত কবিকেও একথা স্বীকার করে নিতে হয়েছে – ‘সখি, ভালোবাসা কারে কয়…সে কি কেবলই যাতনাময়?’ তখন প্রেম-যাপনের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে থাকত খালি বিরহ বিরহ আর বিরহ! শুধু ‘বিরহ’ নিয়েই কত যে কাব্য-কবিতা রচিত হয়েছে!

   সুখের কথা, কালের স্রোতে অনেক সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর মানুষ। এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের তাই অত ‘বিরহ-যাতনা’ সহ্য করার দায়ও নেই। তারা সংবেদনশীল বা আবেগ-তাড়িতও নয়। শুধু কি সামাজিক পরিবর্তন বা বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতিই এর কারণ? আমি বলবো, না। এর আরও একটা প্রচ্ছন্ন কারণ রয়েছে। আর তা হলো ওই ‘প্রেম’ শব্দটির সংজ্ঞা। এখনকার দিনের প্রেমিকরা বেশ ভেবেচিন্তে রাতে শোয়ার সময় ঠিক করে নেয় তার পরিচিত মেয়েদের মধ্যে কার সংগে প্রেম করা যায় বা কাকে প্রপোজ করা যায়! তারপর পরিকল্পিতভাবে পরেরদিন হয়তো মেয়েটিকে প্রপোজ করে বসে। মেয়েটি একবার রাজি হলেই কেল্লাফতে! খুব বিরল হলেও মেয়েরাও এইভাবেই ছেলেদের প্রপোজ করতে পারে। তারপর আবার ‘আই লাভ য়্যু’–ও বলাটাও আবশ্যিক। অনেককে আবার বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা করতে শুনেছি, ‘জানিস, ক’দিন থেকে আমার খালি প্রেম-প্রেম পাচ্ছে।’ অতএব শিগগির একটা প্রেম করে ফ্যালো! এইভাবেই এখনকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই প্রেম করে। হ্যাঁ, আবার বলছি, তারা প্রেম করে। অর্থাৎ, ব্যাকরণগত ভাবে এখানে প্রেম করা ‘ডু-ভার্ব।’

   কিন্তু তাদের জানা উচিত, প্রেম একটি অনুভূতিমাত্র। এবং তা সবসময়েই ‘বী-ভার্ব’। ‘ডু-ভার্ব’ নয়। প্রেম কেউ করে না। প্রেম হয়ে যায়। কখন হয়ে যায় তা কিন্তু প্রথমে দু’পক্ষের কেউই জানতে পারে না।.তারপর একসময় যখন তারা উপলব্ধি করতে পারে, মুখ ফুটে ‘আই লাভ য়্যু’ বলার প্রয়োজনও পড়ে না। তবে সেকালে সবারই যে প্রেম হয়ে যেত, তা কিন্তু বলছি না। কেউ কেউ এখনকার মতো প্রেম করতোও।

   যাইহোক, আমার নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতার কথা খুব সংক্ষেপে এবার ব্যক্ত করব। সেটা ১৯৬৮ সাল। আমার তখন ক্লাস টেন। এক রবিবার বিকেলের দিকে আমার ক্লাসের ঘনিষ্ঠবন্ধু বিজন (নাম পরিবর্তিত) সাইকেলে করে আমাদের বাড়ি এসে হাজির। বন্ধুটির যেমন আমার বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল, তেমনি তার বাড়িতে আমারও। সেদিন অসময়ে এসে আমার ঘরে ঢুকে প্রথমেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। ভীষণ উত্তেজিত। ফিসফিস করে বলল, ‘কাউকে বলিস না কিন্তু…বলবি না তো? মা-কালীর দিব্যি খেয়ে বল…’
- ‘আরে বাবা, কী হয়েছে বলবি তো…’
- ‘আমি না প্রেমে পড়ে গেছি…’
তখন আমাদের কাছে ‘প্রেম’ শব্দটাই যেন নিষিদ্ধ। শব্দটা শুনলেই গায়ে শিহরণ হতো! বললে বিশ্বাস করবেন না, একবার আরো ছোটবেলায়, মানে যখন সেভেন-এইটে পড়তাম, বন্ধুদের সংগে একবার আমদের সেই মফস্বল শহরের সিনেমাহলে ‘পলাতক’-এর মতো বাজে অশ্লীল বাংলাছবি দেখে ফিরেছিলাম বলে বাড়িতে বাবার হাতে সে কী রাম পিটুনি! জানতে চাইছেন নিশ্চয়ই, ‘পলাতক’ আবার অশ্লীলতার তকমা পেল কীভাবে? না, ছবির কাহিনী অশ্লীল তো নয়ই, বরং বড় বেশি হৃদয়স্পর্শী। তবু তার একটাই দোষ, সেই ছবির একটি গান। গানটির প্রথম দু’টি কলি হলো : ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে…প্রাণেতে সয় না সখী, নাগর গেছে পরের ঘরে…’ ব্যস, হয়ে গেল! এরপরও সে-যুগের মাপকাঠিতে আমার পিতৃদেবকে কি দোষ দেওয়া যায়?
   যাইহোক, বিজনকে বললাম, ‘করেছিস কী? শেষপর্যন্ত তুই ওইসব করলি? ছ্যাঃ ছ্যাঃ…তোর বাড়িতে জানলে কী হবে জানিস?’
- ‘সবই বুঝলাম, কিন্তু কী করি বল? তুই তো আমার প্রাণের বন্ধু, আমাকে বাঁচা…’
গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘মেয়েটা কে?’
- ‘আমাদের সামনেই মন্টুকাকাদের বাড়ি এসেছে। মন্টুকাকার ভাগ্নী। তমলুকে ওদের বাড়ি। গরমের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। দিন পনের থেকে চলে যাবে।’ 
- ‘তো আমি কী করবো?’
- ‘রাগ করছিস কেন ভাই?....আমার একটা কাজ করে দিবি?’
- ‘কী কাজ?’
   বিজন তার ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বার করল। সেইসংগে রঙিন কাগজের রাইটিং-প্যাড। সেযুগের প্রেম ছিল সর্বৈবভাবে পত্রনির্ভর। আর এই ধরণের রাইটিং-প্যাড বিশেষভাবে প্রেমপত্র লেখার জন্যেই ব্যবহৃত হতো। রাইটিং-প্যাডের কভারে রঙিন ফুলপাতা, গাছ, প্রজাপতির ছবি। মাঝখানে লেখা ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে!’ বিজন রাইটিং-প্যাডটা এমন সতর্কভাবে বার করলো, যেন সে একটা পর্ণোগ্রাফির বই বার করছে। প্রথমে ভাঁজ করা চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে বিজন বলল, ‘আজ মন্টুকাকার বাড়িতে একটা অজুহাত নিয়ে গিয়েছিলাম, দীপু হঠাৎ আমার হাতে টুক করে এই চিঠিটা গুঁজে দিয়ে পালিয়ে গেল!’
- ‘দীপুটা কে?’

    ‘ওর নামই দীপু। পুরো নাম দীপান্বিতা। দীপান্বিতা সিংহ।’ (নাম পরিবর্তিত) তারপর আবার বলল, ‘তুই ওর এই চিঠিটা রাখ, ভালো করে দেখবি, পড়বি…তারপর আমার হয়ে ভালো করে একটা রিপ্লাই লিখে দিবি…তুই তো শালা বাংলায় ওস্তাদ…স্কুলের ম্যাগাজিনেও লিখিস-টিখিস…আজ সারারাত বসে ভেবেচিন্তে একটা রিপ্লাই রেডি করে কাল স্কুলে এসে আমাকে দিস, কেমন? আমি চললাম…’
   সেই শুরু। বিজনের হয়ে দীপুর কাছে প্রায়ই চিঠি লিখে দিতে হতো আমাকে। একদিন দীপুকে চোখের দেখা দেখলামও। দূর থেকে বিজন চিনিয়ে দিয়েছিল। দীপু দিনপনের পরে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু চিঠি লেখা বন্ধ হলো না। বাইপোস্টে বিজনের নামে সপ্তাহে একটা করে চিঠি আসতো। বাড়ির লোকের হাতে যেন চিঠি না পড়ে সেজন্যে বিজন পিওনের সংগে বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই চিঠির জবাব লিখতে হতো আমাকে। শেষপযর্ন্ত এমন হলো, বিজন দীপুর চিঠি খুলেও দেখতো না, আমাকে জবাব লেখার জন্যে দিয়ে দিত। আবার জবাবে আমি কি লিখলাম তাও বিজনের জানার কোনো আগ্রহ নেই। সে শুধু আমার কাছ থেকে জবাবী চিঠিখানা নিয়ে পোস্ট করে দিত। দীপু কোনোদিন জানতেও পারলো না, বিজনের হাতের লেখা ঠিক কেমন? অথবা, তার লেখার ধরণ আদতে কেমন? সে হয়তো আমার লেখা চিঠিগুলোই বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, আর বিজনের কথা ভাবে! আমি জ্বলতে থাকলাম এক অসহনীয় অন্তর্দাহে।   

   আমাকে যেন নেশায় পেয়ে বসলো। আমার ক্রমে মনে হতে লাগলো, বিজনের দীপুকে ভালোবাসার কোনো অধিকারই নেই। দীপু কোনোদিনই বিজনের নয়। হতে পারে না। দীপুর সুখ-দুঃখের কথা বিজনের চেয়ে আমিই তো বেশি জানি। তবে কেন দীপুর প্রতি বিজনের দাবী থাকবে? তার বাড়ির সামনে দীপুর মামার বাড়ি বলে? শুধু এই কারণে? 

   আমি তখন প্রায় পাগল! রাতে ভালোমতো ঘুমোতে পারতাম না। দীপুর কথা ভাবতাম। দীপুর চিঠির কথা ভাবতাম। দীপুর চিঠির জন্যে যুৎসই প্রেমের ভাষা খুঁজতাম। এইভাবে বছরখানেক চলার পর হঠাৎ দীপুর চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে বিজন কিছু ভাবতো কিনা জানি না। কিন্তু আমি ভয়ানক আশা নিয়ে থাকতাম, এইবার দীপুর চিঠি নিশ্চয়ই আসবে। 
এইভাবে একটা বছর চলে গেল। না। দীপুর চিঠি আর কোনোদিনই আসে নি। শুধু বিজন এসে একদিন বলল, ‘শুনেছিস তো, গতমাসে দীপুর বিয়ে হয়ে গেছে…’ এমন হালকাভাবে কথাটা যেন পাশেরবাড়ির বুঁচকুর বিয়ের কথা বলছে।

   আমার বুকের মধ্যে একটা প্রচন্ড ধ্বস নামলো যেন। ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো, আমি যেন ঝুরো ঝুরো হয়ে জলের স্রোতের টানে ভেসে চলেছি। তবে এই প্রলয়ংকর মানসিক অবস্থার মধ্যে কোথাও যেন একটা প্রচন্ড স্বস্তির অনুভূতিও হচ্ছিল। দীপু আর কখনোই বিজনের হবে না। আহ! কি শান্তি, কি শান্তি!
আপনাদের জনান্তিকে জানাই, বিজন কিন্তু এখনো জীবিত। এই লেখা তার চোখে পড়বে কিনা জানি না। যদি পড়ে, নাম পাল্টে দিলেও বুঝে ফেলবে। আমি যখন দেশের বাড়ি যাই, তখন আমরা খুব গল্প-গুজব করি কিন্তু। এই বুড়ো বয়সেও খুব হাসিঠাট্টা করি। বিজনের বাড়িতে গেলে ওর বউয়ের হাতে চা খেতে খেতে ওদের বাড়ির সামনে মন্টুকাকার সেই বাড়িটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। বিজন কি সেটা বুঝতে পারে?

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments