জ্বলদর্চি

জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেমের অনুভব/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল


"Tru love is like ghosts, which everybody talks about and few have seen."---La Rockyfoulcod.

জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেমের অনুভব

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

প্রেমের কথা লিখতে গেলে প্রথমেই  মনে পড়ে শচীনদেব বর্মনের সেই গান- "প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ ঢেউ দিল, ঢেউ দিল রে আকুল হিয়ার দুকুল বুঝি ভাঙল রে।" আর এই দুকুল ভাঙার ফলে সাজাহান তৈরি করে ফেললেন এক আস্ত তাজমহল। এবং এই সাজাহান বাধ্য করলেন রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে। ডি.এল.রায় পর্যন্ত নাটক লিখলেন। শহর পাড়াগাঁয়ের নাট্য মঞ্চে আজও সাজাহানরুপী যশস্বী নটরা রাতে কেঁদে হাহাকার করছেন। ইতিহাস কি পুরাণ ঘাটলে এ রকম প্রেম হাজার হাজার পাওয়া যাবে। তবে অবশ্য মনে রাখতে হবে, প্রেমিক সাজাহান শেষ পর্যন্ত মরেছিল কারাগারে পচে। তাই বলা যায়- প্রেম আর প্রেমের ফল কখনো এক রাস্তায় চলে না। 
বাজারে বিভিন্ন রকম আনাজ দেখে, কি রান্না হবে ভেবে আনাজ কিনি, তাই রান্নার শুরু হয় যেমন বাজার থেকে। ঠিক তেমনি প্রেম ও শুরু হয় বয়স কালে নয়। সেই হামাগুড়ি দেওয়ার সময় থেকে। ফ্রয়েড তো বলেই গেছেন, শিশুরা মলত্যাগ করার সময় যে জায়গা বদল করে আনন্দ পায়, সেটা হচ্ছে যৌন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। এবং তিনি মনে করতেন সব প্রেমের উৎস শরীরী আকর্ষণ-যৌনতা। সে যা হোক ফ্রয়েডীয় আলোচনা এখানে বিষয়বস্তু নয়। 
এখনকার প্রেমের হালচাল দেখলে মনে পড়ে- স্বামীজির সেই উক্তি- 'বলো, জন্ম হইতেই আমরা মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।" আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেন পরস্পরে বলে, জন্ম হইতে আমি তোমার জন্য বলি প্রদত্ত। তাই পেপার পত্রিকা খুললে, দেখি জোড়ায় জোড়ায় এক সঙ্গে মৃত্যু। নইলে অ্যাসিড ছুঁড়ছে, ছোরা মারছে ইত্যাদি। আমাদের ছেলেবেলা ও প্রেম মার্কেটে ছিল। সে সময় কিন্তু এখনকার মত প্রেমের পাইকারি বাজার ছিল না। তখন কেউ প্রেম করলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতো। বাড়ীর লোকেরা বলতো খবরদার ওর সঙ্গে মিশবে না। যেন তাকে করোনা ভাইরাসে ধরেছে। আবার এও দেখেছি, প্রেম করার অপরাধে কারোর মাথা ন্যাড়া করে, চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে। অনেক বাবা মা প্রেমে পড়া মেয়েকে পাত্রস্থ করতে দোজ-বর হলেও আপত্তি নেই। ছোটোবেলা দেখছি, কলেজে পড়া এক দাদা আর দিদি, প্রত্যেকদিন কলেজ যেত কথা বলতে বলতে, ফিরে আসতো কথা বলতে বলতে। যখন তারা রাস্তায় যেতো আমরা ছোটোরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতাম। আর বড়রা জানালা দরজা দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতো। 

   তা বলে কি প্রেম বন্ধ রেখেছিলাম? তা-ও নয়। ছেলেবেলায় সুকুমার রায়ের লেখা, "এই দুনিয়ায় সকাল ভালো/আসল ভালো নকল ভালো/ সস্তা ভালো দামীও ভালো/ তুমিও ভালো আমিও ভালো।" সত্যি বলতে কি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন পাশের গ্রামের একটি মেয়ে পড়তো আমার সঙ্গে। দেখতে বেশ ভালো। ফর্সা, খাড়া নাক কাজল কালো চোখ। তখন তার দিকে আমি ঘনঘন তাকাতাম। সেও তাকাতো। ঝড়ে পড়া আম বাড়ি থেকে লুকিয়ে তাকে দিতাম। ঐ যে কানাডার প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ 'জন অ্যালান লি' একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন, যার নাম- 'কালারস অব লাভ'- ভালোবাসার রং। তিনি বলতেন মূল রং তিনটি- লাল, সবুজ, নীল। বাকি সব রং এই তিনটি রং-য়ের বিভিন্ন পরিমাণ মিশ্রণের ফল। এর থেকে তিনি বললেন প্রেমের ধরন প্রধানত তিনটি- (ক) ইরোস (Eros) (খ) লুডোস (Ludos) (গ) র্স্টজ (Storge)। ইরোস বলতে মনের চেয়ে শরীরের সৌন্দর্য প্রভাব বিস্তার করে বেশি। এতে তাৎক্ষণিক আবেগ বেশি। চতুর্থ শ্রেণি পাশ করার পর, সে চলে গেল মেয়েদের, আর আমি ভর্তি হলাম co-ed. জুনিয়র হাইস্কুলে। সে প্রেম সেখানেই শেষ।

    এরপর পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, একটি মেয়ের দিকে দৃষ্টি বিনিময় হতো। তখন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতো সেই কথাটা- "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।" এ প্রেম কি প্রেম, তার এতো মানে বুঝতাম না। ঘন ঘন তাকাতাম! মুচকি হাসাহাসি তখনও শুরু হয়নি। সপ্তম শ্রেণীতে যখন উঠলাম। তখন তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে একটু মুচকি হাসি শুরু হল। তখন ক্লাসে এলে মেয়েদের বেঞ্চির দিকে আগে তাকাতাম, সে এসেছে কি না। যেদিন না আসতো ভীষণ খারাপ লাগতে। তখনও আমার মধ্যে 'ইরোস' কাজ করে যাচ্ছে। শরীর সৌন্দর্য এর সাথে কামনা একটু একটু জাগছে। তখনই ক্লাসের অন্য ছেলেদের মধ্যে শুরু হলো আমাকে নিয়ে গুঞ্জন। অষ্টম শ্রেণিতে একটু একটু করে ভিত গাড়ছে- তুমি আমার, আমি তোমার। তখন সবেমাত্র মার্কা হতে শুরু করেছি। এ তার সঙ্গে, ও তার সঙ্গে। তখনও কিন্তু আমার আর তার মধ্যে শুধুই আকার ইঙ্গিতের মধ্যে প্রেম ছিল। টিফিনের সময় যখন ক্লাসে কেউ থাকতো না, সে যেখানে গিয়ে বসতো, সেখানে বসতাম বা হাত ছোঁয়াতাম। তার খাতা খুলে হাতের অক্ষর দেখতাম। যখন ধুলার উপর হেঁটে যেত, চারিদিকে লক্ষ্য করে তার পায়ের ছাপে পা রাখতাম। আর স্কুল যাওয়া আসার পথে ফনী মনসার গাছে, গোপনে লিখতাম তার প্লাস আমার নাম। তখন কিন্তু এখনকার মতো প্রেম জেনারেল নলেজে পরিণত হয়নি। যেমন এখন জেনারেল নলেজ না জানলে সবাই মূর্খ ভাবে। তেমন প্রেম না করলে বন্ধুরা গণ্ডমূর্খ বলে।

    এরপর মেয়েটি অষ্টম শ্রেণিতে পাশ করে নবম শ্রেণিতে উঠার পর চলে গেল মেয়েদের স্কুলে। আমিও চলে গেলাম বয়েজ স্কুলে। দুটো স্কুল একই রাস্তায়। তাই রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতাম ও কখন স্কুলে যাবে। মেয়েটি যখন আসতো তখন ওর পেছনে পেছনে একটু দুরত্ব রেখে হাঁটতাম। আমার মধ্যে যে প্রেম কৈশোরের পবিত্রতা- তা নষ্ট হতে বসছে। যা যৌবনের গতি শক্তি স্বপ্ন, তা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তখন আমার চোখ ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে লম্পটের চোখে। এ চোখের দৃষ্টি এমন- মনে মনে একটি মেয়েকে উলঙ্গ করে দেয়। না বলা একটা ঈঙ্গিত থাকে। মাঝে মাঝে মেয়েটি আড়চোখে দেখতো আর মুচকি হাসতো। তাতে আমি সাহস পেয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা তার বাড়িতে গেলাম। দরজায় গিয়ে নাম ধরে ডাকতেই সে দরজা খুললো। বললাম তোর ভৌতবিজ্ঞান বইটা আমাকে দিবি, আমার বইতে একটা পৃষ্ঠা অস্পষ্ট ছাপা। সে তখন তার বইটি নিয়ে এসে আমাকে দিল। পৃষ্ঠা উল্টে বইটা দেখতে থাকলাম। সে তখন বলল তুই যা, আমি পড়তে বসবো। সত্যি বলতে কি বইটা নিয়ে এসে আগে একটা চুমু খেলাম। তারপর তার নামের উপর অনেকক্ষণ হাতে বোলালাম। তার নামটা খাতায় অনেকবার লিখলাম। এমনকি বইটি রাত্রে বিছানায় নিয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন আমার মধ্যে এক ম্যানিয়া কাজ করছে। যা 'জন অ্যালান লি' এর ভাষায় ইরোস আর লুডোসের সংমিশ্রণে তৈরি। লুডোস কি? লুডোস হচ্ছে যেখানে প্রেম একটা খেলা। এবং একসঙ্গে একাধিক প্রেম চালিয়ে যেতে পারে। আর ম্যানিয়া হচ্ছে যাকে ভালোবাসি তাকে ছাড়া এ পৃথিবী অর্থহীন মনে হয়। তারপরের দিন মেয়েটার বই ফেরত দিতে গিয়ে তার মধ্যে একটা চিরকুট পাঠালাম- আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে রাতটা খুব ভয়ে ভয়ে কাটলো। জানিনা কাল দেখা হলে কি হবে? পরদিন মেয়েটির সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলো। অনেকক্ষণ যাওয়ার পর, মেয়েটি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঠোঁটটা মচকে ভাঙলো, সেই তাকানোর মধ্যে কোনো লজ্জা বা জড়তা ভাব নেই। আমি সেদিন খুব সাহস পেলাম। মনে বেশ হাল্কা বোধ করলাম। কিন্তু সে মেয়েটি যে ভালোবাসার বদলে, আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে পরে বুঝেছি। সে রেশ কেটে গেল, যখন দেখলাম আমার এক বন্ধুর সাথে মেয়েটি সিনেমা দেখে বেরুলো। মেয়েটির মধ্যে তখন লুডোস কাজ করছে। প্রেম প্রেম খেলা। 

    এই দৃশ্য দেখার পর আমার মাথায় রোখ চেপে গেল৷ যেভাবো হোক আমাকে ওকে পেতেই হবে। তখন আমি প্রেমের ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত। একে আবার হিস্টিরিয়াও বলা চলে। এই সময় এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, এক মুসলমান ফকিরের কাছ থেকে মন্ত্রপুত তেল নিয়ে এলাম। সেই ফকির বলে দিয়েছিল একবার গায়ে তেলটা ছিটিয়ে দিতে পারলেই ব্যাস, খেল খতম। সেই অনুযায়ী একদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তেলটি ছিটিয়ে দিলাম। তখন আমার গাইতে ইচ্ছা করছে- "ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমাকে করেছে রানি।" আমি যে ওর পেছনে ঘুর ঘুর করছি, কথাটা বেশ চাউর হলো। তার কয়েকদিন পরে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। আর আমার ঘর থেকে শুরু হলো শাসানি। তার বিয়ে আর ঘরের শাসানির কুইনিন বটিকায়, সে প্রেমের ম্যালেরিয়া ঘাম দিয়ে ছেড়ে গেলো। দু চারটা ভূতের কিলে বিদায় নিল হিস্টিরিয়ার বিকার। 

   এরপর যখন ক্লাস ইলেভেন-এ ভর্তি হলাম, তখন প্রেম আবার ফিরে আসছে হিস্টিরিয়া বা ম্যালেরিয়া হয়ে নয়, তা ফিরে আসছে মনস্তত্ত্ববিদ 'অ্যালান লি' এর ভাষায় 'র্স্টজ' হয়ে। এ ধরনের প্রেম হয় দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের, ভালো লাগার, মানসিক বোঝাপড়ার পরিণতিতে। আগে আগে বলা হতো প্রেম হচ্ছে হামের মতো। প্রত্যেকের জীবনে একবার না একবার হবে। আর একবার হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার হওয়ার ভয়  থাকে না। কিন্তু এখন হামের জীবাণু তার চরিত্র বদল করে, আবার ফিরে ফিরে আসছে। সেইরকম, প্রেমও আবার ফিরে এল। এবার যে মেয়েটিকে ভালো লাগলো, সে কিন্তু দেখতে ভালো নয়। কিন্তু তার মুখের গড়ন বা কথাবার্তা খুব ভালো। এবার তার প্রেমে পড়লাম। এ বয়সে কিন্তু হাবভাব বেশ ভালোই বোঝা যায়। কিন্তু বন্ধুরা বলল, তুই কি দেখে একে ভালোবাসলি? কিন্তু ঐ যে কথায় বলে, লাভ ইজ ব্লাইন্ড। প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, 'Love is the wisdom of the fool and the folly of the wise." দাঁত উঁচু, চোখ টেরা, গাল ভাঙা, নাক থ্যাবড়া, এসব তখন চোখে পড়ে না। তবে এই মেয়েটির মধ্যে লক্ষ্য করতাম, মেয়েটি সব সময় আমাকে খুশী রাখতে চাইতো। তাই এ সময় ভালোবাসাটি ছিল হাতে চাবুক রাখার মতো। আমি যখন খুশি তাকে শাসন করতে পারতাম। তাই সে বাড়ি থেকে লুকিয়ে আমের মোরব্বা, বাড়ীর পেয়ারা আনতো। সত্যি বলতে কি যেহেতু ওর বাবা মা দুজনেই চাকরী করতো-- তাই মাঝে মাঝে লুকিয়ে হাত খরচ ও দিত। তবে ওর ব্যবহার এবং তার দেহ সৌষ্ঠব একই সঙ্গে আমাকে আকর্ষিত-বিকর্ষিত করত। অজানাকে জানা হয়ে গেলে মন চায় আবার বিজয় অভিযানে বেরোতে। তাই মন চাইলেও, কোনোরকম চেপে চুপে কাটিয়ে দিলাম দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। মনে মনে মুখস্থ করে ফেলেছি জ্ঞানী মানুষের সেই উপদেশ। যাকে প্রেম করবে তাকে বিয়ে করবে না। আর প্রেম সম্পর্কে ১৬৬৫ সালে 'লা রকিফাউলকড' বলে গেছেন- "প্রকৃত প্রেম হল ভূতের  মতো। সবাই বলে, কিন্তু দ্যাখেনি কেউ।" এবার কলেজ লাইফে এসে যে প্রেমে পড়লাম, সে প্রেমটা হচ্ছে 'জন অ্যালান লি' এর মতে র্স্টজ টাইপের। একটা ভালোলাগা, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের। মানসিক বোঝাপড়া বেশি থাকে। এই প্রেমের মধ্যে পুরো বসন্তকাল। চারদিকে লাল কৃষ্ণচূড়া। মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস বয়। গাছের ডালে কোকিল ও ডাকে। মেয়েটি চশমার মধ্যে চোখদুটি জ্বলজ্বল করতো। শান্ত স্নিগ্ধ হাসি। এই প্রেমে-- আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ আমি তোমাকে চাই- তা নয়। এ প্রেম,আমি তোমাকে চাই- কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই ধরনের প্রেমে কাম ভাবটা ক্রমশঃ সরে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে এক অনুভূতি। একসঙ্গে পার্কে বসব, বাদাম খাওয়া, নদীর ধারে বসা সূর্যাস্ত দেখা। কোলে মাথা রেখে, এক কোল পৃথিবীর সুখ অনুভব করা। 

   এতসবের মধ্যেও তখন মনে কাজ করতো ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চিন্তা। তাই প্রেমটাকে যথা সম্ভব একটা বাঁধনে বেঁধে রাখতাম। যখন ভাবছি, আজ বিয়ের কথা বলবো, কাল বিয়ের কথা বলবো, তখনই হঠাৎ তার বাবার বদলি হয়ে গেল অনেক দূরে। মেয়েটি এসে বললো,- শুনেছো সবকিছু। আমি চলে যাচ্ছি। আমি তখন চুপ করে ছিলাম। পরক্ষণে বলে উঠলো মেয়েটি- কিছু বলবে না? হঠাৎ বলে উঠলাম- মনে মনে পুড়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছো না? মেয়েটি বলেছিল- একদিন তোমার ভরসায় আমি-ই তো ছিলাম। মানুষ তো একটা নৌকা বলো? বলেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। যাক সে পর্ব চুকে গেল। 
এবার এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলামেলা ভাবটা একটু বেশি। এ বয়সে এসে, কেউ মুচকি হাসলে, তাকালে তাকে আর প্রেম ভাবতাম না। সে সময় প্রেমের কিছু লক্ষণ চিনে ছিলাম। তখন কার সাথে প্রেম করবো, বা কাকে ভালোবাসবো তা চয়েসের মধ্যে এসে গেছে। তখন যাকে খুঁজছি তাকে পাচ্ছি না। আবার যাকে পাই তাকে পছন্দ হয় না। অবশেষে মনের মত কাউকে পাওয়া গেল। তখন আমার চতুর্দিক, সদ্য পাওয়া প্রেমিকার আনন্দে উন্মাদ। তবে এই উন্মাদনার মধ্যেও প্রেম মনে হতো শাশ্বত, চিরন্তন, স্বর্গীয় এক অনুভূতি। সেখানে শরীরের স্থান ছিল না বললে ভুল বলা হবে। তবে তা ক্ষীণ। তখন পরস্পরের প্রতি মানসিক আকর্ষণই ছিল প্রেম। তখন ভালোবাসা ছিল- "I love you because i need you." এখনকার প্রেম মনের মধ্যে বাসা বাঁধছে এক অদৃশ্য ইমেজ বা ছায়ারুপে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, "লোভের অতীত যাহা/সুন্দর যা অনির্বচনীয়/ যাহা প্রিয়।" এই প্রেমের মধ্যে জেগে উঠেছিল চণ্ডীদাসের ভাব- "রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম/ কাম-গন্ধ নাহি তায়।" সে সময় একসঙ্গে সিনেমা দেখেছি, পার্কে বসেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি, তবু কোনদিন বলতে পারিনি বা চেষ্টা করিনি শরীর পাওয়ার। তখন মনে হয়েছিল কখনোই  যেন ওর কাছে আমি অপরাধী না হই। কিছু আশা করছি না, প্রতিদান চাইছি না, তবু ভালোবাসার উত্তেজনায় ছিলাম টানটান। সে টানের তীব্রতা এতটাই ছিল, জাগতিক দায়িত্ববোধ অদৃশ্য হয়ে এক কল্পলোকের বাসিন্দা ছিলাম। তখনই বুঝে ছিলাম প্রেম আর পূজোয় কোনো তফাৎ নেই। তাই হয়তো শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, "রাধে কাম আর কামনায় ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। তোমার থেকে তোমার শরীর আমার কাছে বড় হয়ে উঠছে। তোমার চরণদুটি আমার মাথায় রাখো। আমার বিকার দূর হোক। কামনার বদলে আসুক উপাসনার ভাব।" এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই, পরীক্ষা দিয়ে স্কুল শিক্ষকতার চাকরি। সে প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে গেল। তবুও আজ পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ টুকু আছে। একেই বলে হয়তো "প্লেটোনিক প্রেম।" এরপর সংসার জীবনে প্রবেশ। ঐ যে মনু বলেছেন তার সংহিতায়, 'দেবদত্তাং পতিভার্যাং বিন্দেত নেচ্ছয়াত্মনঃ।" অর্থাৎ- "পুরুষ স্বেচ্ছায় ভার্যা লাভ করে না, দেবতায় ইচ্ছায় লাভ করে।" সেই দেবতার ইচ্ছায় স্ত্রী লাভ হলো। এই বিয়ের পর আমার অবস্থা সেই রামকৃষ্ণের হারুর মতো। রামকৃষ্ণ বলেছেন, "দ্যাখো না, মেয়েমানুষের কী মোহিনী শক্তি অবিদ্যরুপিনী মেয়েদের। পুরুষগুলোকে যেন অপদার্থ করে রেখে দেয়।....ঐ যে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে, সে রুপ নাই, তেজ নেই সে আনন্দ নাই। বটগাছের পেতনিতে হারুকে পেয়েছে।"

    কিন্তু তা আর কতদিন চলে। ওই যে লেখক কলিং উইলসন বলে গেছেন, "যে একবার সাইকেল চাপতে শিখেছে, সাইকেল দেখলে তার মন উসখুস করে, চেপে বসতে ইচ্ছে করে।" আমারও হল তাই অবস্থা। বিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী বিবাহিতা দিদিমণি।তার স্বামী বাইরে চাকরী করেন। তিনি এখানে একা থাকতেন। তার পরীক্ষার খাতা দেখে দিতাম। একা থাকতো বলে বিভিন্ন রকম কাজকর্ম করেও সাহায্য করতাম।  সব স্টাফের চেয়ে বেশী মিশতো আমার সঙ্গে। কথায় আছে না- যারা বুদ্ধিজীবী তাঁরা সেক্সের চেয়ে, পারভার্সনে বেশি ভোগে। তাইতো মহাকবি গোয়েট চুয়ান্ন বছর বয়সে 'খ্রিস্টিন ভালপিয়ার্স' কে বলেছিলেন, "তোমার ব্যবহৃত একজোড়া চটি দাও আমার বুকের কাছে চেপে ধরবো।" এই পারভার্সনে ভুগতে ভুগতে আমার মধ্যে সেই নবম শ্রেণির 'ইরোস' ভাব জেগে উঠলো। যে প্রেমের মধ্যে কামভাব বেশী। এক রবিবারে ভীষণ বর্ষা হচ্ছে। লোকজন রাস্তায় কম। আমি একটি ইলিশ মাছ নিয়ে হাজির সেই দিদিমণির বাসায়। দিদিমণি দেখে অবাক! আপনি এতো দুর্যোগের মধ্যে। আমি বললাম, 'না, এই এমনি। বাজারে খরিদ্দার কম! ইলিশ সস্তা! তাই একটা নিয়ে চলে এলাম! দিদিমণি বললো- কেন? বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতেন। -তা পারতাম! তবে তুমি একা আছো, তাই! দিদিমণি তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। আমি কিন্তু সোফায় বসে পড়েছি! তখন দিদিমণি বললো, -কি ব্যাপার বলুন তো আপনার? মেয়েদের আবার এইসব ব্যাপারে ধারণা  বেশি। তারা পুরুষদের চোখ মুখ দেখলে বলে দেবে, কি চায়। তখন দিদিমণি বললেন- আপনি বেরুবেন? না, চেঁচাবো। আপনার না ঘরে স্ত্রী আছে। আমি তখন হেসে বললাম- দিদিমণি "Love goes toward love, as school boys from Their books।" দিদিমণি আরও জোরে বললেন- আমি কিন্তু এক দুই তিন চার গুনবো। এই কথা বলা মাত্র সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। তবে জাতে মাতাল হলো কি হবে, তালে ঠিক আছি। তাই ইলিশ মাছটা নিয়ে আসতে ভুলিনি। আসতে আসতে ভাবলাম- যদি এ কথা পাঁচ কান হয়ে ঘরে পৌঁছায়? তাহলে বউ ছেলেমেয়ে সবাই আমাকে ঘৃণা করবে। আমি যেন ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। 

   সত্যি তো এটা এক ধরনের অসুখ। যদি নিজে না সারাই, কারোর বাপের সাধ্য নেই তাকে সারাবে। এ একপ্রকার দুরারোগ্য। মনে মনে ভাবলাম আমার স্ত্রী আর বন্ধুর স্ত্রী তে পার্থক্য কোথায়? কিছুই নয়, প্রেম পবিত্র, প্রেম যৌবনের শক্তি, প্রেম যৌবনের স্বপ্ন, আর এতেই দৃঢ় হয় দেশ সংসারের স্থিতি। তাই বিবাহিত কেউ যখন পরনারীর দিকে হাত বাড়ায়, তা প্রেম নয়- লাম্পট্য। তাদের জন্য শেষ বয়সে পড়ে থাকে সামান্য ফোঁপানি, দু এক ফোঁটা চোখের জল।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments