জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-১৯ / অনিন্দ্যসুন্দর পাল

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)  

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য         

"ঊনবিংশ পর্ব- "সাহিত্য ৮"

অনেক জায়গায় উল্লেখ আছে, কাব্যাংশে শকুন্তলার তুলনা নেই, তথাপি রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের দিক দিয়ে নাকি মৃচ্ছকটিক শকুন্তলার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নাটক। মৃচ্ছকটিক শূদ্রকের রচিত হলেও এই শূদ্রক কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। তবে যেটুকু জেনেছি, মৃচ্ছকটিকের প্রস্তাবনায় তিনি একজন রাজা ছিলেন যেমন বলা আছে, ঠিক তেমন উল্লেখ আছে তিনি শৈব ছিলেন। তাঁর জন্মকাল বা স্থান কিছুই স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় এর থেকে বেশি তথ্য আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। অধিকাংশ পন্ডিতের মতে তিনি গুপ্তযুগে-খুব সম্ভবতঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে- জীবিত ছিলেন। জয়সোয়ালের মতে শূদ্রক তৃতীয় শতাব্দীর লোক। আবার, জার্মান পন্ডিত পিসেলের মতে যে কবি দন্ডী (সপ্তম শতাব্দী) এই নাটক লিখে শূদ্রকের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। 

  উল্লেখ আছে, নাটকের প্রস্তাবনায় কবির অত্যন্ত বিসদৃশ বর্ণনা আছে- এর কবি 'গজেন্দ্র গতি, চকোর নেত্র, পরিপূর্ণেন্দু মুখ, দ্বিজ মূখ্যতম, অগাধসত্ত্ব প্রসিদ্ধ শূদ্রক।' এখানেই শেষ নয়, তিনি বেদজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, তপস্বী ও 'পরবারণবাহুযুদ্ধলুব্ধ (পরপক্ষীয় হস্তীর সঙ্গে বাহুযুদ্ধাভিলাষী) রাজা শূদ্রক।' শুধু তাই নয় এটাও উল্লেখ আছে, নাটকে যে উচ্চাঙ্গের কলানৈপুণ্য দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে এরকম প্রস্তাবনার কোনো মিল নেই, তবে এ যে শূদ্রকের নিজের লেখা নয়- তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কোনো ভক্ত বা সভাকবি এরকম লিখেছেন তা স্পষ্ট। আরো স্পষ্ট হয় এই প্রস্তাবনার প্রতি নজর রাখলে - 'একশত বৎসর দশদিন আয়ু পেয়ে পরে অগ্নিতে প্রবেশ করেছিলেন।'

  যাক, এইভাবে প্রত্যেক কবির ও তাদের কাব্যের বর্ননা ধরে ধরে আলোচনা না রাখলে রামায়ণ, মহাভারত, ভাস, অশ্বঘোষ, কালিদাস ও শূদ্রক সহিত সংস্কৃত সাহিত্যের মহিমা কতটা পরিস্ফুট তা ধারণা করা সম্ভবপর হতো না। রামায়ণ ও মহাভারত ভারতবর্ষের প্রাণের মূর্তবিগ্রহ, ভাস প্রাচীন নাট্যকার, অশ্বঘোষ ঐতিহাসিক যুগের প্রথম সংস্কৃত কবি, কালিদাস সংস্কৃত সাহিত্যে বাণীর বরপুত্র, শূদ্রক নাট্যকার হিসাবে শ্রেষ্ঠ। এই উল্লেখের উদ্দেশ্য এই নয় সংস্কৃত সাহিত্যে এনারা ব্যতীত আর কেউ নেই, ভারবি, মাঘ, শ্রীহর্ষ, ভবভূতি প্রভূত ব্যক্তিগণ এছাড়াও বিষ্ণুশর্মার মতো লেখক যে কোনো দেশের যে কোনো যুগে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করার জন্য চূড়ান্ত।

  কাব্য হিসাবে কালীদাসের রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব, ভর্তৃহরির ভট্টিকাব্য, ভারবির কিরাতার্জুন, মাঘের শিশুপাল বধ, শ্রীহর্ষের নৈষদ চরিত, সংস্কৃত সাহিত্যের ছয়টি মহাকাব্য বলে প্রসিদ্ধ। ভর্তৃহরি একাধারে কবি, ব্যাকরণ শিক্ষাবিদ, বৈয়াকরণিক ও দার্শনিক। ভর্তৃহরি সম্বন্ধে ম্যাকডোনেল লিখেছেন- 'শুধু ভারতবর্ষের শিক্ষা প্রণালীই  তিন গুণের এই সমাবেশ সম্ভবপর করে তুলেছে।' অনেকের মতে ভারবির কিরাতার্জুনের কাব্যরস আম নয় নারিকেলের মতো, যা খোসা ছাড়িয়ে অন্তরে প্রবেশ না করা অব্দি আস্বাদ পাওয়া মুশকিল। প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো, ভারবি পল্লবরাজ সিংহবিষ্ণুর সভাপন্ডিত ছিলেন। উল্লেখ্য, মাঘ নবম শতাব্দীর ও শ্রীহর্ষ দ্বাদশ শতাব্দী এবং অবশ্যই ভারবি ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক। শ্রীহর্ষ পদলালিত্য প্রসিদ্ধ। বানভট্টর কাদম্বরী, দন্ডীর দশকুমার চরিত প্রভৃতি গদ্য পুস্তকও কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। পুস্তক ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে, কাদম্বরীর ভাষার ছটায় এমন একটা সঙ্গীত লহরীর সৃষ্টি হয় যে পাঠকের পাঠের সময় আখ্যায়িকার কথা মাথাতেই আসে না। মনে করা হয় এটাকে সংস্কৃত সাহিত্যিকরা গদ্য হলেও কাব্য আখ্যা দিয়ে সঠিক রূপায়ণই করেছেন। বর্ণনার পরিপাট্য, ভাষার ছটা, এক কথায় অনিন্দ্যসুন্দর করে তুলেছে।
'সদোষমপি সকল গুনাধিষ্ঠানম্'- মহাদোষী হয়েও সকল গুণের আধার- 'কুপতিমটি কলত্রচয়বল্লভ', কুপতি হয়েও স্ত্রীগণের প্রিয়। রথীন্দ্রনাথের মতে- ' "বানভট্টের মতো এমন বর্ণ সৌন্দর্য্য বিকাশের ক্ষমতা সংস্কৃত কোন কবি দেখাইতে পারেন নাই।"

  উপরিক্ত বর্ণিত নাটকসমূহ বাদ দিলে ভবভূতির উত্তররামচরিত ও মালতীমাধব, হর্ষবর্ধনের রত্নাবলী ও নাগানন্দ, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার ও কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধচন্দ্রদয় নাটক বিখ্যাত। তবে ভবভূতির উত্তররামচরিত করুণরসের সাগর হলেও এটিকে নাটক না বলে কাব্যনাটক বললেই বেশি মানায়। আবার মাল্টিমাধবকে শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট নাটকের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। কালিদাস বা শূদ্রক সম্পর্কিত তথ্য পরিষ্কার না পাওয়া গেলেও ভবভূতির সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জানা। তিনি কান্যকুজের সভা রত্ন, পিতা নীলকন্ঠ, মাতা জাতুকরণী, পিতামহ ভট্টগোপাল, এবং নিজে বেরার দেশীয় ব্রাহ্মণ, ও তাঁর অপর নাম শ্রীকন্ঠ। ইত্যাদি জানা আছে। নাট্যপ্রতিভা কিরূপ তা মুদ্রারাক্ষসে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। বিবেক, প্রবৃত্তি, দম, ক্ষমা, শম, মোহ, মানস, সংকল্প, ধর্ম, মুদিতা, বৈরাগ্য, দম্ভ, তৃষ্ণা, বিষ্ণুভক্তি, শ্রদ্ধা, প্রভৃতি নাটকের চরিত্র। তাই বলা যায়, নাটকটি বেশ চিন্তাকর্ষক। দু একটি লেখায় উল্লেখ পেয়েছি যে, বিশ্লেষকদের এই আখ্যানটি পড়তে পড়তে নাকি বিখ্যাত বেলজীয় নাট্যকার মেটারলিঙ্কের 'Blue Bird' নামক নাটকের কথা মনে এসেছে। অনেকের মতো আমারও একই মত যে, Blue Bird এর চেয়ে প্রবোধচন্দ্রদয় অনেক উচ্চাঙ্গের নাটক। এই নাটকে কাপালিক নিজের বর্ণনার মাধ্যমে যে অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠাকল্প করেছেন তা এই বাক্যেই বোঝা যায়-
" আমার গলার হার ও অলঙ্কার মৃত মানুষের অস্থি নির্মিত। আমি মৃতের ভস্মমধ্যে বাস করি ও নরমুন্ড আমার ভোজ্যপাত্র। উপবাসের পর আমরা  মৃত ব্রাহ্মণমুন্ডে রেখে মদ পান করি। আমাদের যজ্ঞাগ্নির হবনদ্রব্য মানুষের মাংস, ফুসফুস ও মগজ। আমাদের দেবতা মহাভৈরবকে সন্তুষ্ট করি গলদেশে সাঙ্ঘাতিক আঘাতের ফলে সদ্যরক্তধারায় সিক্ত মানুষকে উৎসর্গ করে।"

(ক্রমশ...)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments