জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-২০/অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

"বিংশ পর্ব- "সাহিত্য ৯"

ভারতবর্ষে নাট্যকলা কতটা বিশাল স্থান অর্জন করেছিল তা শুধু পূর্বোক্ত উল্লেখিত নাটক মারফত নয়- আরো ভালো বোঝা যায় উড়িষ্যার পন্ডিত বিশ্বনাথ কবিরাজ কর্তৃক একাদশ শতাব্দীতে লিখিত সাহিত্য-দর্শন থেকে। নাটকের মধ্যে কি কি গুণ থাকবে, কি রকম জিনিস অযোগ্য, কি কি জিনিস দিয়ে নির্মাণ প্রয়োজন- এই সমস্ত জিনিসেরই স্পষ্ট নির্দেশ বা ধারণা দুটোই বিশ্লেষিত করা আছে। উনি সাহিত্য-দর্পণ নাটককে প্রধান দুইভাগে ভাগ করেছেন:-
  ১. রূপক ২. উপ-রূপক
  পুনরায় রূপক দশ ও উপরূপক আঠারোটি বিভাগে বিভক্ত। সবার মতো আমারও ধারণা নাট্যসাহিত্যের ব্যাপকতার এই প্রকৃষ্ট পরিচয় বলে মনে করি। পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম সংস্কৃত সাহিত্যে কোনো বিয়োগান্ত নাটক নেই। আসলে আনন্দেই হিন্দুর সকল দুঃখের পরিসমাপ্তি। তাই, রঙ্গমঞ্চে আত্যন্তিক দুঃখকর কোনো ঘটনা দেখানো নিষেধ-যথা মৃত্যু। শুধু তাই নয়, কোনো প্রকারের দৃষ্টিকটু জিনিসও রঙ্গমঞ্চে দর্শকের সামনে অভিনীত হতে পারে না। হিন্দুদের নাট্যকলার এ উচ্চ আদর্শের পরিচয় দেয়।

  সংস্কৃত নাটকে বিভিন্ন নাটকীয় চরিত্র বিভিন্ন ভাষা  ব্যবহার করেছেন। সাধারণত: নাটকের প্রধান নায়ক, রাজা, ব্রাহ্মণ ও সমাজের পদস্থ ব্যক্তিরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেছেন। মেয়েরা ও সমাজের নিম্নস্তরের লোকেরা প্রাকৃতভাষা ব্যবহার করেছেন- অবশ্য এরাও যে সংস্কৃত বুঝতেন একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মৃচ্ছকটিকের প্রধান নায়িকা বসন্তসেনা অধিকাংশ সময় প্রাকৃত ভাষায় কথা বললেও নাট্যকার নায়িকার মুখ দিয়ে সংস্কৃত ভাষায়ও কথা বলিয়েছেন। মৃচ্ছকটিকের অধিকাংশই প্রাকৃতভাষা। ফলত, মৃচ্ছকটিক যতটা সংস্কৃত নাটক, ততোধিক প্রাকৃত নাটক। মূলত, প্রাকৃত সেকালের কথ্যভাষা হওয়ায় প্রাকৃতের সঙ্গে সংস্কৃতের পার্থক্য খুব বেশি নয়। আশা করি,একটা উদাহরণ বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট ভাবে পরিবেশন করা যাবে।
   শকুন্তলা নাটকের চতুর্থ অঙ্কের প্রারম্ভে অনসূয়া প্রিয়ংবদাকে বলছেন- "জইবি গান্ধব্বেন বিহিনা নিব্বুত্ত কল্লানা সউন্দলা অনুরূপভত্তুগামিনী সংবুত্তেতি নিব্বুদং মে হিঅঅং তহবি এতিঅং চিন্তনিজ্জং"- এর সংস্কৃত-
   "যদ্যপি গান্ধর্ব্বেন বিধিনা নিবৃত্তকল্যাণা শকুন্তলা অনুরূপভর্ত্তৃগামিনী সংবৃত্তেতি নির্বৃতং মে হৃদয়ং তথাপি এতাবচ্চিন্তনীয়ম"- যদিও গন্ধর্ববিধিমতে মঙ্গলকার্য সম্পন্ন হওয়ায় শকুন্তলা উপযুক্ত বরেই সমর্পিত হয়েছে বলে প্রাণে আনন্দ, তথাপি এই একটি কথা ভাববার আছে। কথ্য ভাষা স্থান-বিশেষে ভিন্নরূপ হয়। তাই প্রাকৃত ভাষারও বিভিন্ন রূপ আছে। কালিদাসের সমসাময়িক বররুচি তাঁর প্রাকৃতব্যাকরণে সৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী, মাগধী ও পৈশাচী - প্রাকৃতের এই চারটি ভাগ স্বীকার করেছেন। এতদ্ব‍্যতীত অবন্তী, আভিরী, অপভ্রংশ প্রভৃতি প্রাকৃতের আরো ভাগও আছে। অতএব, যাঁরা প্রাকৃতের কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারের লোক বিভিন্ন রকমের প্রাকৃত ব্যবহার করেছেন- কেউবা সৌরসেনা, কেউ বা মহারাষ্ট্রী, কেউ বা মাগধী, আর কেউ বা অপভ্রংশ এই সমস্ত প্রাকৃতভাষা থেকেই উত্তর ভারতের প্রচলিত বর্তমান ভাষাসমূহের উৎপত্তি।

   নাটকের বিষয় শেষ করার পূর্বে, দ্বাদশ শতাব্দীর বাঙালী কবি জয়দেবের গীত-গোবিন্দের কথা উল্লেখ না করলে মহাপাপ হবে। গীত-গোবিন্দ না নাটক, না গীতিকাব্য- এটি এই দুইয়ের মাঝামাঝি। এমন সুমধুর সংস্কৃত সংগীত আর কোনো সংস্কৃত কাব্যে বা নাটকে নেই। অনুপ্রাস ও পদলালিত্যের এমন অপূর্ব মিলন জগতে কোনো সাহিত্যে আছে কিনা সন্দেহ আছে। কবি এমন সুন্দরভাবে শব্দ-যোজনা করেছেন যেন একটি কন্সার্ট- সঙ্গীতের মূর্চ্ছনার মতো কানে অমৃতধারা ঢেলে দেয়।
   জয়দেবের গীত-গোবিন্দ সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাস প্রেমী ও বিশেষত আমার কাছেও বেঠোফেনের কন্সার্টের মতোই মধুর লাগে। যাঁরা গীত-গোবিন্দ পড়েন নি তাঁদের বোঝাবার উদ্দেশ্যে তিনটি শ্লোক উদ্ধৃত করলাম, যদিও আরো বহু শ্লোক উদ্ধৃত করা যেতে পারত-

"দিনমণি মন্ডল মন্ডন ভব খন্ডন (এ)
মুনিজন মানস হংস! জয় জয়দেব হরে ।।"

"অমল কমল দল লোচন ভব মোচন (এ)
ত্রিভুবন ভবন নিধান! জয় জয়দেব হরে ।।"

"মণিকয় মকর মনোহর কুণ্ডল মণ্ডিত গণ্ড মূদারম্।
পীতবসন মনুগত মুনি মনুজ সুরাসুর বর পরিবারম্ ।।"

   প্রথম দুই শ্লোকের বাংলা অনুবাদ অনাবশ্যক। তৃতীয় শ্লোকের গীত-গোবিন্দের বসুমতি সংস্করণের প্রদত্ত অনুবাদ দেওয়া হলো- প্রিয় বল্লভের গন্ডযুগল রমণীয় মণিকুণ্ডলে অলঙ্কৃত হইয়া কেমন মোহনভাব ধারণ করে। সখি! সেই পীতাম্বর কৃষ্ণের সৌকুমার্যে মুনিপত্নী, মানবী, দেবী ও দানবী সকলেই বিমোহিত হইয়া থাকে।

(ক্রমশ.........)
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments