জ্বলদর্চি

এপ্রিল, সাইকেল এবং দুজন /শীর্ষেন্দু পাল

এপ্রিল, সাইকেল এবং দুজন 

শীর্ষেন্দু পাল

'April is the cruelest month...' 
                          T. S. Eliot

এক এপ্রিলে মাসের সন্ধে। অজ্ঞাত কোন চক্রান্তে তাঁর পড়ার ঘরের টিউবলাইট সেদিন দেহ রেখেছে। মৃদু আলোতে আমি তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা বলেই বুঝতে পারছি না ঠিক কেমন হতে পারে উত্তর। আগের রাতেই তাঁর বাম হাতের তালুতে আমি পেন দিয়ে লিখে দিতে গেছি। চিঠি তো দূর , চিরকুট দিতেও পারিনি। এভাবে কাঁহাতক চুপ করে বসে থাকা যায়? একসময় আমিই গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। চলো একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। পরীক্ষার মরশুমে এমনিতেই একটা সর্বনাশা হাওয়া বয়। ছাদের উপর তারার শামিয়ানা , আশেপাশের বাড়ি, রাস্তা থেকে রিফ্লেক্টেড গ্লোরি এসে একটা ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত বাড়ির চিলেকোঠার ঘরেই কি তিনটে সিঁড়ি বুক পেতে থাকে? নীরবতা তাহলে সবসময়ই সম্মতির লক্ষণ নয়! সিগারেট ধরাই, কয়েক ফার্লং জুড়ে দপদপে ফুলকির গল্প নিয়ে ঘুরপাক খায় তামাক গন্ধ। কার্নিশে হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে পাশে এসে বসে। আসলে কি জানেন.... এটুকু বলার পর একটা বাংলা সিরিয়াল সুলভ বিরতি। আমার বুকের ভেতরে কারা যেন ছোটাছুটি শুরু করেছে। আপনাকে ঠিক ওইভাবে ভাবতে পারছি না।আমাকে প্রেমিক ভাবতে পারছে না। কি হবে তাহলে? 

      কখনও এমন হয় এক একটা মুহূর্ত যেন কয়েকশো বছর। Last Ride Together এর প্রেমিকা ঠিক কতোটা সময় নিয়েছিল শেষ বারের মতো প্রেমিকের প্রস্তাবে সায় দিতে? সিগারেটের শেষাংশ একটা প‍্যারাবোলা তৈরি করে। টেনিস বল আটকে আছে গলায়। পাঠ এতটাই ভুল ছিল তাহলে! সেই মারাত্মক হাওয়াটা যেন কার্নিশে এসে থমকে গেছে। এসময় কিচ্ছু করার থাকেনা।  আচমকা পিঠে হাত রেখে বলে, কাঁদছেন? 

     জিতে নেওয়ার মতো দুর্মর সাহস নয়, বরং একটা ছড়ে যাওয়া ক্ষতের উপর লালা লাগিয়ে দেওয়া আদরের মতো ভালোবাসা পেতে বসে থাকি। তালুতে তালু মিশে যায়, শিহরিত হয়ে উঠি। অকারণে উজ্জ্বল লাগে তারাদের। সেদিন জ‍্যোৎস্না ছিল না, একটা নীরবতার সাঁকো দিয়ে সে আসে। আরও ঘন হয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়। এলিয়ট সাহেব, April is not the cruelest month. 

    হাওয়ায় ভাসতে থাকে সাইকেল। প‍্যাস্টেল রং দিয়ে আবছায়া করে দিয়েছে কেউ দোকানপাট। ল‍্যাম্পপোস্টে ম‍্যাড়ম‍্যাড়ে আলোটাকে এত সুন্দর লাগে, আগে কোনদিন সে দেখেনি। দৃশ্য পাল্টে যায়....সাইকেলের সামনে বসিয়ে তাকে নিয়ে সে যখন যায়, ঈর্ষা পড়তে থাকে। কি পেয়েছো তোমরা? আমি, এই মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে নিয়ে আছি। যদি সমস্ত হিমবাহ গলে যায়, একটা পিঁপড়ে জীবন তছনছ করে দেয় কোন ভূমিকম্প, যদি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে প্রথম বিশ্বের কোন দেশ... ঘটুক যা কিছু এরপর। বিলায়েত খাঁ মারা গেছেন কিছুদিন আগেই।জয় গোস্বামীর একটা লেখায় সে পড়েছে কেমন করে বিলায়েত এর সুর কান্না এনে দিয়েছে সদ‍্য মাতৃহারা একজনের পাথর চোখে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে এসে সে লেখে : 

     ভালোবাসা মানে এক অপার সংযম
     বিলায়েতের সেতারে সা থেকে সম্

   সাইকেল সাক্ষী থাকে এরপর অনেক কপট অভিমানের। সে মফস্বলের সেদিনও কোন নিরালা ছিল না। টিউটোরিয়াল, সাইকেল, ছাদ আর ভীরুতা। সে কি তবে চেয়েছিল আরো একটু সাহসী হয়ে উঠি আমি ? রাত নটার সময় যে এরোপ্লেনটা রোজ উড়ে যেত নিয়ম করে, তার ডানার আলো এসে লাগতো তার কপালে। কত ঝগড়া আর বায়বীয় আদর যে সহ‍্য করতে হয় টেলিফোন তরঙ্গকে, তার হিসেব কে রাখে। ক‍্যালেণ্ডার পুরনো হয়ে যায়, স্কুলবালিকা হয়ে ওঠে কলেজছাত্রী। একদিন তবে বুঝি ঘোর ভাঙে। আলগা করতে থাকে সুতো। যখন খুশি উড়োজাহাজের ডানার আলোর ঋণ শোধ হয়ে যাবে। বার্নার্ড শ বলেছিলেন ভালোবাসার মানুষ চলে যেতে চাইলে ছেড়ে দিয়ে দেখতে হয়, সত্যিই ভালোবেসে থাকলে ফিরে আসতে হবে তাকেই।  কিন্তু সে পারে না। বড্ড অশ্রুকাতর সে। শ্রাবণের এক সন্ধেতে তাকে এক লহমায় তাই যেন বলে দেয়, আমি আর সম্পর্ক রাখতে চাইছি না। তারপর থেমে বলে - কেঁদো না। কান্না তো অভ‍্যাস নয়। তাহলে সে নিশ্চিত জানে যে আমার কান্না আসবেই। সেই সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে কান্না পাচ্ছে আমার।  হঠাৎ বৃষ্টি নামে খুব। আমি  এবার তবে কোথায় যাব? পেন্সিলের লেখা মুছে দিলেও তো একটা দাগ রয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় ঝরনা কলম, কালি নেই, শুধু বোবা অক্ষর ফুটে উঠছে। আমার গন্তব্যের দায়িত্ব  দিয়ে দিয়েছি সাইকেলকে। দূরে কোথাও মেঘ ডাকলো। স্মৃতি থেকে নিমেষে ডিলিট করার কোন মহাজাগতিক উপায় নেই। প্রত্নতাত্বিক উপায়ে এসময় খুঁজে বের করে রাখি সুন্দর মুহূর্তগুলো। বাড়ি ফিরে লিখে রাখি -- ভালোবাসা ভেঙে গেছে ভুল উচ্চারণে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments