Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-২১ চতুর্থ অধ্যায়
বাক্যতত্ত্ব (Syntax)
মান্যচলিতের প্রেক্ষিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষার পদ সংস্থানের রীতি , গঠনানুসারে বাক্যের বিভাগ, নঞর্থক বাক্যের গঠন, প্রশ্নবোধক বাক্যের গঠন এবং বাচ্য অনুসারে বাক্য কি ভাবে পরিবর্তিত হয় ইত্যাদি বিষয়গুলি এই উপভাষার বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করবো এই অধ্যায়ে। যেমন-
১. পদসংস্থান
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় মান্যচলিত ভাষানুযায়ী পদ সংস্থানের সাধারণ রীতি যেমন কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া —তেমনি এই অনুযায়ী উক্ত সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় তা ব্যবহার হয়ে থাকে।
১.১. কর্তৃবাচ্যে
কর্তৃবাচ্যে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া - বিশেষ্য কর্তৃপদ রূপে প্রথমে বসে তারপর ক্রমান্বয়ে কর্ম ও ক্রিয়া বসে। যেমন—
১.১.১ কর্তৃপদ বিশেষ্য
ক. তুমি মাচ লিয়া যাবো। ( তুমি মাছ নিয়ে যাবে।)
খ.তুমারমনে নৌকা লিকি আসবো । ( তোমরা নৌকা নিয়ে আসবে।)
গ. টকাটা গাঙে পড়িয়ালো। (ছেলেটা নদীতে পড়ে গেল।)
ঘ. আমাহারে চাট্টা নৌকা থাইলা। ( আমার ঘরে চারটি নৌকা ছিল।)
ঙ.মুই কাউখালি নদীতে জাল আড়থিলি। ( আমি কাউখালি নদীতে জাল ফেলে ছিলাম।)
চ. মুই চাদ্দিন নৌকারো অছি। ( আমি চার দিন নৌকায় আছি।)
ছ. তাহারে লোকটা মরিয়ালো। ( তার ঘরে লোকটা মরে গেল।)
জ. মোর মায়্যাটা হাটে যাইছে। ( আমার মেয়েটি বাজারে গেছে।)
ঝ. তানে মাচ গুড়াটে। ( তারা মাছ কুড়াচ্ছে।)
ঞ. তাকুকে কোরুনা হোতলা। ( তাকে করোনা হয়েছিল।)
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষাতে নিরক্ষর, অশিক্ষিত মানুষ এবং পাড়ার বৌরা কোন কোন শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে পুরোপুরি উচ্চারিত না করে অর্ধ বিকৃতি কিংবা খণ্ডিত বা বিকৃত করে উচ্চারণ করে। সেই বৈশিষ্ট্যও এই উপভাষায় দেখা যায়। যেমন-
ক. মঙ্গিয়া তুই মাচটা লিয়া যা। (মঙ্গল তুই মাছটা নিয়ে যা।)
খ.গনশিয়া মোর ঘরে আসথালা। ( গনেশ আমার ঘরে এসেছিল।)
গ.রবিয়া কালনু নৌকায় আছে। ( রবি কাল থেকে নৌকায় আছে।)
ঘ. আমি নুজুয়া মাঝিকে লিয়া আসসি। ( আমি নজু মাঝিকে নিয়ে এসেছি।)
ঙ. বোড়কি বউ কে মুই নিমতত্তন্ন দিয়া আসসি। ( বড়ো বউ কে আমি নিমন্ত্রণ দিয়ে এসেছি।)
১.১.২ কর্তৃপদ বিশেষণ
ক. ভালা মনদো দেকতে হবে। ( ভালো মন্দ দেখতে হবে।)
খ. ছোটো বড়ো মাচ পড়থালা। ( ছোটোবড়ো মাছ পড়ছিল।)
গ. জাক জমোক খাওয়া হবে। (জাঁকজমকপূর্ণ খাওয়া হবে।)
ঘ.খাওয়া- দাওয়া কত্তে হবে। ( খাওয়া দাওয়া করতে হবে।)
ঙ. সুবিদা অসুবিদা কউ দেখলানি। ( সুবিধা - অসুবিধা কেউ দেখলো না।)
১.১.৩ কর্তৃপদ ক্রিয়া-বিশেষ্য
ক. সারাদিন ধরিয়া মনটা খেরাপ থেলা। ( সারাদিন ধরে মনটা খারাপ ছিল।)
খ. কাজটা ভালা হইচে। ( কাজটা ভালো হয়েছে।)
গ. রাইতনু হাকডাক হইতলো। ( রাত থেকে হাঁকডাক হচ্ছে।)
ঘ. বুসিয়া বুসিয়া কোমোর ধরিয়ালো। (বসে বসে কোমর ধরে গেছে।)
ঙ. মনটা ভালা নেই। ( মনটা ভালো নেই।)
কিন্তু পদসংস্থানের এই সাধারণ রীতি পরিবর্তন হয়,যখন কোন বিশেষ উপরে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়। কর্মপদের উপর অধিক জোর দিলে তখন কর্তৃপদ নয় কর্মপদই প্রথমে বসে। যেমন—
ক. নৌকাগুয়াকে মাঝিরা লিয়াযাটে। ( নৌকাগুলো মাঝিরা নিয়ে যাচ্ছে।)
খ.মাচটা মুই ধরুছি। ( মাছটা আমি ধরেছি।)
গ. ওকুকে মুই পাঠাইছি। ( ওকে আমি পাঠিয়েছি।)
ঘ. নৌকায় তুই বরোফ তুয়্যা দে। ( নৌকায় তুই বরফ তুলে দে।)
ঙ. লোহোরা মাচগুয়া তুমারমোনে লিয়া যাও।( লহোরা মাছগুলো তোমরা নিয়ে যাও।)
চ. ওরমনে তুমাকে গাঙে লিয়্যাবে। ( ওরা তোমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে।)
ছ. মাচগুয়াকে তুই হাটে লিয়াযা। ( মাছগুলোকে তুই বাজারে নিয়ে যা।
জ. পুখুরটায় তানে মাচ ছাড়থলা। ( পুকুরটাতে তারা মাছ ছাড়ছিল।)
ঝ. গোরিব লোকগুয়া তুমার দুয়ারে আসথলো। ( গরীব লোকগুলো তোমার বাড়ি আসছিল।)
ঞ. গাঙের মাঝুনু তুমি ডাকোটো। ( সমুদ্রের মাঝে তুমি ডাকছিলে।)
১.১.৪ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষাতে পুরুষবাচক দুটি রূপে অনেক ক্ষেত্রে বিভক্তি যোগ হয়, আবার বিভিন্ন বিভক্তির সঙ্গে 'আর, ', 'ও' , 'কিন্তু' সংযোজক অব্যয়ও বসে। যেমন-
ক. তোনে আর কি আসবুনু? ( তোরা আর কি আসবি না?)
খ. তোরমোনে আউ ও বেগুন লিয়্যা যা। ( তোরা আলু ও বেগুন নিয়ে যা।)
গ. নজুয়া আর হারু আইচ নৌকায় যাবে। ( নজু আর হারু আজ নৌকায় যাবে।)
ঙ. হরিয়া কিন্তু মাচ ধত্তে যাবে। ( হরি কিন্তু মাছ ধরতে যাবে।)
১.২. কর্মবাচ্যে
ক. মার নান্না হইচে। ( মায়ের রান্না হয়েছে।)
খ.রাতিরবেলা মাঝিরা খেতে পারেনি। ( রাতেরবেলা মাঝিদের খাওয়া হয়নি।)
গ. টোকাটার বদমাসের তোরে তারুর মার হাতে বাড্ডাঁ খায়। ( ছেলেটার দুষ্টুমির জন্য তার মায়ের হাতে মার খায়।)
ঘ. ভোগোবান করু য্যান রামু মাঝি ঘরকে ফিরিয়া আইসে। ( ভগবান করুক যেন রামু মাঝি বাড়ি ফিরে আসে।)
ঙ. নৌকা লিয়্যা ভাইনকের সাথে মারামারি হয়। ( নৌকা নিয়ে ভাইদের সাথে মারামারি হয়।)
চ.সৌ কথাগুয়া সকোলোকের জাঁওয়া আছে। ( সেই কথাগুলো সকলের জানা আছে।)
ছ. কাউকে ওউ মাঝির কথা কইতে পারিনি। ( কাউকে এই মাঝির কথা বলতে পারিনি।)
জ. আইসো, নৌকাটা সারি ফেলি। ( এসো, নৌকাটা সারানো যাক।)
ঞ. তারমোনকের অখঁও মাচ পড়েনি। ( তাদের এখনও মাছ পড়েনি।)
২. সর্বনাম পদের ব্যবহার রীতি
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় শিষ্ট চলিত বাংলার চেয়ে এই কথ্যভাষায়তে সর্বনাম পদের ব্যবহার বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই ভাষাতেও বিশেষ্য অথবা বিশেষ্য স্থানীয় খণ্ডবাক্য অথবা বাক্যাংশের পরিবর্তে সর্বনাম পদ ব্যবহার দেখা যায়।
উত্তম পুরুষ হিসেবে মুই, মো, মোনকের, মোরা, আমি, আমরা, মোদের প্রভৃতি ব্যাবহার রয়েছে। মধ্যম পুরুষ হিসাবে তুচ্ছার্থে তুই, তোর তোরমনে তোনকের, তোরমোনকের, তোদের ইত্যাদি বিভক্তি সহ সর্বনামের ব্যবহার আছে। সম্মানজনক হিসেবে তুমি তুমরা তুমানকে,তুমারমনে ইত্যাদি এছাড়া আপনি, আপনাদের, আপনাকে ইত্যাদি বিভক্তি সহ ব্যবহার দেখা যায়। প্রথম পুরুষ হিসেবে ও, ওউ, সে, সউ, অকে,ওর, অরমোনে, ওনকের, তানকের, তারুর ইত্যাদি বিভক্তি সহ সর্বনাম পদের ব্যবহার রয়েছে।
শিষ্ট চলিত বাংলার মতোই এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষাতেও বাক্যে কর্তার যে পুরুষ হয় ক্রিয়ারও সেই পুরুষ হয়ে থাকে। যেমন- 'তুই যাবু',— এখানে 'কর্তা' ও 'ক্রিয়া'দুই-ই মধ্যম পুরুষের। তবুও যে ক্রিয়া বৈচিত্র্যগুলো দেখা যায় তা হল -
ক. তুই খাবু। (তুই খাবি)
খ. তুই যাউছি। (তুই যাচ্ছিস।)
গ. তুই পড়বু ( তুই পড়বি।
আবার 'সউ খাইথলো'- এখানে কর্তা ও ক্রিয়া দুই-ই প্রথম পুরুষের। এ ক্ষেত্রে যে এখানে বিভিন্ন ক্রিয়া বৈচিত্র্য দেখা যায় তা হল —
ক. সোউ খাবে ( সে খাবে)
খ. অউ কিনবে ( এই কিনবে।)
গ. সোউ আসবে। ( সে আসবে।
উত্তম পুরুষের ক্ষেত্রেও এখানে একই ভাবে ক্রিয়া বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন-
ক. মুই খাবা ( আমি খাব।)
খ. মুই শুবা। ( আমি শুবো।)
গ. মুই যাউছি। ( আমি যাচ্ছি।)
ঘ. আমি ঘুরবা। ( আমি ঘুরবো।)
ঙ. মুই নদীতে জাল ফেলিকি মাছ ধরি। ( আমি নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরি।)
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বাক্যতত্ত্ব সমীক্ষা করতে গিয়ে মান্যচলিত ভাষার থেকে তা কতখানি ফারাক তা এই পর্ব ছাড়াও পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পেজ-এ লাইক দিন👇
0 Comments