প্রথম প্রেমের স্মৃতি
বিমল মণ্ডল
আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। সরস্বতী পুজোর ধুম লেগেছে সবেমাত্র। সেই পুজোর দায়িত্ব নবম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের উপর ছিল। আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু আনন্দ সহকারে এই দায়িত্ব নিলাম। বন্ধুদের মধ্যে নিত্য, পার্থ, দেবাশিস, পলাশ, তরুন ছিল অন্যতম। ওরা ইয়ার্কি করে আমাদের সাথে থাকা বান্ধবীদের মধ্যে সুপ্রভা নামের মেয়েটিকে নিয়ে। সবাই এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি করতে থাকে। ঠিক তখনই আমার মনে বসন্তের সবটুকু আবেশ যেন তপ্তমরুভূমির অসহ্য উত্তাপের তৃষিত হৃদয়ে জানা অজানার এক ভালোবাসা একরাশ প্রশান্তির আবেশ নিয়ে আমার শরীরকে নাড়া দিয়েছিল।
আচমকা সবাই যেন আরও বেশি করে সুপ্রভা ও আমাকে নিয়ে বেশ মজা পেয়ে গেল। আমারও মনে ঐ বয়সে প্রেমের আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো। শ্যামবর্ণা মেয়েটির দুটো চোখ যেন মায়াভরা। ও আমাকে দেখলে বেশ মিষ্টি হাসে। বসন্তের নির্মল হাওয়া এসে পুজোর দিন আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভালোবাসার প্লাবনে।
পুজোর দিন আমরা সবাই একসঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দিলাম। তারপর প্রসাদ বিতরণের পালা। বেশ মনে পড়ে প্রসাদ দিতে দিতে সুপ্রভা অজানা ভাবনার ভঙ্গিতে গালে চুমু খেয়ে ছুটে পালিয়ে যায়। আমি অনেকক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে। ভাবতে থাকি এ-ও কি সম্ভব হয়। তার মাঝে নিত্য এসে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। তারপর নিত্য আমাকে জিজ্ঞেস করে-
- কি রে কেমন লাগল?
- কি?
- ন্যাকা কথাকার। তুই ভাবিস না তোকে আমি খেয়াল করি নি।
- আমি কি করলাম? ওতো হঠাৎ এমন কাজ করলো।
- শুন। চুপচাপ থাকিস। কাউকে এই নিয়ে বলতে যাস না। কেমন।
নিত্য আমার প্রিয় বন্ধু। ওর সঙ্গে এখনও সেই সম্পর্ক। সেই দিন প্রথম চুম্বন সত্যিই আমাকে কোথায় যেন কয়েকদিন আমার হৃদয়ে ডুবিয়ে নিয়ে গেল। পুজোর দিন রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি আবৃত্তি পাঠে। সুপ্রভা গানে। তারপর আমাদের নাটক। বেশ মজায় ছিলাম আমরা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাননীয় রাজীব বাবু মাইকে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করবার জন্য সুপ্রভাকে ডাকে। সুপ্রভা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পাগলকরা একটা গান গেয়ে মাতিয়ে দিল। গানটি হল-
"হৃদয় আজি কেমনে গেল খুলি
জগৎ আসি সেথা করেছে কোলাকুলি।"
দর্শক আসন থেকে মুহূর্মুহু হাততালি ভেসে আসে। আমারও মনে নানান প্রশ্ন ভাসতে থাকে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই। হঠাৎ আমার নাম ভেসে আসে মাইকে। কিছুটা ইতস্তত হয়ে আমি স্টেজে যাই। মনটাকে ঠিক রেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের "আফ্রিকা" কবিতাটি আবৃত্তি করি। আবৃত্তির শেষে কয়েকজন বন্ধু ও সুপ্রভা ছুটে আসে। সুপ্রভা বলে-
- ফাটাফাটি হয়েছে বিমল।
- সত্যিই?
- সত্যি। সত্যি। সত্যি
- সুপ্রভা তোমারও গানটা দারুণ হয়েছে। এক মুহূর্তে মন কেড়ে নিল।
- তাই?
সুপ্রভা এইটুকু বলে চলে যায়। আর আমার মনে 'তাই' শব্দটা বাজতে থাকে। নিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম। নিত্য বলল- 'তোর প্রেমে পড়েছে।'
আমি হাল্কাকরে হাসতে লাগলাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষের দিকে। এর পর নাটক। আমরা সবাই নাটকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় সুপ্রভা আমাকে ডাকলে আমি গ্রিনরুমের পেছনে যাই। ওকে নাটকের সাজে এতো দারুণ লেগেছিল যা একবার তাকালে চোখ ফেরাতে পারবে না। সেদিন আমিও পারিনি। ও সহসা বলে ফেললো -
- আমি তোমায় ভালোবাসি।
- কতটুকু?
- যতটুকু হলে তোমাকে পাওয়া যায়।
- আমরা তো ছোটো। এ ভালোবাসা কি বাড়ির কেউ মেনে নেবে?
- জানিনা। তবে আমি আমার কথা বললাম। এবার তোমার ব্যাপার।
- বোকা মেয়ে। আমরা একসাথে পড়ি। এই কথা জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে জান?
- আমি কিচ্ছু জানি না। আমার ইচ্ছেটা শুধু আজ বললাম। তুমি তো আমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পারনি। এতোবার ছুটে আসি কেন?
- না। মানে...আমি এতোটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখিনি।
সুপ্রভা গ্রীনরুমে চলে যায়। আমার মনে ভালোবাসা শব্দটা উথাল-পাতাল হতে থাকে। তারপর আমাদের নাটক শেষ হয়। রাতে আমাদের সবার জন্য থাকার ব্যবস্থা ছিল স্কুলে। ছেলেদের ও মেয়েদের আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা ছিল। আমি ঠিক মতো সেদিন খেতে পারিনি। ঠিক ঠিক ঘুমও হয়নি। সেইটুকু ছিল আমার ভালোবাসার দিন।
আজ আমি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে স্কুল শিক্ষকের চাকরি করি। এখন আমার ভরা সংসার। সুপ্রভাও হয়তো চাকরি করে, তারও আমার মতো ভরা সংসার। কিন্তু সেই অবোধ মনের মধ্যে যে দুটি মনের মিলন হবার কথা ছিল তা আজ কয়েক ক্রোশ দূরে দূরে দু'জন দু'জনের থেকে।
আজ শীতের পাতা ঝড়া মুগ্ধ বিকেলে চারদিক হিম হিম মৃদু পরিবেশে স্নিগ্ধ প্রকৃতির উপভোগের পাশাপাশি সেই দিনের তার হাতের অনুভূতি আজ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে। কতদিন পরে সেই প্রেমের দিন গুলো মনে পড়ে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই বিগত দিন গুলোতে। আসলে প্রথম প্রেমের স্মৃতি কি কেউ ভুলতে পারে?আমিও তাই ভুলতে পারিনি। আজও আমার গালে সেই চুম্বনের দাগ স্মৃতিতে জেগে।
পেজ-এ লাইক দিন👇
1 Comments
সুন্দর...
ReplyDelete