জ্বলদর্চি

স্মৃতিফলক/তাপস বৈদ্য

স্মৃতিফলক

তাপস বৈদ্য

প্রথম প্রেমের স্মৃতিফলক রেখেছি বুকের কোঠায়
সারাজীবন আমি সেই স্মৃতি নিয়ে জানি না চলেছি কোথায়

   আমার একটি কবিতার দুটি পঙক্তিকে উদ্ধৃত করে লেখা শুরু করতে গিয়ে দেখি সত্যিই তুমি বিষয়ক বপ্যারটি বেশ প্রবাহী। আমাকে নিয়ে যায় নস্টালজিক রোমন্থনে। মনে পড়ে যায় আমাদের সাইকেল-যাপনের দিনগুলির কথা। আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক, আর তুমি অষ্টম শ্রেণি।  তুমি সাইকেল চালাতে জানতে না, ভয়ও পেতে বিস্তর বলে আমার ছিল পোয়াবারো। কখনও স্কুলে যাওয়ার পথে বা ফেরার সময় আমার সাইকেলকে তুমি ভরসা করতে। তারপর আমার কলেজ, তোমার মাধ্যমিক এই পর্যন্ত মোটামুটি সব ঠিক থাকলেও ঠিকঠাক সিগন্যাল না থাকায় পরের এপিসোডে টিভি স্ক্রিন শুধু ঝিরঝির করে সিরিয়ালকে আর বিশেষ এগোতে দেয়নি।

   বনে নয় মনেই তো বসন্তের বাস। একের পর এক বসন্ত পেরিয়ে যাচ্ছে, জীবনের ক্যানভাসে যেমন অনেক রং যুক্ত হচ্ছে, তেমনি অনেক বিদায়ের সাক্ষ্যও  থেকে যাচ্ছে সরু-মোটা দাগে। কিছু দাগ মুছেও ফেলছে মন তার নিজস্ব ইরেজার দিয়ে। ইরেজার কি সত্যিই সব মুছতে পারে? মোছার দাগও অনেক সময় আরও গাঢ় হয়ে জাঁকিয়ে বসে। তখন কালে-অকালে জীবনের ক্যানভাস ক্যানেস্তারা হয়ে বুকের ঢিপঢিপ  বাজিয়েই চলে...।

   চুলে পাক না ধরলেও, জীবনের অনেক কিছুরই পেকে ঝরে যাওয়ার পথে আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি বলে মাঝে মধ্যেই গান ধরি। এমনই এক গান-ধরা-সকালে আমার ছোট্ট মেয়েটি  পাখির সুরে এসে বলে গেল-- বাবা তোমাকে এক পিসি খোঁজ করছেন। কোন পিসি? সে বলল-- আমি চিনি না। উনি বললেন তুমি না কি চেন। ডেক্সটপ থেকে মাথা ফিরিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি দুয়ারে অপরিচিত মানুষ হলেও বসন্তের একটা ফাগুন-আগুন বোধ মনে বেশ খেলা করছে।

   ভালো আছো? উত্তরে হ্যাঁ বললেও থতমত খেয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বেশ গুবলেটের দিকে চলে যাচ্ছিল। আমাদের উনি এসে মেকাপ না দিলে বেশ অপ্রস্তুতেই পড়তাম। প্রথমটা চিনতে না পারার জন্য নিজের ওপর খুব রাগও হচ্ছিল। আমার প্রথম জীবনের একটা ক্ষণিক অধ্যায়—মিষ্টি, মেদুর, কান্নার মতো সত্যি। আমার উনি কিন্তু কিছুই জানেন না। চাপা উত্তেজনা নিয়ে আমার পড়ার বারান্দায় বসলাম। তোমরা কথা বলো বলে উনি গেলেন রান্নাঘরে। যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন চা না কফি? দু-জনেই একসাথে বলে উঠলাম চাফি। দ্বৈত কণ্ঠে সমোচ্চারে উনি একটু ঘাবড়েই গেলেন বোধ হয়।

   অষ্টম আজ আটচল্লিশ। তদানীন্তন উচ্চমাধ্যমিক এখন বাহান্ন। আকডুম বাগডুম অনেক কথার পর জানলাম আমার প্রাক্তন ও বর্তমান-উনি ফেসবুকে একই সঙ্গে আছেন। আমার ফেবুতে কবিবন্ধু বেশি থাকায় ওনাদের মিউচ্যুয়ালিটি আমার তেমন লক্ষ্যে আসেনি। চাফি-কাণ্ডের পর আমার বর্তমান ননস্টপ বলে গেলেন-- এ আমার ফেসবুক সই, যদিও আজকেই প্রথম সশরীরে দেখলাম। গোপালনগরে ওর বাপের বাড়ি। তুমি হয়তো চিনতে পারো। তোমার স্কুলেরই প্রাক্তনী। ওর মেয়ে বিএসসি নার্সিং পাস করে স্বাস্থ্য দপ্তরে চাকরি পেতে চলেছে, ওর পোস্টিং নিয়ে তোমাকে একটু সুপারিশ করতে হবে। আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অফিসের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার সাময়িক প্রস্থান।

   সোশ্যাল মিডিয়া আনেকটা সমুদ্রের মতো। হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেয় । ফেসবুকে তো আমার হারিয়ে যাওয়া সময়কে একটু হলেও ফিরিয়ে দিল। স্কুল-জীবনের অমলতায় ফিরে গিয়ে দেখি আমার সাইকেলের সামনে হ্যান্ডেল সংলগ্ন হয়ে তুমি সুচিত্রা সেন হয়ে বসে আছো। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আমরা এগিয়ে চলেছি সূর্যাস্তের দিকে। তুমি বলতে ঐ লাল সূর্যের মতো তোমাকে আমি চিরকাল টিপ করে রাখবো । সত্যি আজও তোমার কপালে বড়ো লাল টিপ।  তোমার কপালে সূর্যাস্ত না সূর্যোদয় এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন আবার ফোন বেজে ওঠেছে জানি না। কতক্ষণ তুমি আমার দিকে বা আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তার হিসেব সময়ের হাতেই তুলে দিলাম।

  আমরা দু-জন মুখোমুখি বসে। অজস্র স্মৃতি পদ্যে ও গদ্যে ভিড় করে আসছে। নতুন করে কী বলব ভেবে বলার আগেই কানে এলো-- তোমার সব কবিতাই পড়ি। তোমার সব কবিতার বই আমার সংগ্রহে আছে। আমার উনিও তোমার ভক্ত। ওনাকে আনলে না কেন? আর একদিন আসব। তখন জমিয়ে আড্ডা হবে। বিদায় জানাতে মন না চাইলেও নিষ্ঠুর সময় সব করিয়ে নিতে বাধ্য করে। বারান্দায় বাইকের পাশে চিরচেনা সাইকেলটিকে দেখে চমক লাগে ওর। বলে-- সাইকেলটা এখনো আছে। তুমি তো বাইকে যাতায়াত করো, তাহলে এই অপ্রয়োজনীয় সাইকেলটাকে এত যত্ন করে এতদিন ধরে রেখেছো কেন? খুব অস্ফুটে বলেছিলাম-- প্রথম প্রেমের স্মৃতিফলক।

  স্কুলের শতবর্ষের তোমাকে দেখিনি কেন? খুব মনে হচ্ছিল তুমি আসবে। তিন দিন ধরে অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি দু-দিন গিয়েছিলাম আমার এই ময়ূরপঙ্খীকে সঙ্গে নিয়ে। শুধু সেই সময়কে ফিরে পেতে, নস্টালজিয়াকে মনের গভীরে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। ও কোন উত্তর দিতে পারেনি, শুধু চুপ করে আমাকে আর আমার ময়ূরপঙ্খী সাইকেলটাকে অবলোকন করছিল। আমার উনিকে রান্নাঘরে গিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে যাবার সময় সাইকেলের হ্যান্ডেল বেল সিট ক্যারিয়ার সবেতেই হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল। আর সেই পেলব স্পর্শ  আমি অনুভব করলাম একেবারে বুকে। মনে হলো বনে নয় মনে আজ সত্যিই বসন্ত।  ভাবছি আসন্ন চোদ্দই ফেব্রুয়ারি আমি ফেসবুকে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবো।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments