জ্বলদর্চি

রসায়নবিদ ড: শান্তিস্বরূপ 'পেট্রোলিয়াম' ভাটনাগর/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ১৩
রসায়নবিদ ড: শান্তিস্বরূপ 'পেট্রোলিয়াম' ভাটনাগর:

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


অভিনব বিজ্ঞাপন। অভিনব তার ভাষা। তার বিষয়। যে-কেউ আকর্ষিত হবে। আপাত অবাস্তব তার কায়দা-কানুন, ক্রিয়া-কৌশল। অভিনব কায়দায় জ্বলজ্বল করছে বিজ্ঞাপনের অক্ষরগুলো― "সস্তায় চাঁদ ভ্রমণের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে!" টিকিট বিক্রি করছে কতিপয় শ্বেতাঙ্গ যুবক। চাঁদে যাওয়ার লম্বা লাইনও পড়েছে। কারও চোখে দারুণ আগ্রহ। কেউ বা কৌতূহলী। হালকা গুঞ্জন। ফিসফাস আওয়াজ। চাপা স্বরে কথাবার্তা। সব মিলিয়ে যেন রহস্য রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনী। কৌতূকের বশে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্যান্ট-কোট-টাই পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। অশ্বেতাঙ্গ বিদেশি। সময় এলে কাউন্টারে গিয়ে বললেন―
'আমাকে একখানা টিকিট দেবেন, প্লিজ।'
'এই নিন, স্যার'।
টিকিট আর ফেরৎ মূল্য বুঝে নিতে নিতে আগন্তুক বিষ্ময় প্রকাশ করে―
'এ যে কেবলমাত্র চাঁদে যাওয়ার টিকিট! ফেরা'র টিকিট কোথায়?'
'সরি স্যার, রিটার্ন জার্নি টিকিটের বন্দোবস্ত নেই।'
'এই ধরুন টাকা। আমাকে এক্ষুনি একটা রিটার্ন টিকিট দিন!'
'কিন্তু আমাদের কোম্পানি রিটার্ন জার্নির কোনও টিকিট বিক্রি করছে না।'
'তা কী করে হয়? চাঁদে গিয়ে তাহলে ফিরব কেমন করে?'
'আসলে স্যার, মানুষ কবে চাঁদে পাড়ি দেবে সেটা তো ভগবান জানেন! খুব অনিশ্চিত ব্যাপার― তাই না! সেজন্যে আমরা রিটার্ন টিকিট বিক্রি করছি না।'
'সে কী করে সম্ভব! যাওয়ার টিকিট যখন কিনেছি, ফেরৎ আসার টিকিট না কিনলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে কি?'
অনড় আগন্তুক। অপ্রস্তুত সেলসম্যান। কী করবেন না করবেন― স্থির করতে পারছে না টিকিট-ওয়ালারা। কিছুক্ষণ অনেক ভাবনা চিন্তা করে তারা আরও একখানা টিকিট, বলা ভালো রিটার্ন জার্নি টিকিট আগন্তুককে বাড়িয়ে দিলেন। দ্বিতীয় টিকিট কিনে ভদ্রলোক বকবক খুশি। কাউন্টারে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন―
'এই নিন ফেয়ার।'
'না স্যার, তার প্রয়োজন নেই।'
'কেন?'
'এখন মূল্য দিতে হবে না।'
'তা কী করে হয়? দাম না দিয়ে...।'
'আসলে কবে চাঁদে যাত্রী যাবার মতো পরিস্থিতি আসবে কেউ জানে না। তাই খরচ কত পড়বে বা টিকিটের দাম সত্যিই কত হওয়া উচিত কেউ তো জানে না।'
'কবে নেবেন তাহলে?'
'ফেরার টিকিটের দাম এখনও ধার্য করা যায়নি।'
'এখন আমার কী করণীয়?'
'দেখুন, স্যার। আপনার ঠিকানা তো আমাদের কাছে রইল-ই। যখন সময় আসবে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। চাঁদ-যাত্রা শুরু হলে টিকিটের সঠিক মূল্য আমরা চেয়ে নেবো। আপনি চাপ নেবেন না।' হাসি মুখে উত্তর দেয় টিকিট-ওয়ালা যুবক ছেলেটি।
'ওকে। থ্যাংকু।'
চাঁদ ভ্রমণের টিকিট আর ফিরতি টিকিট নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলেন আগন্তুক ভদ্রলোক। ঘটনার অভিনবত্বে মনে মনে হাসলেন। তারপর হারিয়ে গেলেন কাজের ভীড়ে।
      
ঘটনাটা কী? আর ওই আগন্তুক ভদ্রলোক-ই বা কে? তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ভারতের বিখ্যাত রসায়নবিদ শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর একবার আমেরিকা বেড়াতে গেলেন। কোনও এক শহরে গিয়ে তিনি দেখলেন― চাঁদে যাওয়ার টিকিট বিক্রি করছে একদল যুবক। আমেরিকার একটি সংস্থার হয়ে। তখনও রকেট প্রযুক্তির আদি যুগ। স্পুটনিক মহাকাশে পাড়ি দেয়নি। আকাশে ওঠেনি কোনও কৃত্রিম উপগ্রহ। ওই সংস্থা এরকম টিকিট বিক্রি করে মহাকাশ গবেষণা বা বলা ভাল― রকেট প্রযুক্তি গবেষণার চাঁদা তুলছে। টিকিটের দাম বেশ সস্তা। ভাটনাগরও টিকিট কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং চাইলেন ফিরতি টিকিট বা রিটার্ন জার্নি টিকিট। চাঁদে গেলেই তো হবে না, ফিরতেও তো হবে। চাঁদে গেলে সত্যি সত্যি আর ফেরা যাবে না, এমন কথাতো নেই। 

উপরে উল্লেখিত সংলাপ হয়তো কাল্পনিক বা সামান্য অতিরঞ্জিত করা হয়েছে; কিন্তু ঘটনাটি সর্বৈব সত্য। শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর ছিলেন পাঞ্জাবের লোক। হিন্দু কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব প্রভিনসের শাহপুর জেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম ভেরা; ১৮৯৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে সেখানে জন্মগ্রহণ করেন শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর। যখন তাঁর বয়স মাত্র আট মাস, তাঁর স্কুল শিক্ষক পিতা পরমেশ্বরী সাহই ভাটনাগর পরলোক গমন করলেন। দাদা আর বোনের সঙ্গে ছোট্ট শান্তিকে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি সেকেন্দ্রাবাদে চলে এলেন তাঁর মা পার্বতী ভাটনাগর। মাতুলালয়ে বড় হতে থাকে ছোট্ট ভাটনাগর।সেকেন্দ্রাবাদের ডিএভি হাইস্কুলে তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। মামাদাদু ছিলেন একজন নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ছোট্ট ভাটনাগরকে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশেষ মনোযোগী করে তোলেন। ছোট বেলা থেকে খেলনা গাড়ি, ইলেকট্রনিক ব্যাটারি আর বৈদ্যুতিক তার দিয়ে টেলিফোন তৈরিতে কিশোর ভাটনাগর ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর মাতৃরক্তে ছিল কবিতা। তিনি ভালো কবিতা লিখতে পারেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সমান্তরালে চলতে থাকে তাঁর কাব্যচর্চ্চা। ১৯১১ সালে লাহোরের দয়াল সিং কলেজে ভর্তি হলেন। কলেজে অধ্যয়ন কালে লিখলেন নাটক। উর্দু ভাষায়। একাঙ্ক নাটক― 'Karamati' (বিষ্ময় শ্রমিক)। নাটকটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হল। নাটকের সুবাদে পেলেন স্বীকৃতি। ১৯১২ সালে বছরের সেরা নাটকের শিরোপা ছিনিয়ে নেয় তাঁর লেখনী। নাটকের সৌজন্যে তিনি পেলেন 'সরস্বতী স্টেজ সোসাইটি পুরস্কার ও মেডেল'। এরপর ১৯১৬-তে ফিজিক্সে গ্র্যাজুয়েট আর ১৯১৯-এ কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স হলেন। পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি মিলল। দয়াল সিং কলেজ ট্রাস্ট থেকে। বাসনা আমেরিকায় গবেষণা। ইংল্যান্ড হয়ে আমেরিকা গমন মনস্থির করলেন। কিন্তু বিধি বাম! ইংল্যান্ড পৌঁছে দেখলেন আমেরিকাগামী ব্রিটিশ জাহাজে কোনও বার্থ ফাঁকা নেই। সব বার্থ আমেরিকান সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে দেশে ফিরছে রণ-ক্লান্ত সৈন্যসামন্ত। 
   
দয়াল সিং কলেজের অগত্যা ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমতিক্রমে ভর্তি হলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে। সেখানে ১৯২১ সালে অধ্যাপক ফ্রেডরিক জি. ডোন্নান-এর অধীনে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ডক্টরেট প্রাপ্তির পরে দেশে ফিরলেন। সেবছর আগস্ট মাসে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। বেনারসে অধ্যাপনার প্রথম তিন বছর কাল অতিবাহিত করেন। এই সময়ে হিন্দি ভাষার কবি হিসাবে ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ করে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। ইউনিভার্সিটির 'Kulgeet' রচনা করলেন। তাঁর রচিত এই সংগীত আজও সম্মানের সঙ্গে গাওয়া হয় বেনারস ইউনিভার্সিটিতে।  তিন বছর পরে বেনারস ছেড়ে চলে এলেন লাহোর। লাহোরে পঞ্জাব ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ও ডিরেক্টর হয়ে। এখানে তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের প্রকৃত দ্যুতি প্রস্ফুটিত হয়। ইমালসান, কলয়েড দ্রবণ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ম্যাগনেটো-কেমিস্ট্রিতে বিশেষ কৃতিত্বের ছাপ রাখেন তিনি।
   
তাঁর প্রথম বড়ো সাফল্য বোধহয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমস্যার সমাধান― আঁখের খোসা থেকে গবাদিপশুর জন্য ফুড-কেক তৈরি। এমন আরও অনেক পদ্ধতি আবিষ্কারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জগতে তাঁর সুনাম চড়চড় করে বাড়তে থাকে। দিল্লি, কানপুর, বোম্বে, এমনকি লন্ডন থেকে বিভিন্ন কোম্পানি সমস্যা নিয়ে তাঁর দরজায় ছুটে গেছে। আর তিনি তাদের হরেক রকম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। 

তাঁর সবচাইতে বড় আবিষ্কার অপরিশোধিত তেল সংগ্রহের আধুনিকতর পদ্ধতির উদ্ভাবন।  লন্ডনের মেসার্স স্টিল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং-এর সহযোগী সংস্থা হল রাওয়ালপিণ্ডির Attock Oil Company। তখন এই সহযোগী সংস্থা যে অশোধীত তেল উত্তোলন করত, তার সঙ্গে লবনাক্ত জল প্রচুর পরিমাণে মেশানো থাকত। লবনাক্ত জলের সঙ্গে অশোধিত তেলের কাদা (Mud) সংযুক্ত হয়ে জমাট বেঁধে যায়। খননকাজে তার ফলে বিশুদ্ধ খনিজ তেল সংগ্রহ করতে খুব অসুবিধায় পড়ছিল বিশেষজ্ঞরা। অথচ বিজ্ঞানী ভাটনাগর একটি সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। তিনি কলয়ডাল কেমিস্ট্রির নীতি প্রয়োগ করে সমস্যাটির একটি অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা আবিষ্কার করলেন। ভারতে পাওয়া যায় এমন একধরনের আঁঠা জাতীয় পদার্থ মেশালেন অশোধিত তেলের কাদার সঙ্গে। এর ফলে তেলের সান্দ্রতা অনেকাংশে কমে গেল। বেড়ে গেল তার স্থায়িত্ব। আর তাকে লবনাক্ত জল থেকে সহজেই পৃথক করা সুবিধা হল। সান্দ্রতা হল তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের একটি সহজাত নিজস্ব ধর্ম, যার কারণ গ্যাস ও তরল স্তরের মধ্যে আপেক্ষিক গতির ফলে সৃষ্ট বাধাজনিত ঘর্ষণ বল (যা আসলে 'সান্দ্র বল' নামে পরিচিত)। মেসার্স স্টিল ব্রাদার্স তাঁর আবিষ্কারে খুব খুশি। আনন্দে তারা ভাটনাগরকে প্রস্তাব দিলেন যে পেট্রোলিয়ামের উপর যেকোনও বিষয় নিয়ে ভাটনাগর আরও গবেষণা করুন। পনেরো লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ সাহায্য করতে তারা প্রস্তুত।  শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে একটি ফান্ড গড়বে কোম্পানি। শ্রদ্ধেয় ভাটনাগরের তত্ত্বাবধানে পেট্রোলিয়াম রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট গড়ে গবেষণার জন্য ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ খরচ করা হবে। সে-মত সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এমন রিসার্চের ফলে ভেজিটেবল তেল ও মিনারেল তেল ইন্ডাস্ট্রির বর্জ্য পদার্থের ব্যবহার, কেরোসিনের আরও শুদ্ধিকরণের নিমিত্ত একগুচ্ছ পরিকল্পনার সফল রূপায়ণ সম্ভব হয়। রিসার্চের দরুন এমন অভাবিত সাফল্য লাভের পর কোম্পানি ফান্ডের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়, আর পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আগামী দশ বছরের জন্য সময়সীমা ধার্য্য করে কোম্পানি। 

ভারতে সর্বপ্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন গড়ে ওঠে ১৯৩৫-এ। ইন্ডিয়ান স্টোর্স ডিপার্টমেন্টের অধীনে। নাম হয় 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স এবং রিসার্চ ব্যুরো' (IIRB)। ১৯৩৫-এর এপ্রিল মাস নাগাদ ব্যুরো তার কাজ শুরু করে। বাৎসরিক বাজেট ধার্য্য হয় ১.২ লক্ষ টাকা। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত কার্যত অকার্যকর পড়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ব্যুরোর অস্তিত্ব মুছে যায়। তার বদলে তৈরি হল বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (BSIR)। ব্রিটিশ BSIR-এর অনুকরণে। অ্যাটকর্ন রামাস্বামী মুদালিয়রের আপ্রাণ চেষ্টায় দুবছরের জন্য বোর্ড গঠন করা হল। ১৯৪০-এর এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখে। সংস্থার ডিরেক্টর হলেন শ্রী ভাটনাগর। চেয়ারম্যান রামাস্বামী মুদালিয়র। বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকা। ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ বাজেট বেড়ে হয় দশ লাখ টাকার মতন। এমন প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন স্বয়ংক্রিয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এরই ফলস্বরূপ ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আঠাশ তারিখে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR) প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ইউটিলাইজেশন কমিটি (IRUC) এবং বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (BSIR) একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। CSIR-এর পরিচালনা পর্ষদের জন্য। ১৯৪৩ সালে CSIR-এর ওই পর্ষদ পাঁচটি জাতীয় গবেষণাগার গড়ার ভাটনাগর-এর প্রস্তাব মান্যতা দেয়― National Chemical Laboratory, National Physical Laboratory, Fuel Research Station, Glass and Ceramics Research Institute। তেমন ল্যাব‍রেটরি প্রস্তুত করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এমন সংকটকালে উপস্থিত হয় একগুচ্ছ দেশীয় সংস্থা ও কোম্পানি। দশ লক্ষ টাকার বার্ষিক বাজেটের সঙ্গে বাজেটের দশ গুণ পরিমাণ টাকা (এক কোটি টাকা) অনুদান হিসাবে পায় CSIR পর্ষদ। এর মধ্যে কুড়ি লক্ষ টাকা অনুদান দেয় টাটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউস― কেমিক্যাল, মেটালর্জিক্যাল এবং ফুয়েল রিসার্চ ল্যাব‍রেটরি তৈরির জন্য।
       
এসময় ১৯৪১-এ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৪৩-এ তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। তাঁর সভাপতিত্বে দেশ জুড়ে তখন একের পর এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সংকল্প নেওয়া হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার গতি ত্বরান্বিত হয় ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু নিজে বিজ্ঞানের খুব পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর ভাটনাগর-এর সভাপতিত্বে CSIR প্রতিষ্ঠানের রূপ পায়। CSIR-এর প্রথম ডিরেক্টর-জেনারেল হলেন ভাটনাগর। তার কর্মকাণ্ড বিস্তারে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিশেষ উদ্যমী হন।
প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় ১৯৫৪ সাল নাগাদ ভাটনাগর-এর সভাপতিত্বে গোটা দেশে প্রায় ডজনখানেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। Central Food Processing Technological Institute, Mysore; National Chemical Laboratory, Pune; National Physical Laboratory, New Delhi; National Metallurgical Laboratory, Jamshedpur; Central Fuel Institute, Dhanbad প্রভৃতি।
    
হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ, বিক্রম সারাভাই সহ প্রমুখ স্বনামধন্য পণ্ডিতের সঙ্গে শ্রদ্ধেয় শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর ছিলেন উন্নত ভারত গড়ার লক্ষ্যে অবিচল, প্রকৃত কারিগর। জগৎ সভায় যখন ভারতবর্ষ শ্রেষ্ঠ আসন লাভের প্রতিযোগিতার শিখরে বিরাজমান, মরিয়া হয়ে অবতীর্ণ; তেমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে গেল। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে গমন করলেন তিনি, শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর। ১৯৫৫ সালের পয়লা জানুয়ারি। মাত্র ষাট বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ভারতের বিজ্ঞান গবেষণায় অতুলনীয় ক্ষতি, যা কখনও পূরণ হবার নয়। সেজন্য ১৯৫৮ থেকে তাঁর স্মরণে ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার 'শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর প্রাইজ' ঘোষণা করে ভারত সরকার। ভারতে গবেষণারত তরুণ বৈজ্ঞানিকগণকে (যাদের বয়স ৪৫ বছরের নিম্নে) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য দেওয়া হয় এই পুরস্কার। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একগুচ্ছ বিজ্ঞানীকে প্রতি বছর 'শান্তিস্বরূপ ভাটনাগর প্রাইজ' প্রদান করা হয়।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ইন্টারেস্টিং লেখা ।।

    ReplyDelete