জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১৯

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা - ১৯

সম্পাদকীয়
ছোট্টোবন্ধুরা, সমুদ্র, পাহাড়, না জঙ্গল, কোথায় বেড়াতে যেতে বেশি ভালো লাগে? আমার তো সমুদ্র। সমুদ্রের ঢেউ, সমুদ্রের হাওয়া, সমুদ্র তীরের বালি। না না আর বেড়ানোর লোভ দেখাবো না। আমরা সবাই তো কোভিডের জন্য গৃহবন্দী। তবে আমি জানি, তোমরা অনেকেই করোনা চলে গেলে পুরী বেড়াতে যাবার প্ল্যান করছো। কি তাই তো? এবার কিন্তু পুরী গেলে মা-বাবাকে বলে স্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম দেখে আসতে ভুলো না। আর যারা জঙ্গল বেড়াতে যেতে ভালোবাসো তারা চটপট অনন্যার কবিতাটা পড়ে বলো তো কোন জঙ্গলের গল্প সে আমাদের বলেছে? উঁহু, পাহাড় যারা ভালোবাসো তাদেরও মন খারাপের কিছু নেই, ঐ যে দু'জন পাহাড়ি অঞ্চলের ছোট্টো বন্ধুর খিলখিল হাসির ছবি প্রচ্ছদের জন্য আমাদের উপহার দিয়েছেন দেবমাল্য দাস। আর যারা আপাতত কোথাও যাচ্ছ না, তারা পড়ে ফেলো শ্রীকান্ত অধিকারীর রাঙা পিসির মজার গল্প আর ছোটো বন্ধু অদৃজার স্বপ্নের গল্প। কি মানস ভ্রমণ হল কিনা!প্রচ্ছদের ছবিটি উপহার দেবার জন্য দেবমাল্য দাসকে অশেষ ধন্যবাদ। ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি উপহার পেয়ে আজ আমরা মানস ভ্রমণ করতে পারলাম, তাই চন্দ্রানী বসুকে আন্তরিক ভালোবাসা। তাছাড়া কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, শান্তা সাহা, এবং গল্পকার শ্রীকান্ত অধিকারী ও ভিনগ্রহীদের নিয়ে লেখা ধারাবাহিকটি উপহার দেবার জন্য গৌতম বাড়ইকেও ধন্যবাদ। তোমরা যারা প্রতিসংখ্যায় আঁকা পাঠিয়ে পত্রিকাটি রঙীন করে তুলছো তাদের জন্য আমি পাঠালাম শীতের রোদের মতো মিষ্টি আদর।  - মৌসুমী ঘোষ।


চন্দ্রানী বসুর কলমে ভ্রমণের আনন্দ

চল ঘুরে আসি বালুর ঘরে 


উড়িষ্যার পুরী মানেই প্রায় সব বাঙালির কাছে আরেকটি নিজের ঘর। সমুদ্রতট, জগন্নাথ মন্দির, কোনার্ক মন্দির, চিলকা হ্রদ, পুরীর গজা ... এসব তো সকলেরই জানা। কিন্তু পুরীর আরেকটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে খুব সাম্প্রতিক কালে যোগ হয়েছে স্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম। পুরী থেকে কোনার্ক যাওয়ার পথে বালিগুয়ালি রোডের উপর অবস্থিত এই মিউজিয়াম। পুরী থেকে গাড়িতে বা অটোতে ২০ মিনিট মতো সময় লাগে পৌঁছতে।

   এর পূর্বে পুরীর সমুদ্রতটে বিশেষ করে লাইট হাউস ছাড়িয়ে মোহনার দিকে বা স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে নীলাচল হোটেলের দিকে আমরা দেখেছি সুদর্শন পট্টনায়ক সহ প্রমুখ পুরীর বালুশিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টি সাজিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তা ছিল বড় অস্থায়ী। সমুদ্রের ঢেউ এসে তাকে মিশিয়ে দেয় নিত্য। 
   কিন্তু পুরীর এই স্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম এ গেলে সবসময় এই শিল্পের নিদর্শন দেখা যাবে। 

   মিঃ সুদাম প্রধান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বালুশিল্পী এই মিউজিয়ামটি নির্মাণ করেছেন। প্রতিদিন এখানে নানাধরণের স্কাল্পচার দেখা যাবে যেমন কুড়ি-ফিটের বুদ্ধ, বাইশ ফিটের দুর্গ, তাজমহল, কোণার্ক মন্দির, ডলফিন, গান্ধীজি, ছোটোদের আকর্ষণীয় অ্যাভেঞ্জার, স্পাইডার ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা ইত্যাদি ইত্যাদি। বালির সাথে রঙের মিশ্রণ এই শিল্পকে এখানে অন্য মাত্রা দিয়েছে। চারপাশে ফুলের বাগানটি দর্শনীয় হিসেবে যে কোনো ভালো গার্ডেনকেও টেক্কা দিতে পারে। সারাক্ষণ হালকা মিউজিক, মিউজিয়াম ঘুরে দেখাকে আরো আনন্দদায়ক করে তোলে। 

শুধু এখানে বালুশিল্পের স্কাল্পচারই নয়, আছে স্যান্ড অ্যানিমেশন লাইভ শো। যা আমরা ভিডিও হিসেবে এতদিন দেখে এসেছি তার লাইভ দেখা যায় এখানে। ছোটোদের কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় এই স্যান্ড অ্যানিমেশন।
এই মিউজিয়ামের আরও একটি অংশ হল, ওয়ার্কশপ ও লার্নিং ইন্সটিটিউট। দেশ বিদেশ থেকে বালু শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছাত্ররা এখানে থেকে এই শিল্পের খুঁটিনাটি শিখে নেয়। 
উড়িষ্যার শিল্পকর্ম চিরকাল খ্যাতি বয়ে আনে। পিপলি ওয়ার্ক দেখতে আমরা যাই পিপলি গ্রামে, পটচিত্র দেখতে যাই রঘুরাজপুরে এবার তার সাথে অবশ্যই যোগ হল বালুশিল্পের এই  সুদাম আর্ট মিউজিয়াম। ছোট থেকে বড় সবার কাছেই ভীষণ ভালো লাগবে।


শূন্যের মহিমা 

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

শূন্য মানে শূন্য তো নয়, তার ভেতরেই সব
এই যে আকাশ, পাহাড়, নদী, পাখির কলরব
জ্যোৎস্নাঢাকা চাঁদের ছায়া, আলোর খেলাঘর
শূন্য থেকেই জেগে ওঠে প্রাণের চরাচর। 

আজকে যা নেই ঠিক সেখানেই সম্ভাবনার ঢেউ  
অন্ধকারে মনদুয়ারে তৈরি করে  কেউ। 
আঁধার ছুয়েই যাওয়া আসা, স্বপ্ন দেখার চোখ 
নিঃস্ব হাতে লিখেই চলে বিশ্বজয়ের শ্লোক।

বেশ করেছিস শূন্য পেয়ে, কে বলেরে ছিঃ 
আয় দুবেলা  মাথায় তুলে তোকেই আদর দিই।
শূন্য মানে হোক না ফাঁকা, হোক না সে বিগ জিরো
এই দুনিয়ায় শূন্যই সব, সেই তো রিয়েল হিরো। 


রাঙাপিসির গল্প -  সূচ সুতো ও মাঝির গল্প 

শ্রীকান্ত অধিকারী

কেন জানি না বর্ষা এলেই রাঙাপিসি আমাদের বাড়ি চলে আসত। থাকত অনেক দিন। তার ছেলেপুলে ছিল না। শুনেছি একটা মেয়ে ছিল। বানের জলে ডুবে গেছে। তখন বাবা বলেছিল - তোমার আর শ্বশুরবাড়িতে থেকে কাজ নেই। এখানে আমাদের সঙ্গে থাকো। 
  কিন্তু কোনও এক কারণে রাঙাপিসি তার স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ছাড়তে চায় নি। দেখেছি  রাঙাপিসির বিশাল জমিদারি বাড়ি। বাড়ির সামনে-পেছনে অনেক বড় বাগান। বাগানে প্রচুর আম,জাম, জামরুল, পেয়ারা,টোপা কুল, চাপা কলার গাছ। অদূরে ছোট নদী। তার চারপাশে বুনো কুলের ঝোঁপ। আম বটের এলোমেলো গাছালি। গেলে আর ফিরে আসতে মন হতো না। কিন্তু বাবার কড়া হুঁশিয়ারিতে দু'দিন দু'রাতের বেশি থাকা একেবারে সম্ভব হত না। বছরে অন্য সময়ে গেলেও কখনও বর্ষার সময় যেতাম না। কেন না রাঙাপিসি সে সময় আমাদের বাড়িই চলে আসত। গরম পড়তে না পড়তেই আমরা দুই ভাইবোনে উদগ্রীব হয়ে থাকতাম কখন আকাশে মেঘ করবে। কখন বৃষ্টি পড়বে। রাস্তা-ঘাটে জল জমে যাবে। তাহলেই রাঙাপিসি সুর করে করে আদুরে ডাক ডেকে উঠবে - কই রে আমার আঁজির, বোনের জন্য বলবে, কোথায় গেলি কামরাঙা। হাতে  থলি। থলিতে তার যত রাজ্যের বিশ্বসেরা মুখোরোচক খাবার। কি থাকে না তাতে - - টোপাকুলের আচার, কাঁট তেতুলের বিচির সঙ্গে মোল সিদ্ধ। কাঁঠালের বিচিভাজা। আর শুকনো কলার থোর। সঙ্গে মা'র জন্য কলাই-বড়ি।আমি মুখ ঢুকিয়ে দেখতে গেলে বলে - - কীরে ঠিক তোর নাকের মত হয়েছে তো?
   কিন্তু এত কিছু বাদ দিয়েও আমরা যার জন্য গরমকাল থেকে ওঁৎ পেতে থাকতাম সেই রাঙাপিসির গল্প, সেটা শুরু না হলে মন কিছুতেই শান্ত হত না। তাড়াতাড়ি পড়াশুনা সেরে সন্ধ্যাবেলায় খাটের ওপর বসে পড়ি রাঙাপিসির গা ঘেঁষে। আর কোনও রকম ভনিতা না করে রাঙাপিসিও  বের করে তার গল্পের-ঝাঁপি। সে গল্প ভূতের পিশাচের এক নেড়ে ভূত কিংবা বুক ঢিপ ঢিপ করা ঘাড় মটকানো রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প হতে পারে। কিংবা তার বানানো মাথামুন্ডহীন আলটপকা ছোটখাটো ঘরোয়া জিনিস নিয়ে গল্প। কখনও কখনও তার ফেলে আসা জীবনের গল্প - -  সেইগল্প শুনতে শুনতে চোখের জলও পড়ে যায়। মন ভার হয়ে ওঠে । সেই ভার লাঘব হয় মায়ের হাতে গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম - বেগুন ভাজা খেয়ে।
বাইরে তখন ঝেঁপে বৃষ্টি। সোঁ সোঁ করে ঝোড়ো বাতাস বইতে থাকে। রাঙাপিসি গল্প শুরু করে--
  তোরা তো জানিস আমাদের  গ্রামের ধারে একেবারে পশ্চিম দিকে যেখানে শ্মশানটা রয়েছে, ঠিক তার গায়ে যে নদীটা বয়ে গেছে পুব -পশ্চিম বরাবর। তারপর একটা ছোট্ট অথচ ভয়ঙ্কর বাঁক নিয়ে লুকিয়ে যায়। সেখানেই হয়েছে একটা চর। চরে অনেক আম গাছের বাগান রয়েছে। সেখানে সূচ-সুতো দুই ভাই-বোন মিলে নদীর চরে খেলতে যায়। গ্রামের আরও সব ছেলেপুলেও যায়। এখানেই কোথাও ওদের মা-বাবারা মাঠে খাটতে আসে। ওদের পাড়ার কেউ ছোট জালি নিয়ে চুনো-মাছ ধরতে বেরোয় । কুলকুল করে হাঁটু জলে নদী বয়ে যায়। দু'পাশে  ধানক্ষেতের মেলা। শুধু সবুজ  আর সবুজ। কিছু দূর আগে একটা বালির বাঁধ নদীর জল আটকে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সেই বাঁধের আটন খুলে গেলে হাহা করে জল ছুটে আসে।  তখন দেখেছে ওরা সে নদীর ভয়ঙ্কর রূপ। এলোকেশী হয়ে ছুটে আসে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলব বলে। রাঙাপিসি বলে, ঐ ছোট্ট খুকির মত নদীতে যখন বান আসে সে বান বানই বটে। ঘরের উঠোনে এসে ছুটোছুটি করে। খলাৎ খলাৎ করে ঘরের দেয়ালে দেয়ালে জলছড়ি দেয়।গাঁয়ের লোকজন ঘরপোঁতা হয়ে চুপটি করে বসে থাকে। না পারে বাজারঘাট করতে না পারে অন্য মানুষের মুখ দেখতে। মুশকিলে পড়ে ওরা। সব থেকে মুশকিল হয় নদীর দুই পারের গ্রামগুলোর। কেউ কারোর কোনও খবরাখবর নিতে পারে না। অভাবে অসুখে সাহায্য করতে পারে না। কেননা নদীর ওপরে কোনও সেতু নেই। নেই পারাপার করার ফেরি। মাঝি নৌকো কিছুই নেই।তবু ঐ ছেলে মেয়ে দুটো কী করে যে বানে ভেসে গেল এবং ভেসে গিয়েও বেঁচে গেল সেই গল্পই বলি।
   এখন সেরকমই এক সময়।  বর্ষার মাঝামাঝি। ওরা জানেনা কখন নদীর বালিবাঁধ ধ্বসে গিয়ে হড়হড় করে জল আসবে। কেউই টের পায় না। জল ছুটেছে দুর্বার গতিতে। ভেসে যায় গরু, ছাগল।  ভেসে যায় গাছ। ভেসে যায় বাঁশ গাছের ঝাড়। একসময় সূচ-সুতো দুজনেই যায় ভেসে। জলের ঢেউ কখনো সুতোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ডুবিয়ে দেয় কখনো সূচকে। তখন ওরা কোনও রকমে হাবুডুবু খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। হাবুডুবু খেতে খেতে সুতো, সূচকে আশ্বাস দেয়, - - ভয় করিস না ভাই। এই দেখ হাত পেতে দিলাম। সূচের পেছনে জাপটে ধরে দুজনে ভাসতে থাকে। আর ভাবে আমাদের কি কেউ বাঁচাতে পারবে না! এক সময় ভাসতে ভাসতে পাশে ভাসা একটা বাঁশ গাছের ঝাড়ের ওপর  উঠে পড়ে। জলের তোরে হয়তো গেছে উপড়ে। বাঁশের ঝাড় সোঁ সোঁ করে ছুটে চলে। কিছু দূর যেতে না যেতেই দেখে সামনে ছেঁড়া কাপড় যেন ডুবছে আর উঠছে।সুতো ধরে ফেলে। এক হ্যাঁচকা টানে তুলে ধরতেই দেখে একটা বাচ্চা ছেলের প্যান্ট ছেঁড়া। সূচ আবার দুরন্ত গতির ঢেউ ভেঙে ভেঙে জলে ডুবে ডুবে একসময় প্যান্টের মালিকও খুঁজে পায়। জলের মধ্যে সে হাত পা নেড়ে নদীর পাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। সুতো বলে, - - উঠে এসো আমাদের কাছে । কোনরকমে সেই বাঁশ ঝাড় আঁকড়ে একসাথে বসে ভাসতে ভাসতে চলে। সেই ছেলেটাকে সূচ বলে তুমিও ভেসেছ আমাদের মত। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বলে সে এসেছিল মায়ের সঙ্গে গরু চড়াতে আর শাক তুলতে।  কিন্তু হঠাৎ এতো জলের তোরে মা গেল হারিয়ে। আমার গ্রামেরও কোনও টিকি পাচ্ছি না। এখন কোথায় যাই। শুনে সুতো বলে, চিন্তা নাই আমরা তো আছি। আমরাও ঘর ছেড়েছি।ঘর থেকে ভাসতে ভাসতে এখন এইখানে। থাকার জায়গা নাই। নদীর জল তখন ফুঁসতে ফুঁসতে হুর হুর শব্দ করতে করতে সেই কুল গাছের ঝাড় পেরিয়ে ছুটে যায় সামনের দিকে। ডুবে যাওয়া নিশ্চিত। আর যখন কোথাও কোনও আশা নেই তাদের। আর তখনই হঠাৎ মাঝে এসে দাঁড়ায় একটা ডিঙি। মাঝি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তোমাদের ভয় নাই আমি এসেছি। না'ও জোরে চেপে ধর। ওরা উঠে পড়ে ডিঙিতে। ডিঙি একসময় দুলতে দুলতে জলের সাথে জলের তরঙ্গে ভেসে যায়। ওরা হেসে ওঠে এক সাথে বাঁচার আনন্দে।  তারপর থেকে কত লোক যে দেখেছে সেই মাঝিকে। প্রবল বর্ষাতে নদীতে ডিঙি নিয়ে ভেসে থাকে। মানুষ পারাপার করে। দুই পারের মানুষকে সেই মাঝি বলে, না হোক সেতু, আমি তো আছি। এখন আর আমাদের গাঁয়ে বর্ষাকালে অসুবিধা হয় না। সবাই জানে মাঝি তো আছে।

   --আমি রাঙাপিসিকে জড়িয়ে ধরে বললাম--এখনও থাকে?
   রাঙাপিসি মায়ের তৈরি বাঁধাকপিরর কফিজি মুখে পুরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে  মাথা দুলিয়ে বলে - - হুম। এখনও থাকে। গেলেই দেখতে পাবি।
বোন বলল, রাঙাপিসি কোন নদীতে?
   --কেন তোদের আমাদের সব নদীতে। নদীর বানে ভেসে গেলে বাঁচাতে সেই মাঝি আসে, ওর ছোট্ট ডিঙি নিয়ে।
                      

শৈশব 

শান্তা সাহা 

পড়ন্ত বেলায় চল্ চলে যাই দুরন্ত শৈশবে,
ভোর বেলাতে ঢুলু চোখে ও মা পড়তে বসাবে ,
ভাতের থালায় উপুড় হয়ে স্নান সেরে স্কুল,
রাজ্যের যত পড়া করা,হবে না কেন ভুল? 
ফিরে এসেই ছুড়ে দিয়ে ভারী ব্যাগ  পত্ত,
খিদের কথা ভুলে গিয়ে খেলায় দেদার মত্ত,
সন্ধ্যে নামে বাগানেতে,বন্ধুরা যায় বাড়ি 
হ্যারিকেনের আলোয় ঢুলি,চোখ চুলকে ভারী,
পিড়ি পেতে ঘুম চোখেতে গরম ভাতের ডাক,
বীজগণিতে মাখামাখি তরকারি আর শাক!
একটু একটু হিমের আওয়াজ ঐ যে টিনের চাল 
ঘুমের দেশে হামাগুড়ি পিঠেপুলির সকাল!
আহা!কোথায় গেল হারিয়ে সেই অবুঝ সবুজ দিন? 
আজও আমি খুঁজে ফিরি সোনাঝরা সেই ঋণ!!

সেই জঙ্গল 

অনন্যা মৈত্র 
বেথুয়াডহরি মাতঙ্গিনী বালিকা বিদ্যালয়, দ্বাদশ শ্রেণি

 জঙ্গলটার গল্প শোনো
 নয় তো কথা অল্প কোনো 
 কাচরঙা এক নদীর ধারে 
 নীল পাহাড়ের খুব কিনারে

সেই জঙ্গল দাঁড়িয়ে ছিল 
আকাশে হাত বাড়িয়েছিল 
সবুজ পাতার চাদর গায়ে 
শীতল মিঠে সবুজ ছায়ে 

 সেই জঙ্গল বেশ তো ছিল 
 সবার খুশির রেশ তো ছিল 
 ছয়টি ঋতু করত খেলা 
 বসিয়ে দিত রূপের মেলা। 

সন্ধে সকাল ডাকত পাখি
দিন পরাত ফুলের রাখী 
সূর্য ডুবে রাত্রি হলে 
জ্বলত জোনাই পাতার কোলে।
  
সে জঙ্গলে সবাই ছিল 
সকল প্রাণীর সভাই ছিল 
হরিণ হাতি বাঘ ভালুকে 
জানোয়ারের খাসতালুকে। 

সেই জঙ্গল হারিয়ে গেল 
পাহাড়চূড়া ছাড়িয়ে গেল 
চিমনিখানা আকাশ ফুঁড়ে 
মিশল যে বিষ বাতাস জুড়ে। 

জঙ্গল আজ ইট পাথরে 
লোভ বিলাসের নেশার ঘোরে 
মরার থেকে বাঁচতে জানি 
সেই জঙ্গল ফিরিয়ে আনি।
                             

উজান
নম্রতা সাঁতরা
দ্বাদশ শ্রেণি, চন্দননগর বঙ্গ বিদ্যালয়

"জেম্মা! দিদি! দরজা খোলো" এভাবেই মিনু আধো আধো ডাকে আমাদের বাড়ি চলে আসত। আমাদের  দুটো বাড়ি পরেই থাকে তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে মিনু। তার মা তাকে আমাদের বাড়ি দিয়ে যেত এই ভেবে যে লকডাউনের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান হয়ে যাবে তার। কিন্তু কাজের কাজ কমই হত, বদমাইশই বেশি হত। বিকেলে ছাতে উঠে 'মেলা-মেলা' খেলা হত আমাদের। পড়া বলার সময় এলেই মিনুর যত উদাসীনতা দেখা যেত। আমার মা যেই বলত  -  "মিনু বলত, A for apple" অমনি ও বলত  - "চা খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি, ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!" আমরা বল নিয়ে খেলতাম অনেকক্ষণ। তারপর মিনুর সাজের সময় এসে যেত। আমাদের ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি, ক্লিপ, লিপস্টিক, কাজল কিছুই বাদ পড়ত না। সব কিছুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দিত সে। হঠাৎ একদিন দেখি মোবাইলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে "কার্টুন"! এরপর থেকে তাকে কিছু খেতে দিলে কার্টুন চালাতেই হত। এই সমস্ত করতে গিয়ে মিনু A ,B আর C ছাড়া কিছুই শেখেনি। কিন্তু একদিন এসে স্পষ্ট করে গাইতে থাকে"টুম্পা ..."দুলে দুলে সুর লাগায় নিখুঁত।সেদিন অন্য মিনু কে দেখেছিলাম। এখন সে আমাকে দেখতে পেলে বলে, "তোমাদের বাড়ি আর যাবনা"। ওর বাড়িতে চারটে মুরগি ছানা এসেছে,তাই মিনু এখন H for hen শেখে। ও আসত যখন, তখন কয়েক ঘণ্টার জন্যে আমিও শিশু হতে পারতাম। কিন্তু মিনুর আসা বন্ধ হতে আমি একেবারে নিরাশ হয়ে গেছিলাম। কিছুদিন আগে আমার পাশের বাড়ির ক্লাস ফাইভ এ পড়া নীল এসে বলল -  "দিদি,অঙ্কটা একটু বুঝিয়ে দেবে?" আমি ওকে বুঝিয়ে দেবার পর ও আমাকে জিজ্ঞেস করল  - "তুমি Hulk, Iron man কে চেনো?" আমি বললাম - "নাম শুনেছি"। ও আর একটু উত্তেজিত হয়ে বলল  - "'অ্যাভেঞ্জার্স এন্ড গেম' দেখেছো ?" আমি বললাম - "না তো"।তারপর আরো কিসব অ্যাকশন মুভির নাম বলল যার একটাও দেখাতো দূর এমনকি নামও জানা নেই। কত মোবাইল গেম এর নাম বলল, যেগুলোর একটাও আমি খেলিনা। নীল বিরক্ত হয়ে বলল - "ধুর তুমি তো কিছুই জানোনা দেখছি"। তখন মনে হল সত্যিই তো জেন ওয়াই স্মার্টনেস, পারদর্শিতার কাছে আমি কিছুই নয়। সত্যিই ওদের কাছে আমি শিশু। মিনু না আসার জন্য শৈশব বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কাটা দূরে চলে গেল। এক মুহূর্তের জন্যে নীলের কাছেও শিশু হতে পারলাম আমি।

দরজার এপার ও ওপার 

অদৃজা খাটুয়া, 
ষষ্ঠ শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর

সময়টা ছিল শীতকালের বিকেলবেলা। ঘর থেকে বেরিয়ে খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশের বাড়িটার দিকে। মেন দরজার পাশে আরো একটা ছোট্ট দরজা। এতটাই ছোট যে জানালা বলে ভুল হয়। এই বাড়িটা পিকুল কাকুদের। চাকরি সূত্রে অন্যত্র চলে যাওয়ায় বাড়িটা খালি পরে আছে। কৌতূহলবশত  ওই ছোট দরজাটা দিয়ে আমি প্রবেশ করলাম। 
  ঢোকামাত্র একটা তীব্র আলোতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলে আমার মনে হল আমি যেন অন্য গ্রহে পৌঁছে গেছি। যেই  জায়গাটায় আমি পৌছেছিলাম সেটা ছিল একটা দ্বীপ। সেখানে যত গাছ ছিল সবগুলোর রং সবগুলোর থেকে আলাদা। একটা গাছের পাতার রং যদি লাল হয়ে তবে আর একটা গাছের পাতার রং সাদা। আর ওই দ্বীপটা পুরোটাই ছিল লাল আর সবুজ রং-এর নুড়ি দিয়ে তৈরি। নুড়িগুলো এতটাই ভারী যে একমুঠো নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখলে হাত টনটন করছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ওই দ্বীপ টা তে একটাও জন্তু, এমনকি একটা পাখির আওয়াজ পর্যন্ত ছিল না। 
  কিছুক্ষণ পরে আমার একটু খিদে পেল। গাছে অনেক ফল ফলেছে কিন্তু খেতে সাহস হল না। আরও কিছুক্ষণ পরে আমার এত খিদে পেল যে থাকতে না পেরে আমি একটা ফল পেড়ে এক কামড় খেলাম। ফলটা অদ্ভুত দেখতে ছিল। ওটার রং ছিল বেগুনী, তার ওপর হলুদ ছোপ এবং সেই হলুদ ছোপের মধ্যে লাল ও কালোর ছিটে। ফলটা খাওয়ার সাথে সাথে আমার কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছিল। হঠাৎ করে আমি লক্ষ্য করলাম আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। কি ব্যাপার! ওপর দিকে তাকাতে আমি বুঝে পারলাম, ফলটা খেয়ে আমি এতটা হালকা হয়ে গেছি যে হওয়ায় উড়ে যাচ্ছি। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম এই ভেবে যে আমি কখনো মাটিতে নামতে পারবো কি না। 
  কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কি হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি সজোরে মাটিতে পড়লাম এবং জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি আমি খেলার মাঠে একটা কাঁটা ঝোপে পরে আছি। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত। আমি ভাবলাম বল কুড়োতে এসে পরে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম । আমার এই ভুল ভেঙে গেল যখন আমি দেখলাম যে আমার পাশে পরে আছে সেই আধ-খাওয়া ফলটা । ফলটাকে দেখে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম । ওই অভিজ্ঞতাটা সত্যি না একটা স্বপ্নমাত্র!


সাঁতরাইচেঙ্গার রহস্যময় সাতকাহন পর্ব- ৯

গৌতম বাড়ই

আমরা চুপটি করে ঘরে বসে বাইরের হট্টগোলে কান পেতে রয়েছি। এমন সময় বাড়ির বাইরে থেকে বাবার গলা -- তোরা বাইরে এসে দেখ কী মজার ঘটনা ঘটছে আকাশে। 
  বলতে না বলতেই মুহূর্তে বাইরে আমরা সবাই। আসলে মন তো বাইরে পড়েছিল ঘরের ভিতরের সবার। সেই আশ্চর্য রাতের আকাশ আজও ভুলিনি। সব মনে আছে। আকাশে আতসবাজির মতন লাল হলুদ সবুজ বেগুনি আলোর মত এক- একটা গোল্লা পৃথিবীর মাটি থেকে কারা যেন ছুঁড়ছে গোল্লার মতন আকাশে। নিচে রঙীন আলোয় ভেসে যাচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি। আবার রঙীন আলোর উল্কাপাত নেমেও আসছে পৃথিবীর মাটিতে। বড় সুন্দর ছিল সেই দৃশ্য। কারা যেন চিল্লিয়ে উঠল-  ঐ  যে দেখুন! দেখুন! ছায়ামূর্তির মতন কেউ যেন দেওয়ানির বড় কাঁঠাল  গাছটার তলায় নাচছে। একজন নয়। আরও এক বা দুজন। 

  আমি দেখতে পেলাম আমাদের বাড়ির কাছের বড়  রাস্তা থেকেই মানুষের মাথার সারি। সবাই দঙ্গল বেঁধে সেই আলোর ভোজবাজি দেখছে। তবে সামনে কেউ এগোচ্ছে না এক  অজানা ভয়ে।  কাঁঠাল গাছের ওপারেও মানুষ জন হৈ হৈ করছে।
গ্রামে নাকি সাদা- পোষাকের পুলিশ টহল  দেবে শুনেছিলাম। তারা কোথায়? তারা এইমুহূর্তে যেন আর না আসে আমি মনে- মনে চাইছিলাম। এত সুন্দর মহা- জাগতিক কান্ড কারখানা তো আর দেখা যাবে না। আকাশের এই আলোর খেলা। আমি তো বুঝতেই পারছি কিছুটা এই আলোর খেলার পেছনে আসল খেলোয়াড় কে বা কারা? 

  তবে এইভাবে আরও কিছুক্ষণ থেকে হঠাৎ করে সেই আলোর খেলা আকাশে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার নেমে এলো গভীর হয়ে। আকাশের আলো বন্ধ হতেই নিচে ঘন অন্ধকার। দূর থেকে আওয়াজ উঠল-- আপনারা পথ পরিষ্কার করুন। বড় রাস্তায় অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ভিড়ে এগোতে পারেনি গাড়িগুলো। তারপর দেখি পুলিশের ভ্যান এগিয়ে আসছে সামনে। পুলিশরা মুখ বাড়িয়ে কথা বলছে। বাবা আমাদের সবাইকে এবং মাকেও বললেন--- তোমরা বাড়ির ভেতর যাও। আমি পরে আসছি।

  আমাদের মনে লেগে রয়েছে সেই আলোর রেশ। মা বলছেন-- জানিস এ মনে হয় মিলিটারিদের কেরামতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছরে ১৯৭১ সালে বালুরঘাটের হিলি বর্ডারে ঘটনাচক্রে এরকম কিছুটা আলোর রোশনাই দেখেছিলাম আকাশে। তোদের  বাবা বললেন-- শত্রুপক্ষের খোঁজ নিতে মিলিটারিরা রাতের আকাশে ওরকম বিভিন্ন রঙের আলোর গোলা ছুঁড়ে দেখে বাইনোকুলারে। তবে এতটা উজ্বল নয়। ওর কাছাকাছি। 

  আমরা ভাই- বোনেরা মাকে ঘিরে ধরে গল্প শুনছি। পড়াশোনার দিনগুলি আজ বেশিরভাগ মনে পড়ে না কিন্তু এইসব গল্পগাছার দিনগুলো খুব মনে পড়ে। বাইরের হৈ-  চৈ কমলেও দূর থেকে এখনও হট্টগোল কানে আসছে। এবার আমার কানের কাছে কেউ যেন বলে গেল- কী বুদ্ধদেব কেমন লাগলো? বুদ্ধদেব তোমাদের পৃথিবীতে সবার তো নাম থাকে।         আমাদেরও প্রত্যেককে আমাদের গ্রহে এক বিশেষ পদ্ধতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সে আর বলছি না এখন। তবে তোমার কাছে আমদের  তিনজনের একটি করে নাম থাকবে। তাহলে বামন বলে পরিচয় দিয়ে আর গল্প করতে হবে না। ঐ বামন বলাটা কেমন যেন লাগে আমাদের কাছে। তাই আমাদের নাম তোমার কাছে ইলু- বিলু- তিলু।
আমরা ইলু, বিলু, তিলু। হা! হা! হা! হাসিতে কান ভরে উঠল।

  আমি টান-টান হয়ে কান খাড়া করে শুনছি। মা আর দিদি আমার ঐ অবস্থা দেখে বলে উঠল --- আরে তোর হয়েছে টা কী? ভয় পেয়েছিস নাকি কিছুতে? ভাই মায়ের কোলের মধ্যে ঢুকে গেল প্রায়।
আর এই সময় বাইরে থেকে বাবার গলা পাওয়া গেল। মাকে ডাকছেন। মা সাড়া দিতেই বাবা বাইরে থেকে বলে উঠলেন-- সর্বনাশ হয়েছে গো! বিরাট কিছু যে ঘটবে গ্রামে বুঝতেই পারছিলাম। ভয়ানক সর্বনাশ!

 কিসের সর্বনাশ? জানতে ধারাবাহিকের পরের পর্বে।


আজকের বিষয় : কয়েকটি বিখ্যাত শহর এবং তাদের বিখ্যাত উপনাম।

১. ভারতের প্রবেশদ্বার  বলে চিনি কোন জায়গা কে?
২. ভারতের হলিউড নামে কোন জায়গা খ্যাত?
৩. ভারতের কমলালেবুর শহর কোন জায়গাকে বলে?
৪. আরবসাগরের রানী বলে কোন জায়গাকে চিনি?
৫. পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার ভারতের কোন জায়গা?
৬. আমেদাবাদকে কোন নামে চিনি?
৭. নীলনদের দান  কোন দেশকে বলা হয়?
৮. ভারতের কেরালাতে সব থেকে বেশি মসলা পাওয়া যায়। তাই কেরালাকে কি নামে ডাকা হয়?
৯. পৃথিবীর কসাইখানা নামে কোন স্থান প্রসিদ্ধ?
১০.  দক্ষিণ ভারতের কাশী বললে কোন জায়গায় কথা মাথায় আসে?

গত সপ্তাহের উত্তর : 
১.হামফ্রে ডেভি  ২.হামফ্রে ডেভি  ৩. আলফা এডিসন ৪. ওয়াটার পেন ৫. ম্যাকমিলান ৬.গ্রাহাম বেল ৭.রাইট ব্রাদার ৮.ফেরাডে ৯.শকলে ১০.হিউগেন্স।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments