জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৭/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৭

শ্যামল জানা

কিউবিজম (আর্লি কিউবিজম-১৯০৯ - ১৯১৪)

কিউবিজম্ ব্যাপারটা তৎকালীন সময়ে সাধারণের কাছে বেশ জটিল ঠেকেছিল তো বটেই, এমনকি ছবির সঙ্গে যুক্ত বা সমজদারদের মধ্যেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল৷ জটিল ও দুর্বোধ্যতার প্রশ্নে সেই সব মানুষরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেছিলেন৷ কিউবিস্টদের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন৷ নাম— ড্যানিয়েল-হেনরি কহনউইলার৷ তিনি তৎকালীন ফ্রান্স-এর উঁচু দরের একজন চিত্রশিল্প সংগ্রাহক, আর্ট ডিলার, এবং প্যারিসের নামকরা এক আর্ট গ্যালারির মালিক ছিলেন৷ তিনি ১৯২০ সালের একেবারে প্রথম দিকে কিউবিস্ট শিল্পীদের পক্ষে বিবৃতি দিলেন— কীভাবে একজন কিউবিস্ট শিল্পী একটি সমতল ক্যানভাসের ওপর আঁকার সময় ছবিটির স্থান-বিন্যাস(Space) ত্রিমাত্রিক-আয়তন(Volume) এবং ভরপুঞ্জ(Mass)-র উপস্থাপন(Treatment) করেন৷ কিন্তু সেই বিবৃতিও প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে পঞ্চাশের দশক ও ষাটের দশকে৷ বিশেষ করে আমেরিকান মডার্ন আর্ট-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমেরিকান চিত্রশিল্প সমালোচক ক্লিমেন্ট গ্রীনবার্গ অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা করেছিলেন!
    এইভাবে, কিউবিজম্ দু-ভাগ হয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠলেও এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও অনেক আগে৷ অর্থাৎ ১৯১৪-রও অনেক আগে ও প্রোটো কিউবিজম্-এর(১৯০৭ - ১৯০৮) ঠিক পরে পরে ১৯০৯ সাল নাগাদ৷ তৎকালীন যে সব স্যাঁলো চিত্র-প্রদর্শনী সংগঠিত(Organise)করত, তারা বলতে গেলে সবাই ছিল সনাতনপন্থী৷ ফলে, দেখা গেল— এই সব স্যালোঁর কর্মকর্তরা একদিকে আর কহনউইলার একদিকে৷ তাতেও তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না৷ আধুনিকপন্থী যাঁরা— পিকাসো, ব্রাক, গ্রিস ও লেজার-দের পাশে কহনউইলার তাঁর সমস্ত সামর্থ নিয়ে একা দাঁড়ালেন৷ তিনি এই সব শিল্পীদের গ্যারান্টি দিলেন— তাঁরা সারা বছরে যত ছবি আঁকবেন, সব তিনি ন্যায্য দামে কিনে নেবেন৷ এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন— এই যে তিনি কিনবেন, সেটা তাঁর মহানুভবতা (Magnanimity) নয়, এটা শিল্পীদের নির্দিষ্ট অধিকার (Exclusive right) হিসেবে তিনি দেখবেন৷ শুধু তাইই নয়, তিনি আরও জানালেন— ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যত রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে শিল্পীরা নিজের মতো করে তা নির্দ্ধিধায় করতে পারেন, এই পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁদের আছে, এবং সেগুলি গোপনও থাকবে৷ আর, ওই ছবিগুলি তিনি যার-তার কাছে বিক্রীও করলেন না, তৎকালীন যে অল্পসংখ্যক ছবিবোদ্ধা ছিলেন, মাত্র তাঁদের কাছেই তিনি বিক্রী করলেন৷
    অন্যদিকে, সনাতনপন্থী স্যাঁলো-কিউবিস্টরা খ্যাতি অর্জনের স্বার্থে প্রাথমিকভাবে ধারাবাহিকভাবে চিত্রপ্রদর্শনী করে যেতে থাকল৷ এই চিত্রপ্রদর্শনীগুলি সংঘঠিত(Organise) করল মূলত স্যাঁলো দে অটোম্নে (Salon d'Automne) ও স্যাঁলো দেস ইনডিপেন্ডেটস্ (Salon des Indépendants) এই দুই অ-কেতাবী(Non-Academic) স্যাঁলো৷ আর, খুব স্বাভাবিকভাবেই আম-জনতা যাতে সহজে বুঝতে পারে, সেভাবেই ছবি আঁকল৷ কারণ, তাঁরা ছবির পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়েও অনেক বেশি জোর দিয়েছিল জনপ্রিয়তার দিকে৷
    ইতিমধ্যে ১৯১০ সালে একটি কিউবিস্ট গ্রুপ তৈরি হল৷ প্রাথমিক পর্যায়ে এতে যে শিল্পীরা যোগ দিলেন, তারা হলেন— মেটচিঞ্জার, গ্লেইজেস, ডিল্যুনে ও লেজার৷ এঁরা বুলেভার্ড দু মন্টপার্নাসের কাছে হেনরি লে ফকনার-এর স্টুডিওতে নিয়ম করে মিলিত হতেন৷ এখানে মাঝে মাঝে সান্ধ্যভোজে এঁদের সঙ্গে যুক্ত হতেন— বিখ্যাত দুই কবি গিয়াম অ্যাপোলোনীয়ার ও আঁদ্রে স্যামন, যাঁরা চিরকাল কিউবিস্টদের পক্ষে ছিলেন সর্বোতভাবে৷
   আরও কিছু যুবক শিল্পী এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হলেন, এবং মূলত জোর দিলেন ছবির গঠন(Form) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে৷ আর, এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি উদ্দেশ্যও ছিল৷ যে, নিও-ইম্প্রেশনস্টিরা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে রঙের ওপর যে জোর দিয়েছিল, তার বিরোধিতা করা!
    কিন্তু, এই সময়টা কিউবিস্টদের পক্ষে ভালো যাচ্ছিল না! এই, ১৯১০ সালে ২৬ তম স্যাঁলো দেস ইনডিপেন্ডেন্টস এর রিভিউতে লুই ভক্সেলস্ বেশ বিরূপ মন্তব্য করলেন৷ তিনি মেটজিঞ্জার, গ্লেইজেস, ডিল্যুনে, লেজার এবং লে ফকনার-এর ছবিগুলির উল্লেখ করে স্পষ্ট ভাষায় বললেন— এগুলি একেবারেই নিখুঁত নয় এবং ক্ষণস্থায়ীও বটে৷ এখানে অত্যন্ত অজ্ঞতার সাথে জ্যামিতিকে ব্যবহার করা হয়েছে! মনুষ্য শরীরকে ছোটো করে দেখানো হয়েছে! এই জায়গা অত্যন্ত ম্রিয়মান কিউবিজম্-এর জায়গা (ছবি-১)৷

    এর পরে পরেই ১৯১১ সালের বসন্তকালে ইডিপেন্ডেন্টস স্যালোঁতে মেটজিঞ্জার, গ্লেইজেস, ডিল্যুনে, লেজার এবং লে ফকনার-এরই ছবি দিয়ে কিউবিজম্-এর যে প্রদর্শনী হয়েছিল, সেই প্রদর্শনীটিই ছিল আম-জনতার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য প্রথম প্রকাশ্য প্রদর্শনী৷ কিন্তু সেক্ষেত্রেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া, বা বলা ভালো— মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল৷ (ক্রমশ)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. শ্যামল জানার লেখাগুলি পড়ছি।আলাদা করে সব সময় মন্তব্য করতে পারছি না। ব্যক্তিগত কিছু
    সমস্যা থাকায়। মোহিত হয়ে যাই তার অনবদ্য বিশ্লেষণে। আমি ছবি
    সম্পর্কে একেবারেই সমজদার নই।
    জ্ঞান সীমিত। তাই তার এই ভাবনা
    গভীর মনোগ্রাহী আলোচনা পড়ছি
    আর বিস্মিত হচ্ছি।কি সুগভীর জ্ঞান
    থাকলে এমন বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করা যায়, তাই ভাবি।
    সব সময় মন্তব্য করি আর নাই করি
    এই লেখাটি পড়ে ঋদ্ধ হচ্ছি এ কথা
    অস্বীকার করার উপায় নেই। কামনা
    করি এই আলোচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে চিত্রশিল্পের জগতে আলোড়ন ফেলবে। শুভেচ্ছা রইল।

    ReplyDelete