জ্বলদর্চি

লাবণ্যর প্রেম/সোমা সামন্ত

লাবণ্যর প্রেম 

সোমা সামন্ত 
     
বিয়ের পর এই প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে। জানালার ধারে একা দাঁড়িয়ে থাকে লাবণ্য। শেষ শীতের আবেশটুকু ডানায় মেখে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে যে যার বাসায়। সন্ধে নামছে একটু একটু করে। সাজানো গোছানো বিশাল ফ্ল্যাট নিস্তব্ধতায় মোড়া। লাবণ্যর স্বামী ডাক্তার। মস্ত বড় ডাক্তার। হাসপাতাল, নার্সিং হোম, চেম্বার সব সেরে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয় প্রতিদিন। আজ বলে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি ফিরবে। কিন্তু পরে ফোন করে জানিয়েছে, পারবে না। ইমার্জেন্সি ডিউটি আছে। জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকায় লাবণ্য। আজ মন ভালো নেই তার। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভেঙে চুরে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা।

  হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। একটা অপরিচিত নম্বর। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা কণ্ঠস্বর। লাবণ্য, কেমন আছো তুমি? আমি জানি আমার কণ্ঠস্বর তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছো। এই যেমন তুমি কথা না বললেও তোমার নিঃশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি। আজ তোমার সাথে একটু কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করলো। মনকে বেঁধে রাখতে পারলাম না। তাই ফোনটা করেই ফেললাম। তোমার মনে আছে, আজকের দিনেই একটা লাল গোলাপ দিয়ে, তোমায় প্রথম আমার মনের কথা বলেছিলাম। আর সাথে দিয়েছিলাম একটা নীল খামে লেখা রবিঠাকুরের কটা লাইন, "ভালোবেসে সখি নির্ভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে"। তুমি বলতে রবিঠাকুরের ঐ লাইনগুলোর জন্যই নাকি তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে। সে যাই হোক। রবিঠাকুরকে সাক্ষী রেখেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম একটা স্বপ্নের ভালোবাসার জগৎ। সে জগতে শুধু তুমি আর আমি। কতবার দিনের শেষে গোধূলির রঙ মেখে তোমায় শুনিয়েছি,"আমার ও পরাণ ও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো"। আর সেই দিনটার কথা মনে আছে তোমার? সেই যে কলেজর রি-ইউনিয়নের দিন, তুমি আর আমি একসাথে গেয়েছিলাম,"আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমার ও প্রাণ,সুরেরও বাঁধনে"। কি অপূর্ব সেই  অনুভূতি।

   লাবণ্য, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? তোমায় কোনোদিন হারিয়ে ফেলবো, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তারপর কালবৈশাখী ঝড়ের মতো হঠাৎ সব তছনছ হয়ে গেল। তোমার বাবা-মা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিল না। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কী? কোন বাবা মা চায় বলো, বেকার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে? না না আমি জানি, তুমি অনেক চেষ্টা করেছিলে। থাক সে সব কথা। তুমি সুখী হয়েছো তো লাবণ্য? তোমার নতুন ভালোবাসার মানুষ তোমাকে রবীন্দ্রনাথ শোনায়? তোমার চোখের জল মুছিয়ে দেয় ঠিক আমার মতো করে?নাকি আমার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে তোমায়?

   হ্যালো লাবণ্য? তুমি কাঁদছো? জানো লাবণ্য এখনো আমার সবটুকু জুড়ে শুধু তুমি। দিনের শেষে যখন সূর্যটা অস্ত যায় দিগন্তের পারে, তুমি নিঃশব্দে এসে দাঁড়াও আমার মনের উঠোনে। শ্রাবণের  শেষ বর্ষণটুকু যখন সবুজ পাতার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, আমি তোমার ভিজে চুলের গন্ধ পাই। তোমাকে ভুলতে আর পারলাম কই! দিনের আলোর গভীরে যেমন সব তারা লুকিয়ে থাকে, তেমনি তুমি চিরদিন থাকবে আমার মনের গভীরে। ভালোবাসার মৃত্যু হয় না। হতে পারে না। তুমি ভালো থেকো। তোমার নতুন মানুষকে নিয়ে খুব ভালো থেকো তুমি। আর কোনোদিন ফোন করবো না। কথা দিলাম। রাখি তবে। ফোনটা কেটে গেল।

   লাবণ্য পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের জল দু'গাল বেয়ে চিবুক ছুঁয়ে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সে চীৎকার করে বলতে থাকে, তোমাকে ভুলিনি আমি। একদম ভুলিনি। শুনতে পাচ্ছো তুমি, তোমাকে যে ভোলা যায় না। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। চমকে ওঠে লাবণ্য। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে খানিকটা সামলে নেয় নিজেকে। দরজা খোলে সে। এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী। গোলাপগুলো হাতে দিয়ে বললো,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে" তোমার জন্য সব কাজ ফেলে চলে এসেছি।আজকের সন্ধ্যেটা শুধু আমাদের দুজনের। পুতুলের মতো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে লাবণ্য। বুকের মধ্যে তখনও ঝড় বয়ে চলেছে। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। তার স্বামী ততক্ষণে ঘরের নীল আলোটা জ্বেলে দিয়ে মিউজিক সিস্টেমটা অন করে দিয়েছে। সেই রবিঠাকুর। "যদি আরো কারে ভালোবাসো, যদি আরো ফিরে নাহি আসো...."। অসহায় লাবণ্য। অতীতকে বুকে নিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে বর্তমানের কাছে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
   

Post a Comment

0 Comments