জ্বলদর্চি

আফ্রিকা (নাইজেরিয়া)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা (নাইজেরিয়া)

চিন্ময় দাশ

তিন রাজকুমারী 

অনেক অনেক কাল আগের কথা। 
এক যে ছিল রাজা। বিশাল রাজ্য তার। বিশাল সেনাবাহিনী। সাত-মহলা প্রাসাদ। ঘরে সুন্দরী সুয়োরানি। তিন-তিনজন মেয়ে। তবু শান্তি নাই রাজার মনে।
ভরা দরবার রাজার। মন্ত্রী-শান্ত্রী, উজির-নাজির, লোক-লস্কর, দাস-দাসী-- কোনও কিছুর অভাব নাই। অভাব শুধু সুখের। মনে শান্তি নাই রাজার। 
তিন-তিনটি সুন্দরী মেয়ে রাজার ঘরে। হলে, কী হবে? বিয়ে হয়নি মেয়েদের। তাই নিয়ে দিন-রাত মুখ শোনায় সুয়োরানি। এটাই অশান্তির কারণ। সব সময় মন ভার রাজার।
নিত্যদিন কানের কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর করছে সুয়োরানী-- যেমন রূপবতী, তেমনি গুনবতী আমার মেয়েরা। তবু যে কেন যে তুমি বর জোগাড় করতে পারছো না, ভগবান জানে।
শুনে শুনে কান পচে গেছে রাজার। কাঁহাতক সহ্য করা যায়? একদিন রাজা মেজাজ চড়িয়ে বলে উঠল-- গুণের কথা আর বোল না, রানি। আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো ওদের। মেয়ে তো নয়, তিনটি বাঁদর তৈরী হয়েছে তোমার। বিয়ে তো ওদের হবে না এ জন্মে। এক কাজ করো বরং। তিনটে খাঁচা বানিয়ে দিচ্ছি। সাজিয়ে রাখো তিনটাকে।  
রানিও সেটা ভালো করেই জানে। তাই চুপ করে রইল। মুখে রা নাই। রাজা দেখল, কথা শোনাবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। বলল--  মানলাম, মেয়েরা তোমার রূপসী। তা বলে, অতো দেমাক ভালো নয়, বুঝলে।
থাকতে না পেরে রানি বলল-- দেমাক? দেমাক তুমি কোথায় দেখলে?
রাজা বলল-- দেমাক নয়? বড়োটি জেদ ধরে আছেন, দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী লোকটি পেলে, তবেই বিয়ে করবেন। মেজোটি আর এক কাঁটা ওপরে। তাঁর এক কথা, দুনিয়ার সবচেয়ে রূপবান যুবকটি পেলে, তবেই উঠবে বিয়ের কথা। আর ছোটটি তো সবার উপর দিয়ে যান। বিয়ে তিনি করবেন। তবে, বর হতে হবে, ঠিক নিজের বাবার মতোটি। বাবার মতো রূপ চাই, বাবার মতো গুণ চাই, বাবার মতো রাজ্য চাই, টাকা-কড়ি চাই। বাবার মত হ্যানো চাই, বাবার মতো ত্যানো চাই। আদিখ্যেতা দেখে, বাঁচি না বাপু।
একটু দম নিল রাজা। বলল-- মেয়েদের তোমার বিয়ে হবে না এ জন্মে। এই বলে রাখলাম। দেখে নিও।  
আর সহ্য হল না রানির। এমনিতেই মেয়েরা তার দু'চোখের মণি। তাদের নামে কটু কথা সইতে পারে না। তার উপর বিয়ে হবে না শুনে, রানির মাথা গেল গোল পাকিয়ে। চোখ পাকিয়ে বলল-- কোন কথা শুনতে চাই না। এই চাঁদেই আমার তিন মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। এই আমি বলে রাখলাম তোমাকে।
আকাশ ভেঙে পড়ল রাজার মাথায়। আজ সবে পূর্ণিমা। চাঁদ থাকবে আর মাত্র চোদ্দ দিন। এর মধ্যে তিন তিনটে বর জোগাড় করা, সম্ভব না কি?
রানিও জানে, কাজটা সোজা নয়। হাসি হাসি মুখ করে রানি বলল-- একটা উপায় বলে দিচ্ছি তোমাকে। কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
   রাজা ভরসা পেল খানিক। বলল-- বলো তো উপায়টা কী? আমি তো হয়রাণ হয়ে যাচ্ছি।
 রানি বলল-- মেয়েদের বিয়ে দেব আমরা-- এটা ঘোষণা করে দাও। তবে, যে ছেলে আমার মেয়েদের নাম বলতে পারবে, তার সাথেই বিয়ে হবে। সে যদি, একজনই পারে, একজনের সাথেই তিনজনের বিয়ে দেওয়া হবে। বলে দাও তুমি।
বলছো কী তুমি? রাজা চমকে গেল।
রানী হেসে বলল-- বুঝতে পারছো  না তুমি। রাজবাড়ীর মেয়েদের নাম বলতে পারাটা, সোজা কথা নয়। কেউ পারলে, বুঝতে হবে, দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার মেয়েদের। তাছাড়া, এক ছেলের সাথে বিয়ে হওয়াই তো ভালো। এক বাড়িতে মিলমিশ করে থাকতে পারবে তিনটিতে।
রাজা আর আপত্তি করল না। রানির কথা মত কাজ করাই ভালো। পরে কোনও ঝামেলা হলে, তার দায় রাজাকে নিতে হবে না। হাসি মুখে মাথা নেড়ে দিল রাজা।
   তিন রাজকুমারির বিয়ে হবে-- বড় বড় ড্রাম বাজিয়ে, সারা দেশে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। ঝুড়ি ঝুড়ি উপহার নিয়ে, কত কত সব রাজকুমার আসতে লাগল। কিন্তু রাজকুমারিদের নাম বলতে পারল না কেউই। দিন দুই-তিন যেতেই, পরিষ্কার হয়ে গেল, বর পাওয়া যাবে না। রানির ভারি মন খারাপ। রাজারও সেই দশা।
   অমাবস্যার আর মাত্র একদিন বাকি তখন। থুপ-থুপ করে এক কচ্ছপ এসে হাজির হল রাজবাড়িতে। বলল-- আমি বিয়ে করতে চাই তিন কন্যেকে।
রাজা তো হেসেই বাঁচে না। কত কত রাজার ছেলে গেল তল, একটা কচ্ছপ বলে কি না ... ।
রাজা বলল-- একটা শর্ত আছে এই বিয়ের, তা জানো তো? 
কচ্ছপ বলল-- না জেনে কি এসেছি না কি? গোটা রাজ্য জানে শর্তের কথা।
রাজা বলল-- আর একটা শর্ত জুড়ে দিলাম এখন। মেয়েদের নাম না বলতে পারলে, তোমাকে কেটে ঝোল রেঁধে খাওয়া হবে।
কচ্ছপ হটবার পাত্র নয়। বলল-- তাতেও আমি রাজী। তবে, কথা দিতে হবে, নাম বলতে পারলে, তিন মেয়েরই বিয়ে দিতে আমার সাথে। তখন না বললে, চলবে না কিন্তু।
   তিন রাজকন্যা এসে হাজির হয়েছিল মজা দেখবে বলে। আহা, কী তাদের পোশাক! কী রূপ তিন মেয়ের। আলো হয়ে গেছে গোটা রাজসভা। রাজা বা রানি মুখ খুলবার আগে, তারাই বলে উঠল-- কথা দিলাম, তাই হবে। আগে নামগুলো ঠিকঠাক বলো দেখি তুমি। 
ভরা দরবার। সে এক অবাক কান্ড। গুজগাজ, ফিসফাস, কানাকানি, হাসাহাসি-- সে এক মজাদার অবস্থা। সবারই ভাবনা-- এত সাহস হল কী করে একটা পুঁচকে কচ্ছপের? তাছাড়া, রাজার মেয়েদের নাম কচ্ছপই বা  জানবে কী করে? 
   আসল ব্যাপার সেটাই। রাজার ছেলেরা সব যখন গোমড়া মুখ করে বিদায় নিল, ভারি লোভ হয়েছিল কচ্ছপের। সে গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হয়েছিল রাজবাড়িতে।
প্রথমে এক দাসীকে ধরে পড়ল সে-- হ্যাঁগো মেয়ে, রাজকন্যেদের নাম কী গো?
   সে মেয়ে যখন বলল না, তখন এক সেপাইকে জানতে চাইল কচ্ছপ। সেপাই বলল-- চুপ চুপ! আমাকে শূলে চড়াতে চাও না কি তুমি? কেটে পড়ো এখান থেকে। 
একে একে কতজনকে জিজ্ঞেস করল। কেউ রা-টিও কাড়ল না। রাজবাড়ির আদবই আলাদা-- গজগজ করতে করতে মনের দুঃখে ঘরে ফিরে এল বেচারা।  
নদীর পাড়ে, গর্ত বানিয়ে কচ্ছপের বাড়ি। সেখানেই রাজার আপেল বাগান। সেদিনই হয়েছে কী, তিন রাজকন্যা বাগানে এসেছে আপেল পাড়বে বলে। অন্যদিন লোকজন দেখলেই, টুক করে গর্তে সেঁধিয়ে যায়  কচ্ছপ। আজ কিন্তু গর্তের একেবারে মুখে ঘাপটি মেরে বসে রইল সে।
মেয়েরা আপেল পাড়ছে যত, হুটোপাটি, নাচানাচি করছে তার চেয়ে বেশি। এ ওর নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। সব কানে যাচ্ছে কচ্ছপের। ঘরে বসেই তিন মেয়ের নাম জেনে গিয়েছে সে। 
   সেই সাহসেই রাজবাড়িতে এসে হাজির হয়েছে আজ। 
দরবার ভরা লোক। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে, কী ঘটে দেখবার জন্য। রাজা বলল-- বলো তাহলে, আমার মেয়েদের কী নাম।
   কচ্ছপের মুখে সে কী আহ্লাদের হাসি। খোলের ভিতর থেকে লম্বা গলা বের করে, বড় মেয়েটির দিকে তাকাল। বলল-- এর নাম হল সূচনা। তারপর মেজটির দিকে-- এ হল মধ্যমা। ছোট মেয়ের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল-- আর, এ হল সমাপ্তি।
   সভাসুদ্ধ সবাই থ। কথাটি নাই কারও মুখে।
কচ্ছপ এবার রাজাকে একটা লম্বা কুর্নিশ জানিয়ে বলল-- এক রাজ্যেই তো বাস করি। রাজকুমারিদের নাম জানা, কী এমন কঠিন কাজ? সামান্য বুদ্ধির ব্যাপার।
   ধন্য ধন্য করে উঠল সবাই। তারিফ করতে লাগল কচ্ছপের। কুৎসিত কিম্ভূতকিমাকার উভচর একটা জীবের সাথে বিয়ে হয়ে গেল রাজার তিন সুন্দরী মেয়ের।
   এদিকে মনে আনন্দ হবে কী, ভারী দুশ্চিন্তা এসে চেপে বসল, কচ্ছপের মাথায়। একে তো বউ নিয়ে শান্তিতে ঘর করা, বেশ কঠিন কাজ। তাও আবার রাজার দুলালী মেয়ে। আরও বড় কথা হল, তিন-তিনটি বউ। বউ নিয়ে বাড়ি চলেছে বটে, তার মন জুড়ে আছে এক বোঝা ভয় আর ভাবনা।
  ভাবনায় মাথা ভার মেয়ে তিনটিরও। কচ্ছপের পিছনে পিছনে চলেছে তিনজন। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না তারা। কী চেয়েছিল তারা। আর, কী হয়েছে শেষে ! ঘেন্নায় অনুশোচনায় মরমে মরে যাচ্ছে বেচারা মেয়ে তিনটি।
   রাজধানির বাইরে বন। কচ্ছপের বাড়ি আর দূরে নয়। বনের ভিতর একটু এগিয়েছে, অমনি বড় মেয়েটি বলল-- আমি আর যাচ্ছি না। এখানেই থাকলাম। বলেই, হলুদ রঙের সুন্দর একটি পাখি হয়ে গেল সে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসে পড়ল।
আর খানিক এগিয়ে, ছোট মতন একটা পাহাড়। সেখানে পৌঁছে, মেজ বলল-- আমিও যাচ্ছি না আর। এখানেই থাকলাম। বলে, সুড়ুৎ করে একটা পাথরের খাঁজে ঢুকে পড়ল, একটা কাঠবেড়ালি হয়ে।
এবার নিজের ঘরে এসে হাজির হল কচ্ছপ। পিছনে একটিই বউ এখন তার। যেখানে মাটি শেষ, জলের শুরু-- সেখানেই তার ঘরবাড়ি, একটা গর্তের ভিতর। 
রাজার মেয়ে একবার গর্তের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর এক লাফ। ঝুপ করে গিয়ে পড়ল নদীর জলে। মাছ হয়ে, পাখনা মেলে জল কাটতে কাটতে নেমে গেল জলের গভীরে। 
   তোমরা যারা এই গল্প পড়বে, যখনই গাছের ডালে কোনও পাখি দেখবে, পাহাড়ের খাঁজে ঘুরে বেড়াতে দেখবে কোনও কাঠবেড়ালিকে কিংবা রঙিন কোন মাছকে খেলে বেড়াতে দেখবে নদীর জলে-- তখনই একবার অন্তত রাজার সেই নাক-উঁচু তিনটি মেয়ের কথা যেন মনে পড়ে তোমাদের। যুগ যুগ ধরে, আজও নিজেদের দেমাকের ফল ভুগছে তারা।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments