জ্বলদর্চি

ফুরায় শুধু চোখে/আবীর ভট্টাচার্য্য

ফুরায় শুধু চোখে  

আবীর ভট্টাচার্য্য
 
কলকাতার এক বিখ্যাত নার্সিংহোমে শুয়ে আছেন মন্দিরা। বেশ কয়েকদিনের যমে-মানুষে টানাটানির পরে আজ অবস্থা কিছুটা সন্তোষজনক। একটু একটু করে চেতনা ফিরছে, সবচাইতে খারাপ লাগছে বৃদ্ধ-কর্তার মুখটি দেখে, কি আকুল হয়ে তাকিয়ে আছেন, কথা কিছু বলছেন না, ছেলেরা দোষ দিচ্ছে, নিজের দিকে কেন তাকাননি তিনি, তারা কর্মসুত্রে প্রবাসী, ফোনেই মা-বাবার খবরাখবর নেয়...এতো অসুস্হ হয়ে পড়েছেন,কেন যে শরীর আগে জানান দিলো না.... সত্যিই সেদিনের কথা একেবারেই কিছুই মনে নেই তাঁর। সকাল থেকেই ভীষণ গরম লাগছিলো, অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু সংসারের হাজারো ঝামেলায় পাত্তা দেননি, ভেবেছিলেন, তেমন কিছুই নয়; সব কাজ সেরে স্কুলে পৌঁছেছিলেন, প্রথম ক্লাশটাও নিয়েছিলেন, ক্লাশ থেকে ফেরার সময় কেমন যেন মাথাটা টলে যায়, অনেকগুলো কচিগলার চিৎকার শুনতে শুনতে যে কোথায় হারিয়ে গেলেন, আর কিছু মনে নেই.... আবার কাল ঠিকঠাক চেতনা ফিরলো যখন, শুনলেন, উনি নাকি পড়ে গিয়েছিলেন, শহরের হাসপাতাল বিপদ বুঝে কলকাতায় ট্রান্সফার করে, সেখানে ওনার জরুরী ভিত্তিতে হার্টের বাইপাস অপারেশান করতে হয়.... পরিস্থিতি খুবই জটিল ছিলো, অন্য আরও অনেক সমস্যাও ছিলো,তবু এখানকার এক ডাক্তারবাবু নিজের দায়িত্বে সবকিছু করেন। এমনকি আপৎকালীন অর্থ ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা-সংস্থানও.... সেই পরিস্থিতিতে অসহায় কর্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন, পরে ছেলেরা এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়, কিন্তু সেই হৃদয়বান ডাক্তারবাবুর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। তাঁরও ভালো লাগছিলো শুনতে, যে সময়ে সবাই ডাক্তারদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় প্রতিনিয়ত, সেখানে এমন মানুষেরা আছেন বলেই তো জগৎ চলছে...স্কুলে পড়ান তিনি, মনে মনে অহঙ্কার করেন মানুষ গড়েন, এমন মানুষদেরও নিশ্চয় গড়েছেন কোন শিক্ষকই....পরম শ্রদ্ধায় একবার ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

  অ্যটেন্ডেন্ট মেয়েটি বললেন, 'স্যর প্রতিদিন তো দুইবার এসে দেখে যান আপনাকে, বিশেষ যত্নে  নিয়মিত খোঁজখবরও নেন, আজ রাতে যখন আসবেন, দেখা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই.... তিনি অপেক্ষায় রইলেন, দেখবেন একবার, ধন্যবাদ জানাবেন নিজমুখে তাঁর প্রাণদাতাকে, এই আশায়। কিন্তু বিধি বাম,  অন্য কোন রুগীর জন্য নাকি হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তারবাবু, তাই আসতে পারলেন না, খবর নিয়েছেন তার কাছে, জানালো মেয়েটি, তাছাড়া এখন তো তিনি প্রায় সুস্হ হয়ে উঠছেন.... অকারণেই বড়ো অভিমান হলো, কেন কে জানে! এমন তাঁর মাঝেমধ্যেই হয়.... পরদিনও কাটলো, বেশ সুস্হবোধ করছেন, শুনলেন আগামীকাল চেক-আপের পরে হয়তো ছাড় পাবেন। 

  পরের দিন যথাবিহিত সব পরীক্ষা হলো, এক নতুন কমবয়সী ডাক্তার দেখলেন, আশ্বস্ত করলেন, ছেড়ে দেওয়ার কথাও বললেন। 

   ভালো লাগছিলো অনেকদিনের পরে বাড়ি ফিরবেন, কিন্তু যিনি তাঁর চিকিৎসা করলেন, সুস্থ করলেন, সেই ডাক্তারবাবু একবারও আর এলেন না, নাকি হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তবে আসতে না পারলেও  খোঁজ নিয়েছেন নিয়মিত, নার্স মেয়েটির কাছে শুনেছেন.... একবার দেখার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও তিনি কিছুই বললেন না মুখে। যথারীতি সকালবেলা অ্যটেন্ডেন্ট মেয়েটি ওঁকে সাজিয়ে দিলো, কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিতে ছেলেরা ব্যস্ত, তিনি কর্তার সাথে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়..... আনমনেই কি যেন ভাবছিলেন, হঠাৎ ছেলেদের সাথে এক ভদ্রলোক তাঁদের দিকে এগিয়ে এলেন একখানি লালগোলাপ নিয়ে, রুগীকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাবার সময়ে এভাবেই নাকি পাঠানোর নিয়ম এ প্রতিষ্ঠানে, মেয়েটি বলছিলো, ঐ তো স্যর নিজে আসছেন.....কর্তার কৃতজ্ঞদৃষ্টি বুঝিয়ে দিলো, ইনিই সেই ডাক্তারবাবু.... কিন্তু এ তিনি  কাকে দেখছেন...এ যে....এ যে.... তাঁর চোখের সামনে ভাসতে লাগলো কিশোরীবেলার স্মৃতি.... এক শিক্ষকবাবার এক মেধাবী ছাত্র তার গুরুকন্যাকে এমনই কোন এক বসন্তদিনে একটি লালগোলাপ দিতে এসেছিল, দ্বিধায়, লজ্জায় মেয়েটি নেয়নি, ছেলেটি ভুল বুঝেছিলো, অপমানিত মুখে বলে গিয়েছিলো, 'একদিন এ গোলাপ তোকে নিতেই হবে'.....আর দেখা হয়নি, জীবন এগিয়ে গিয়েছে নিজের মতো, জীবনের ব্যস্ততায়, পূর্ণতায়, ভুলেও গিয়েছিলেন সব...এখন আবার চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে শরৎমেঘের মতো.... যাইহোক, ডাক্তারবাবু এলেন, পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, তিনি বুঝতে পারলেন, চিনেছেন তাঁকে, কিন্তু কোন সুযোগ না দিয়েই গোলাপটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ভালো থাকবেন ম্যডাম, খুব ভালো থাকবেন”, হাত মেলালেন কর্তার হাতে, এবং তাঁকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের গতিতে ফিরে গেলেন.....বিবশ মন্দিরা ভাবলেন, সেদিনও বলতে পারেন নি, আজও পারলেন না মনের কথাটুকু বলতে....কত কথাই যে না বলা থেকে যায় এ জীবনে! ছেলেরা ডাকলো, বাড়িতে চলো মা...... তিনি ফিরে চললেন আপনবৃত্তে, স্বামী-পুত্র-ছাত্র নিয়ে তৈরী ভালোবাসার বৃত্তে....উনি যে তাঁকে ভালো থাকতে বলে গেলেন.... 

   কিছু ভালোবাসা অব্যক্ত, অপ্রকাশিত হয়েও থেকে যায়, যায় বইকি জীবনভর; কোন এক অলক্ষ্য-বন্ধনে বেঁধে রাখে দুই নর-নারীর জীবন; শ্রদ্ধায়, সম্মানে, মিলনে, প্রত্যাখ্যানে, আসক্তি-অনাসক্তি পেরিয়েও হয়তো এক দুর্লঙ্ঘ্য অভিমানে। যা অনাক্রম্য, উপভোগ্যও বটে.....শিউরে উঠলো মন্দিরার কিশোরী মন, এই প্রৌড়াশরীরেও। এভাবেও ভালোবাসা যায়!

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments