জ্বলদর্চি

আলোছায়া প্রেম/সূর্যকান্ত মাহাতো

আলোছায়া প্রেম

সূর্যকান্ত মাহাতো

"রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।"

ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভে প্রথম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীকার জ্ঞানদাসের পূর্বরাগ পর্যায়েরএই পদটি পড়েছিলাম। তখন এক একটি পদ মুখস্থ করেছিলাম কেবল পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। এর নিহিতার্থ রস গ্রহণের কোনো বালাই ছিল না। পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মান, মাথুর সব কিছুই যে একমাত্র রাধা-কৃষ্ণ কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত কেবল এটুকুই জানতাম। আমাদের মতো পাঠকদের জীবনেও যে পূর্বরাগ,অনুরাগ, অভিসার হতে পারে সেটা ছিল তখন কল্পনাতীত। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আমি শিক্ষকের পাঠদানে এবং রাধাকৃষ্ণের গভীর প্রেমের বিবরণ শুনে কখনো লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি, কখনো বা মাথানত করে মুচকি মুচকি হেসেছি।

  তার অনেক বছর পর একদিন এক পড়ন্ত বিকেলের নিয়ন আলোয় বাস স্ট্যান্ডের এক কোনায় আটকে গিয়েছিল আমার দুই চোখ। সেই সৌন্দর্যে আবিষ্ট আমার দুই চোখে তখন কেবলই মুগ্ধতা ঝরে পড়ছিল। কয়েকটা মুহূর্ত যেন এক অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিল। সৃষ্টি করেছিল এমন এক অনুভূতির মনে হচ্ছিল যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি। মনোরম ওই বিকেলে যে রক্তপ্রবাহের অস্থিরতা শুরু হয়েছিল তার একটা রেশ বেশ কিছুদিন ধরে চলল। মনে ভালোলাগার যে অনুরণন শুরু হয়েছিল সেটা মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে পরদিন থেকে ওই বাস-স্ট্যান্ড টি অতিক্রম করার সময় চোখ দুটো ওই দিকে চুম্বকের মতো টানত। নিজের অজান্তেই দু চোখের দৃষ্টি কিছু খুঁজতে লুকিয়ে ওই দিকে বারেবারেই চলে যেত।

   মনে একটা নিদারুণ প্রত্যাশা ফের যদি একবার মোহময়ীর(আমার চোখে) দর্শন লাভ ঘটে। কিন্তু না। স্মরণীয় সেই বিকেল তারপর আর ধরা দেয়নি। সেটা মনের মধ্যে হাজারো স্মৃতির ভিড়ে যেন একটু একটু করে ঢুকে পড়েছে। পুনর্দর্শন লাভে বঞ্চিত হতে হতে সেই আশা একরকম ছেড়েই দিলাম। আর সেই সুন্দর মুহূর্ত টা এক রঙিন খোপে সজ্জিত হয়ে রইল মাত্র।

   একদিন সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছি। একটি মোটর বাইক আমাকে ওভারটেক করল। হঠাৎ করে দেখি বাইকের পিছনে বসা একটি মেয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে সমানে দেখে যাচ্ছে। আমি খুব অবাক হলাম। চলন্ত বাইকে ওভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে তার যেমন কষ্ট হচ্ছিল তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। অনেকটা দূরে সরে যাওয়ার পর মনে হল, আরে সেই মেয়েটি না! বুকটা কেমন ছলাৎ করে উঠল। ওর লম্বা চুলের বিনুনীটার মতোই একটা দোলা খেলে গেল আমার সর্বাঙ্গ শরীরে। বারবার ওভাবে আমাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল কেন? সেই প্রশ্নটাই আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছিল। তবে কি কিছু বলতে চাইছিল? না, কিছু বোঝাতে চাইছিল? মাথা আমার কাজ করছিল না। একাধিক প্রশ্নমালা আর কৌতূহল মনে যেন দাঙ্গা শুরু করে দিয়েছিল। কোনও সমাধান সূত্র তো পাচ্ছিলামই না বরং চিন্তা ভাবনা গুলোই আরও বেশি করে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।

  ফের ধূমকেতুর মতো আবারও হঠাৎ করে তার হারিয়ে যাওয়া। মনের মধ্যে জমে থাকা একটা অসীম কৌতূহল আবারও উত্তর না পেয়ে পেয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ল। সেই জৌলুসটাই হারিয়ে যেতে লাগল। পরেপরেই চাকরি পেলাম। সেই সূত্রে বাইরেও চলে গেলাম। নানা কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে ওসব আর ভাবনায় ছিল না। একেবারেই যে ছিল না তা নয়। মাঝে মাঝেই ওই দুটো দিন উঁকি মেরে যেত মনের জানালায়। একটা ভালোলাগা আর কৌতূহল তখন মনকে বড়ই বিচলিত করে তুলত। পরে ফের হারিয়ে যেত স্মৃতির গহীনে। কেবল ঐটুকুই। ভালোই ছিলাম।

   সেদিন স্কুল থেকে সবে ফিরেছি মাত্র। হোয়াটস আপে নতুন একটা নম্বরে 'হাই' লেখা মেসেজ এল। ডিপির ছবিটা দেখলাম একটা গোলাপ ফুলের। কে না কে ভেবে রিপ্লাই দিইনি। 

   দুদিন পর ফের মেসেজ এল--- চিনতে পারোনি বোধ হয়? কী করেই বা পারবে!

   তবুও আমি নিরুত্তর। ভাবলাম কেউ মজা করছে। তারও কিছুদিন পর একটা লম্বা মেসেজ এল-----

  হাই। আমি রিমি। মনে পড়ে এক আলোছায়া সোনালী বিকেলে তুমি বাস স্ট্যান্ডে মুগ্ধতার সঙ্গে বারেবারে আমাকে ঘুরেফিরে দেখছিলে? জানো, তোমার ওই প্রতিমা দর্শন করার মতো মুখটা মনে পড়লেই এখনো আমার মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অন্যের মতো ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি নয়, একটা নিষ্পাপ চাওনি দেখেছিলাম তোমার মধ্যে। যা আমাকে বিমুগ্ধ করেছিল। আর সেদিন বাবার সঙ্গে বাইকে বসে তোমাকে যখন বারবার দেখছিলাম, খুঁজছিলাম তোমার মুগ্ধতা মাখা সেই দৃষ্টিটা। পাইনি। তবে সেদিন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কী সুন্দর নিজের খেয়ালে একাকী সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলে। আমায় দেখে যখন প্রচন্ড কৌতূহল আর একটার পর একটা প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছিলে আর অসহায় বোধ করছিলে সেটা ভেবেই তখন আমার হাসি পাচ্ছিল। সেদিন কেন, ভাবলে আজও হাসি পাই। জানো তো, কলেজ শেষে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতাম বাস স্ট্যান্ডের ওই কোনাটায়। মন বলত তুমি আসবেই। একটা রবীন্দ্র সংগীতের লাইন খুব মনে পড়ত ---"প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে---" কেন যে মনে মনে তোমাতে ধরা দিয়েছিলাম তা আজও আমার হিসাব নিকাশের বাইরে। যাই হোক তুমি এলেই আমি লুকিয়ে পড়তাম। নয়তো একটু আড়ালে সরে যেতাম। দেখতাম তোমার চোখ দুটো হন্যে হয়ে আমায় খুঁজছে। কিন্তু দেখতে পেতে না। আসলে তোমার সামনে আসতে লজ্জা পেতাম। তাই নিজেকে ইন্দ্রজিতের মতো মেঘের আড়ালে রাখতেই ভালো লাগত। আর মনে মনে বলতাম, ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে হয় তারপরেও যদি ফিরে আসে সেই তবে চিরকালের হয়। তাই বলে নিজেকে দূরে রাখতাম মানে এই নয় যে একেবারেই দূরে সরে গিয়েছিলাম।     তোমার সব খবর রাখতাম। কোথায় যাও, কী কর, কবে চাকরি পেয়েছো, কোথায় পেয়েছো সব সব। জানো তো এখন আমিও চাকরি করি। তাই তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। তোমার কাছে ভালোবাসার আস্তানা চাই। পাওয়া যাবে? উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

   নিরুত্তর নির্বাক আমি কিভাবে নিজেকে সামলেছিলাম সেই ব্যাখ্যায় আর গেলাম না। আজ সে আমার গৃহিনী। তবুও মাঝে মাঝেই আজও ইন্দ্রজিতের মতো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments