জ্বলদর্চি

ওগো দুখজাগানিয়া/শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

ওগো দুখজাগানিয়া

শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার 

"তুমি তো নিজেই স্মৃতি প্রণয়-অঙ্গুরী আমি অনামিকা থেকে কখনো খুলিনা, কোনদিন..."

তর্জনী মধ্যমা বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে নেমে আসা কালো কালো অক্ষরেরা সাদা পাতায় এলোমেলো ছড়িয়ে পড়তেই উড়ে যায় কত বিবর্ণ বিষণ্ণ হলুদেরা মনকেমনের ধূসর অরণ্যের খোঁজে আর সেইসব ঝরাপাতাদের বুকের তলায় বিছিয়ে থাকে অরূপ ফুলের রেশমী চাদর... লাজুক মুখে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকে ব্যথার শিউলি গাছ। কোনো এক অগোছালো বেহিসাবি মুহূর্তে যেখানে এসে থমকে গিয়েছিল তিরতিরিয়ে কাঁপতে থাকা নিবিড় কবিতা সংলাপ। বাবার অফিস কলিগদের সঙ্গে সপরিবারে যাত্রা করছি মেঘ পাহাড়ের দেশে। সেই প্রথম পাহাড় দেখার আনন্দ কেমন মিইয়ে গেল ঝুপ করে নেমে আসা কুয়াশার ছোঁয়াচ লেগে। গোটা বাড়িটায় খাঁ খাঁ করবে 
"সে নাই সে নাই"! 
 ওকে যদি নিয়ে যেতে পারতাম! তবুও সঙ্গে রইল নাছোড়বান্দা 'সে'। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে, তিস্তার সোহাগী ঢেউয়ের কানাচে দাঁড়িয়ে কেবল তাকিয়ে রইল আমার দিকে। দুচোখে টলটলে অভিমান। আমার কেবলই মনে পড়তে লাগলো উঠোনের মাঝে খুব একলা হয়ে থাকা শিউলি গাছটার কথা যাকে ফেলে আমি চলে এসেছি আনন্দ ভ্রমণে।
ভুলে থাকার অভ্যাসে কেটে গেছে কতগুলো পরিপাটি সকাল বিকেলের অবধারিত অনুশীলন। আকাশবাণীর ভোরের নিরুদ্বিগ্ন আয়াসে কেউ হঠাৎ আসে। ঝড় সামলায়। ঘনবর্ষায় ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে দাঁড়ায় অনন্ত প্রতীক্ষার স্টেশনে। একটা অলঙ্ঘ্য সীমার দু'পাশে দুজন। কানাগলিতে বারংবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসার ব্যর্থতা মিশে গেল সেদিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ব্যথায়,কষ্টে, যন্ত্রণায়।নির্জন সেই প্রহরগুলোর সাক্ষী থাকে অযুত শব্দ আর সুরের সাগর কিনার বেয়ে আসা
-"এই গানগুলো শুনো। এগুলো সব তোমাকে বলা আমার কথা।"
যেকথায় মেঘলা দুপুরেও আলো ফোটে ঘোলাটে আকাশে, যে কথার টানে মিথ্যে হয়ে যায় সমাজ সংসারের চুলচেরা কাটাকুটি খেলা। রাধার অভিসার যাত্রার পথের সকল কন্টক ঢেকে যায় কুসুমে কুসুমে। কেবল অলক্ত চরণ চিহ্ন একান্ত অন্তরালে বুনে চলে বিরহ ব্যথার কাব্য। আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর পিছিয়ে গেলে ভালোবাসার অনুষঙ্গে ফুটে থাকে...

"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর   মাহ ভাদর 
শূন্য মন্দির মোর"

  চারদেয়ালের ঘেরাটোপ ছেড়ে সে ছড়িয়ে পড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানমাঠে, খিড়কির পুকুরের শ্যাওলা মাখা সিঁড়ির সজল প্রশয় মেখে দূরে আরো দূরে
"চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই সদা মনে হয় যদি দেখা পাই..."
   সে আসে। দেখা হয় অথচ বলা হয়না সেসব কথা সাহস করে। উত্তরবিহীন চিঠিরা জেগে থাকে কত কত নির্ঘুম রাতে। যুগযুগান্তরের সেই অজস্র বলা না বলা শব্দ রাশির সংকেতে কৃষ্ণচূড়ায় আবীর রং লাগে, ছড়িয়ে থাকে আমের মুকুল, বাতাবিলেবু ফুলের সুবাস উদাস দুপুরের মৃদু উষ্ণতায়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রাধাচূড়া, সোনাঝুরি, জারুলেরা ধুলো মেখে। তারাই চুপিচুপি সাক্ষী থাকে কত কত ভাঙা গড়ার। মনে পড়ে একবার এক বকুল গাছ তার গল্প বলেছিল আমায়। প্রতি গোধূলি বেলায় একজোড়া অসমবয়সী মানুষ এসে বসত তার নীচে। একটু দূরেই কচিকাঁচাদের হুটোপুটি। অথচ ওরা গাছতলায় এসে দাঁড়ালেই এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য ঘিরে ফেলত ওদের। গাছটি ভিজে উঠত তেমন কোনো গন্তব্য না থাকা সম্পর্কের অদ্ভুত নির্যাসে।
  -আমাকে একটা চিঠি লিখবে?
-হ্যাঁ। রাখবে কোথায় তাকে?
- না হয় ভাসিয়ে দেবো জলে। তবুও লিখো আমায় ভেবে।
-তুমিও লিখবে তবে।
   একদিন সত্যিই দুটো চিঠি পাশাপাশি ভেসে গেল লেকের জলে। চোখের জলে ভিজে যাওয়া অস্পষ্ট অক্ষরেরা মিশে গেল বিপুল শূন্যতায়। তারপর একসময় সেই না সম্পর্কের মানুষদুটোর আসা থেমে গেল। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সে ঝুরঝুরিয়ে ঝরিয়ে দিত মুঠো মুঠো ফুল। যেখানে জীবনের শতেক বাধা এসে হাজির হয় সেখানেই অনাবিল প্রেম বাসা বাঁধে অথচ জীবন যেখানে অবারিত প্রেমের ডাকে সেখানে নিঃশব্দে দুয়ার বন্ধ হয়। বেবাক প্রশ্নেরা মাথা কুটে মরে চির স্তব্ধতায়। অনিঃশেষ দোলাচলতার অসহনীয় প্রহর ঢাকে কৃষ্ণ মেঘের জটিল জাল। যে গতকালও ভীষণভাবে কাছে ছিল হঠাৎই সে হারিয়ে যায় চির অচেনার ভিড়ে।

    পিছনের দিনগুলো সশব্দে হেসে ওঠে... কিছুই যেন মেলে না। প্রতি মুহূর্তই যে নতুন! কোথাও কোনো প্রতিরূপ যে নেই আর। একজন খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে তোলে নিজেকে...কেবল যে আঁকড়ে থাকে স্মৃতি অজস্র দহনে জ্বলে যায় সে। তবুও এ ব্যথার অন্ধকারে নিজের মুখোমুখি । ভুলে থাকা 'আমি'কে বুকে তুলে, ভাঙাচোরা টুকরোকে জুড়ে জুড়ে পথ হাঁটে যেন নতুন কেউ। ভালোবাসা যে শুধু পাওয়ার নয়, হারানোরও...বেদনায় তার উদযাপন।

   এমন হারিয়ে যাওয়াকেই "হে বন্ধু বিদায়" বলে মেনে নেওয়ার আগাম প্রতিরোধে যার নাম  লিখে রাখি 'মিতা'  ভর দুপুরের ব্যস্ত শহরে সে রাতের আকাশ দেখতে চায়। হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রদের আলোয়  হাত রাখে হাতে
"পাখির পালকে ভালোবাসা-বাসি খেলা
এসো আজ খেলি একলা জগৎ ভুলে..."
   ভুলতে চাইলেও কি ভোলা যায় এইসব ধুলোখেলা ছবি? কফি হাউজের টেবিলে যেন অনন্তকালের উপহার হয়ে আছে একগুচ্ছ মুক্তো চুড়ি , মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতা সংগ্রহ যার প্রথম পাতায় সে লিখে দিয়েছে একান্ত অনুভবের আখ্যান, ছন্দে গেঁথে। দেখা হলেই গান ছুঁয়েছে ঠোঁট , পথ হারিয়ে ফেলেছি হাঁটতে হাঁটতে পাশাপাশি।
   এসব কস্তুরী সুবাস ঘুমিয়ে পড়ে চুপিচুপি নকশাদার বাক্সের কোণে। পাছে নিয়ত যাপন ভেসে যায় চেনা জীবনের পরিচিত ছক ভেঙে। তাই টন টন গ্লানির নীচে চাপা পড়ে থাকে সে। কথা বলে আধো ঘুমের আড়ালে, লেখে নতুন কত গল্প তার যাদু আয়নার ছবিতে। সেসব ছবিই ছড়িয়ে পড়ে সদ্য চৌকাঠে এসে পড়া নতুন আলোর নতমুখে। জীবনের আঁচে নিয়ত উত্তপ্ত তার উপস্থিতি। মন চাইলেই ছাইয়ের পড়ত সরিয়ে সরিয়ে দেখে নিতে হয় তাকে। পুড়তে পুড়তে সেই 'নিকষিত হেম'এর যাত্রা অন্তহীন অমরাবতীর পথে। সময় কিংবা ব্যক্তি মানুষ সেখানে ভেসে যায় খড়কুটো হয়ে।
   কেবল ভালোবাসার অভিধানের সবচেয়ে প্রবল যে শব্দ সেই অপেক্ষাটুকু রেখে যেতে পারি বিষাদ সিন্ধুর কোলে দাঁড়িয়ে, আকাশ ভরে যখন জাগে আলোর উৎসব..

Post a Comment

0 Comments