জ্বলদর্চি

আমি ও প্রেম/মোনালিসা পাহাড়ী

আমি ও প্রেম

মোনালিসা পাহাড়ী

ভালোবাসার দিন। প্রতি বছরের মতো এবছরও সাড়ম্বরে প্রতি মানুষের হৃদয়ের ঘরে পালিত হবে ভালোবাসার উৎসব। গত একবছর ধরে আমাদের ভালোবাসার পৃথিবী রোগাক্রান্ত, জর্জরিত। নিরন্তর অসম যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি কতো প্রাণের মানুষকে।আমরা চিরাচরিত ছকের বাইরে এসে জীবনটাকে নতুন করে চিনতে শিখেছি। আমরা বুঝেছি অর্থ যশ পতিপত্তি এ সবকিছুর থেকে ও মহামূল্যবান হলো এই নশ্বর 'জীবন'। পৃথিবীতে সুস্থ সবল ভাবে প্রিয়জনদের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাই হলো সবথেকে বড় চ‍্যালেঞ্জ।
মানুষ কখনোই একা একা শুধুমাত্র নিজের জন্য বেঁচে থাকতে পারেনা।কারণ সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে যে আনন্দ একা একা বাঁচার মধ্যে সে আনন্দ নেই এটা আমার নিজস্ব মতামত। এই পৃথিবীতে আমার হয়ে ভাববার কেউ নেই, অথবা আমার ভাবার মতো চারপাশে একটিও মানুষের অথবা অন্য কোনো প্রাণীর অভাব সে জীবন অর্থহীন। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের কাছে হয়তো প্রিয় মানুষটি নেই অথচ গরু ছাগল হাঁস মুরগী কুকুর বেড়াল এদের ওপর উপচে পড়ে অকৃত্রিম প্রেম।

   এবার বলি প্রেম বলতে আমি কি বুঝি? আমার কাছে প্রেম হলো ঈশ্বর দর্শনের নামান্তর। যদিও ঈশ্বরকে দেখা যায়না শুধু অনুভব করতে হয়, প্রেম ও তাই। অন্তরাত্মায় অনুভব করতে হয়।সেই প্রেম জীবাত্মা বা পরমাত্মার প্রতি হোক না কেন তার উপলব্ধি কিন্তু এক এবং অনির্বচনীয়। রবি ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলবো- "শুধু তোমার বানী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়/মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ খানি দিও..."  প্রাণে যা কিছু ছুঁয়ে যায় সেই তো প্রেম। যা মনকে প্রভাবিত করে, যা হৃদয়কে নাড়া দেয় তা-ই প্রেম। এই প্রেম যে কোনো বয়সে যে কোনো মানুষের প্রতি হতে পারে। অন্তরের নিবিড় আবেগ মিশিয়ে বিশ্বাসে ভর করে প্রেমের পথে পা বাড়ানোর মতো পূণ্য হয়তো আর কিছুতে নেই।

   এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা খুব সহজে প্রেমে পড়ে যান।কেউ কেউ আবার কিছুতেই প্রেমে পড়তে চান না। কোনোকিছুর দ্বারাই যেন তাঁদের হৃদয়কে স্পর্শ করা যায়না। মনের চারপাশে তাঁরা কেমন যেন অদৃশ্য গন্ডি কেটে রাখেন। যদিওবা কখনো প্রেমে পড়েন তা অনেক লাভ ক্ষতির হিসেব কষে, চাওয়া পাওয়ার খুঁটিনাটি যাচাই করে তবেই সে পথে পা বাড়ান।  এসব মানুষেরা জীবনে খুব সফল হন, তবে প্রেমে কতটা সফল তা বলতে পারবোনা। যাঁরা খুব সহজে প্রেমে পড়ে যান তাঁদেরকে কখনোই চরিত্রহীন আখ‍্যা দিতে আমি রাজি নই। বরং আমার মনে হয় অপেক্ষাকৃত নরম মনের মানুষরাই খুব সহজে প্রেমে পড়েন।অন‍্যকে ভালোবেসে তাঁরা শান্তি পান।ভালোবাসাতো একটা সাধনা। মন থেকে এ সাধনা না করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না।

   এবার আসি আমার জীবনে প্রেমকে আমি কিভাবে দেখছি তার কথায়। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমিও কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো মানুষ। এই হাফ জীবনে যে কতবার কত মানুষের প্রেমে পড়েছি তার কোনো ঠিক নেই।আমার জীবনের প্রথম প্রেম হলো শরৎচন্দ্রের 'দেবদাস' চরিত্রটি। ক্লাস নাইনে পরীক্ষা দেওয়ার পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে দেবদাস উপন্যাস ধার করে পড়েছিলাম। দুদিনের কথায় নিয়ে প্রায় এক পক্ষকাল বইটি পাশে রেখেছিলাম। তার ভেতরে যে কতবার বইটি পড়েছি তার হিসেব নেই।যতবার পড়েছি ততবারই লুকিয়ে কে‌ঁদেছি। দেবদাসের প্রতি এক অমোঘ টান তৈরী হয়ে গেছিল। সে টান এখনো আছে। এখনও কত ঘুম না আসা রাতে দেবদাস হৃদয়ে র ঘরে কড়া নাড়ে। তারপর তো একে একে কত প্রেম এসেছে। কখনো দত্তার নরেন তো কখনো রবিঠাকুরের গোরা। তবে এই প্রেমের ভেতর কোনো খাদ ছিলনা। ভালোলাগা ছিল অন্তর থেকে। বাস্তব জীবনে ও অনেক প্রেম এসেছে। তবে অধিকাংশই মনে মনে। অপরপক্ষ তার টের টুকুও পায়নি। আবার কখনো সখনো পেয়েছেও। ভালোলাগা তৈরী হাওয়ার পর ছিঁড়ে গেছে সুতো। অনেক বিরহ পেরিয়ে আবার নতুন প্রেম উঁকি দিয়েছে জানালায়। 

   তবে সব প্রেমের গল্প তো একদিনে বলে ফেলা যাবেনা।ক্রমশ প্রকাশ‍্য। শেষ করার আগে একটি ঘটনা দিয়েই শেষ করবো।

   তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বাড়ি থেকে প্রায় তিনঘন্টা বাসে যেতে হতো। একদিন বাসে যেতে যেতে পাশের সিটে এসে বসলো সমবয়সী এক তরুণ।ঝকঝকে চেহারা, স্মার্ট।আলাপ করলো যেচে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই কথা জমে উঠলো। কি ছিল না সে আলোচনায়! পড়াশোনা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবন যাপন রীতি সবই ছিল আলোচনায়। তার সঙ্গে আলোচনার বিষয় ছিল 'প্রেম'। একদম অচেনা একটা ছেলে এত সহজে বন্ধু হয়ে গেল, যার সঙ্গে এত কথা শেয়ার করলাম এই উপলব্ধি টুকু হাওয়ার আগেই সে নেমে গেছে নিজস্ব স্টেশনে। নাম না জানা ঐ ছেলেটা বেশ কিছু দিন আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছিল।কোথায় না কোথায় খুঁজেছি তাকে! যদি কখনো হুট করে সামনে চলে আসে... কিন্তু সে আসেনি। পরে বুঝেছি সেটাও ছিল একধরনের প্রেম।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments