জ্বলদর্চি

ভালোবাসার শিমূল পলাশ !/অনিন্দিতা শাসমল

ভালোবাসার শিমূল পলাশ !

অনিন্দিতা শাসমল

কয়েকদিন আগে ক্লাস এইটে পড়া আমার মেয়ে, বাগানে ফোটা একটি তাজা লাল গোলাপ তুলে আমার হাতে দিয়ে মজা করে বললো , মা এই নাও....আজ রোজ ডে ! মুচকি হেসে ওর গাল টিপে দিলাম। রোজ  ডে,প্রপোজ ডে,চকোলেট ডে,টেডি ডে,প্রমিস ডে.....এইসব হতে হতে অবশেষে নাকি ভালোবাসার দিন ! পয়লা ফাগুন ! মানে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি !  ভ‍্যালেন্টাইনস ডে ! সোস‍্যাল মিডিয়ায় দৌলতে আমাদের প্রজন্মের সকলে আজ জেনে গেছি এইসব বিশেষ দিনগুলোর নাম।কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি এতটাই অজ্ঞ ছিলাম এই বিষয়ে ,যে ১৯৯৭ সালে ইউনিভার্সিটিতে এম এসসি ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় , একদিন এক বন্ধুর মুখে ভ‍্যালেন্টাইস ডে শব্দটা  শুনে হাঁ করে তাকিয়ে, কিছু না বুঝেও বিজ্ঞের মতো ভাব করে হেসেছিলাম ; পাছে ধরা পড়ে যাই জানিনা বলে ! অথচ তখন অনেকেই, বিশেষ করে যারা বিদ‍্যাসাগর ইউনিভার্সিটির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে কাজুবাদাম গাছের তলায় যুগলে বসে গল্প করতো ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ,তাদের নিশ্চয়ই  এইসব ভালোবাসার দিনের নামগুলোর সঙ্গে পরিচিতি ঘটে গেছে। 

       অফ পিরিয়ডে বা ছুটির শেষে ইউনিভার্সিটির একপ্রান্তে অবস্থিত ক‍্যান্টিনের গরম চপ ,ঘুগনি খেয়ে , সামনের কাজুবাদাম গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে গান কবিতা আর আড্ডায় জুলজি ডিপার্টমেন্টের বেশ সুনাম ছিল। এই অভ‍্যেস অবশ‍্য শুরু হয়েছিল মেদিনীপুর কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে, সাজানো বাগানে বসে আড্ডা দেওয়া থেকেই। এতটাই জমে যেত সেই আড্ডা যে,কখন  পাশের সাবজেক্টের ক্লাসের সময় পেরিয়ে যেত ,সে খেয়ালও থাকতোনা মাঝে মধ‍্যে।বিশেষ করে ওমপ্রকাশ যখন তার মায়াজড়ানো গলায় ধরতো হেমন্তের সেই চিরদিনের গান -- "নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী
আর পৃথিবীর পরে এই নীলাকাশ ,
তুমি দেখেছো কি ?
আকাশ, আকাশ,ঘননীল নীলাকাশ......."
 ক্লাসের সময় পেরিয়ে গেলে মনে পড়তো , যখন স‍্যার বা ম‍্যাডামরা ক্লাস শেষ হলে সামনে দিয়ে যেতেন বা আমরা দোতলায় উঠে মুখোমুখি হতাম ! কলেজ ইউনিভার্সিটির জীবনে প্রায় প্রত‍্যেক দিনই ছিল আমাদের কাছে 
এমনই ভালোবাসার দিন ।
এতটাই বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ‍্যে ,যে কখনও আলাদা করে কেউ কাউকে ছেলে বা মেয়ে ভাবিনি। আমাদের কাছে বন্ধু শব্দের  কোনো লিঙ্গভেদ ছিলনা।

    গ্র‍্যাজুয়েশন শেষে  বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রাখলাম আমরা ; সমরেশ ,বিশু কল‍্যাণীতে ভর্তি হল। আমি  কল‍্যাণীতে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হতে গিয়েও, ফিরে এলাম মেদিনীপুরের বিদ‍্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোনো বন্ধুদের আকর্ষণে। সীমিত আসনের জন‍্যে যে কজন বন্ধু এম এসসি তে ভর্তি হতে পারলোনা , তাদের জন‍্য খুব মন খারাপ নিয়ে কয়েকদিন ক্লাস করছি।এমন সময় হঠাৎ একদিন , দুপুর নাগাদ ডিপার্টমেন্টের প্রধান শ্রদ্ধেয় তন্ময়বাবু আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বললেন, একটা সিট খালি হয়েছে । আজ দুপুরের মধ‍্যেই খবর দিতে পারবে তোমাদের কোনো বন্ধুকে ? ওকে আজকেই এসে ভর্তি হতে হবে।।  মোবাইল দূরে থাক,তখনও ঘরে ঘরে ল‍্যাণ্ডফোনটাও আসেনি। অগত্যা সঙ্গে সঙ্গে বাস ধরে আমরা কয়েকজন, আমাদের কাছে  একেবারে অচেনা প্রায় পঁচিশ কিমি দূরের গ্রামে খোঁজ করে পৌঁছে গেলাম এক বন্ধুর বাড়ি।ওকে নিয়ে দুপুরের ট্রেনে সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে ইউনিভার্সিটি পৌঁছালাম ; ও ভর্তি হল ! সে কী আনন্দ আমাদের ! সেই দিনটাকেই মনে হয়েছিল আমাদের ভালোবাসার দিন ! 

       প্রবল জ্বর নিয়ে মেসে শুয়ে থাকার সময়, রুমমেট ও বন্ধু শোভনা যখন মায়ের মতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে,মনে হয়েছিল -- এই তো ভালোবাসা ! মেয়েদের মেসের সামনে দাঁড়িয়ে ,ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা এমনকি পড়ার নোটস আদান প্রদান করাও বারণ ছিল প্রধানশিক্ষক , মেসের কাকুর। সেই কড়া শাসনকে তোয়াক্কা না করে  আমাদের প্রিয় ও বন্ধুবৎসল কাকীমার পাহারায় , নোটস বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে রণদেব, সুনীল , দিলীপ,মনিদা। পার্ট টু পরীক্ষার সময় মেস ছেড়ে দিয়ে হন‍্যে হয়ে রুমভাড়া খুঁজছি যখন, ওমপ্রকাশ তার মেসের কাছাকাছি বাড়িভাড়া খুঁজে দিয়ে,ওদের মেসের রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়েছে বেশ কিছুদিন, একসাথে একরুমে সুখ- দুঃখের সঙ্গী হয়ে থাকা আমার ও শ্রাবণীর জন‍্য।মনে হয়েছিল , এর চেয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কি হতে পারে ? পরীক্ষার হলে আনকমন প্রশ্ন দেখে,নার্ভাস হয়ে কিছুতেই উত্তর মনে করতে না পারা অসহায় আমার পাশে বসা সোমা, যখন সাহস দিয়ে ফিসফিসিয়ে  বলেছিল -- যেটা পারছিসনা ছেড়ে দিয়ে পরেরটা শুরু কর,ঘাবড়াসনা ---পরীক্ষার হলটাকে সেই মুহূর্তে বড় আপন মনে হয়েছিল। প্র‍্যাকটিক‍্যাল পরীক্ষায় একজন নার্ভাস হয়ে গেলে,নিজেরটা শেষ করে স‍্যারকে লুকিয়ে যখন বন্ধুরা সাহায্য করেছি একে অপরকে,তখন মনে হয়েছে ,কোথায় হিংসা ? কোথায় দ্বেষ ? এ পৃথিবী তো  ভালোবাসার আ়ঁতুড়ঘর ! 
আমার বিয়ের দিন প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করেও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বন্ধুরা জলকাদা মাখা রাস্তা পেরিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিল ; সেদিনটা ওদের ভালোবাসাতেই পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলাম আমি ও আমার বাবা-মা।
বিয়ের পর নবদম্পতির জন‍্যে মেদিনীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্রনগরে দুকামরা-রান্নাঘর-বারান্দা-উঠোন-কুয়োপাড়ে অনেকটা খোলা জায়গাসহ সুন্দর ভাড়াবাড়ির ব‍্যবস্থা করে রেখেছিল বন্ধু দেবীপ্রসাদ ,যাতে ওখান থেকে চাকরীক্ষেত্র শালবনীর বাস ধরতে সুবিধে হয়। সেই বাড়িতে কত আড্ডা দিয়েছি সবাই মিলে ! যে কোনো অসুবিধে হলে একবার বলার অপেক্ষা ! 

     এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমাদের প্রথম সংসার পাতা সেই ভাড়াবাড়ির মালিক,মেদিনীপুর হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত মেট্রন ও পদস্থ সরকারি কর্মচারী দম্পতি, মাসিমা- মেশোমশাইয়ের কথা ।এত স্নেহ আর ভালোবাসা দিয়ে আমাদের আগলে রেখেছিলেন ওনারা ... সেই ঋণ কোনোদিন শোধ করার নয় ! প্রতিদিন সান্ধ‍্যভ্রমণ শেষে  আমাদের কাছে চা খেয়ে , সমস্ত সুবিধে-অসুবিধের খোঁজ খবর নিয়ে  ও সুপরামর্শ দিয়ে দোতলায় উঠতেন মেশোমশাই। পরবর্তীতে চারমাসের সন্তানকে আয়ার রেখে  যখন স্কুলে চলে যেতাম, প্রত‍্যেক দিন খাওয়ানোর সময় হার্টের পেশেন্ট মাসিমা নিচে নেমে বসে থাকতেন।মাসিমা আর নেই এই পৃথিবীতে, কিন্তু মেসোমশাই আজও কখনও স্টেশন থেকে নেমে আমাদের বর্তমান স্থায়ী ঠিকানাযুক্ত বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেই , বাড়িতে ঢুকে ঠিক কুড়ি বছর আগের মতোই সহজভাবে আমাকে বলেন চা খাওয়াতে। আজ মনে পড়ছে সেই আয়া,আমাদের প্রিয় শিবাণীদির কথাও । প্রায় তেরো বছর ধরে আমার দুই সন্তানকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে প্রতিদিন,আমি স্কুলে থাকার অনেকটা সময় ধরে। আমার অনুপস্থিতি ওদের বুঝতে দেয়নি কখনও।

       রক্তের সম্পর্কহীন এই টুকরো টুকরো ভালোবাসাগুলো জীবনের সঞ্চয় হয়ে আছে। আজ ভালবাসার দিনে সেই মানুষগুলোর জন‍্যেই আমার হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসার শিমুল পলাশ পাঠিয়ে দিলাম ....
প্রত‍্যেকের সাংসারিক ব‍্যস্ততায় একসময়  বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমতে থাকে । বেশ কয়েক বছর হল, সোস‍্যাল মিডিয়ায় মাধ‍্যমে আবার  সব বন্ধুদের  খুঁজে পেয়েছি । ডিসেম্বরের শেষে শীতের আমেজ মেখে , বছরে একটা দিন আমরা ছেলেমেয়ে সহ পিকনিক করি আর ঐ দিনটাকেই মনে হয় ভালোবাসার দিন !
কত  স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে ; সবাই মিলে গেয়ে উঠি --- 
"পুরানো সেই দিনের কথা ,ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই   চোখের দেখা,প্রাণের কথা, 
সে কি ভোলা যায়।
আয়  আর-একটিবার আয় রে সখা,প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা   সুখের দুঃখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায় ।"

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. ভীষণ ভালো লাগলো। আসলে পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে বলেই মানবিক সম্পর্কগুলো এখনও টিকে আছে। ( গৌতম বাড়ই)

    ReplyDelete