জ্বলদর্চি

এ ব্যথা কি যে ব্যথা/মধুমিতা বেতাল

এ ব্যথা কি যে ব্যথা

মধুমিতা বেতাল

"একে তো ফাগুন মাস দারুন এ সময়"
মাঝে মাঝেই হেমন্তবাবু আজকাল খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, সব ব্যথা সারানোর ওষুধ আছে, এ-ব্যথা সারানোর কোনো ওষুধ নেই। ফাল্গুন মাস পড়তে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। ট্রেনে চড়েছি তিন ঘন্টার জার্নি, মহিলা কামরাতে চড়তে পারিনি। দৌড়াতে দৌড়াতে সাধারণ কামরাতেই উঠেছি, কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি এ প্রসঙ্গ থাক। কামরাতে খুব বেশি লোকজন নেই, এখান-ওখান করে কুড়ি বাইশ জন বসে আছেন। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল, আমি খানিকটা ভিজেও গিয়েছি। টাইমটা হবে বিকেল পাঁচটা। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে জানালার কাছে একটা ফাঁকা সিটে বসতে যাব এমন সময় একজন বললেন-- দাঁড়ান দাঁড়ান, ম্যাডাম কোথায় বসছেন ? একটু দেখে বসুন বলেই পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সিটটা মুছে দিলেন। সিটটা একদম বৃষ্টির জলে ভেজা ছিল, আমি নিজের ভেজা শরীর মুছতে গিয়ে ভেজা সিটের দিকে একদমই লক্ষ করিনি। ধন্যবাদ দাদা। না না একদম ধন্যবাদ দেবেন না। আর ওই দাদা, এই দুটোতেই আমার এক্কেবারে হাড় এলার্জী আছে। বন্ধু, আমার নাম শুভঙ্কর, তুমি আমাকে শুভ বলতে পারো। আর তুমি, তুমি দিয়েই কথা বলো। আমি তো অবাক, আমার থেকে খুব বেশি না হলেও দশ বছরের বড়ো তো হবেনই তার ওপর এক মিনিটও হয়নি প্রথম সাক্ষাৎ। তাতেই এত্ত...! মনে মনে ভাবলাম যাকগ্গে, কথা না বললেই হলো। বসে পড়লাম সিটে। উনি মুখোমুখি সিটে বসে আছেন। বসেই আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে অর্ধেক দেখা মুভি "হঠাৎ দেখা" দেখতে শুরু করলাম। আরে আরে এটা তুমি কি করছো, বাইরের দৃশ্য দেখো। মোবাইল এখন রাখো, ওটা যখন বাড়িতে একা থাকবে তখন দেখো। এখন দেখো ফাঁকা বিস্তৃর্ণ মাঠ, দূরে বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ের চূড়া, তার গায়ে গায়ে ঝুপ ঝাপ বসে আছে সবুজ। আমি বোকার মতো ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে, আর উনি বলে যাচ্ছেন...।

   তারপর জানালার বাইরে দেখলাম, বৃষ্টি তখন থেমে গেছে, সূর্যের লাল তখনও হালকা হয়ে আছে । সত্যিই কি মনোরম দৃশ্য ! মন জুড়িয়ে গেলো। আমি মনে মনে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানালাম, খুব ভালো লাগছিলো দেখতে। কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছিলাম আনমনে, হটাৎ ওনার একটা কথাতে ফিরলাম। “তোমার ভেজা কোল ছুঁয়ে বিশ্রাম নিতে চাই / শ্বাস নিতে চাই চোখ বুজে।’’ না আমাকে না, কবিতার লাইন। আমি জানতে চাইলাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন? উনি খুব নর্মালভাবেই উত্তর দিলেন, কোথাও না তো। তবে ট্রেনে কেন? স্টেশনে বসেছিলাম একা একা, ট্রেন আসতেই মনটা কেমন উড়ু উড়ু করে উঠলো। তাই উঠে পড়লাম, দেখি কত দূর মন উড়তে চায়। আবার অবাক হলাম, দেখে তো ভবঘুরে বলে মনে হচ্ছে না। পোশাকে আশাকে বেশ ভদ্রলোক বলেই মনে হলো। আমাকে জানতে চাইলেন না, আমি কোথায় যাব। ভাবলাম এই বুঝি প্রশ্ন করবেন,  কিন্তু না, করলেন না। ভালোই হলো, আমিও বলতে চাই না। লেবু কিনলেন হকারের কাছ থেকে, লেবু ছাড়িয়ে আমার পাশের সিটে বসে বললেন-- নাও। এমন আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলাম না, নিলাম। কত কথা, কত কবিতা, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুনীল, শঙ্খ আরোও অনেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কত চেনা হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে রবিঠাকুরের মিতার পাশে বসে আছি। আমি বললাম আপনি তো আমাকে চেনেন না, তাহলে কীভাবে এতো...? উনি বললেন তোমার নাম বলো । বললাম শ্রীময়ী। উনি উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন-- হাই শ্রী আমি শুভ, আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। এবার চেনা হয়েছে তো? বলেই আবার নিজের জায়গাতে বসে গেলেন। সুন্দর সু-পুরুষের হালকা স্পর্শে এই প্রথম শিহরণ অনুভব করলাম। সরে বসুন বলতে ইচ্ছে করছে না! উনি যখন বললেন "এতদিন কোথায় ছিলেন?, / পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।" মনে হলো প্রশ্নটা আমার জন্যই। কেন জানি না তখন আমি যেন ইচ্ছে করেই আরও কাছে সরে গেলাম। জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া ঢুকছে, চুল এলিয়ে পড়ছে তার দিকেই। এখনও বেশ ঠান্ডা আছে, চাদারটা ভালো করে জড়িয়ে ধরতে দেখে উনি জানালাটা বন্ধ করতে চাইলেন। আমি বাধা দিলাম, বললাম-- থাক না ভালো লাগছে। আর বাইরের কোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার নেমে আসছে। মনে হচ্ছে ক্যানভাসে কেউ কালো রঙ ঢেলে দিচ্ছে।
 
   বেশ লাগছে ওনার কথা শুনতে, এর আগে এভাবে কেউ আমার সাথে এত কথা বলেনি। ক্রমেই কামরা খালি হয়ে আসছে,  কী আশ্চর্য খালি কামরাতেও একজন অচেনা পুরুষের এতো কাছে বসে আছি, একটু ভয়ও করছে না। বরং মনে হচ্ছে আমি খুব নিরাপদেই আছি, খুব আপনজনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।  আমার আরও বেশ খানিকক্ষণ সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে ওনার সাথে। কিন্তু ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে কমে এসেছে, বোধ হয় আমার গন্তব্য এসে গেছে। উঠে দাঁড়ালাম, নামতেই হবে। উনি আমার ব্যগটা হাতে ধরিয়ে দিলেন, কিন্তু উঠলেন না শুধু স্নিগ্ধ চোখে বিদায়ের হাসি হাসলেন, কিছু বললেনও না। জানালা দিয়ে দেখলাম স্টেশনের বড়ো লাইটার নিচে আমার স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন।   খুব ইচ্ছে করছে ফোন নম্বরটা চাইতে। কি করে যে চাই, উনি তো কিছুই বলছেন না। তারপর বললাম-- শুভ আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না, একবার আমার নম্বরে একটা কল করবে? হ্যাঁ এক্ষুনি, তোমার নম্বর টা বলো।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments