জ্বলদর্চি

স্মৃতিতে সুকান্ত-সৃজিতা / ভবেশ মাহাত

স্মৃতিতে সুকান্ত-সৃজিতা

ভবেশ মাহাত 
 
সুকান্ত র সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দু'বছর ধরে। সৃজিতার সাথে কয়েক মাস কম, তবে সে সম্পর্ক স্মৃতির পাতাতে আজও মধুর হয়ে আছে। সুকান্ত অন্য অনেকের তুলনায় কেন এত ভীতু প্রকৃতির তা জানতে আমাদের সারা ক্লাসের প্রায় চার মাস লেগেছিল। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কৌতুহল মেটানোর গবেষণা চলছিল অনেকদিন ধরেই। শেষ পর্যন্ত বুঝেছিলাম সৃজিতার মেধার কাছে সুকান্ত নিজেকে কোনও দিন সাহসী ভাবার সাহস দেখায়নি। তবে হ্যাঁ, সুকান্ত একসময় নিজেকে বদলেছিল ক্লাসের সেরা সাহসী ছাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পেরেছিল তা সেই সৃজিতার জন্য। এক্ষেত্রে বাপুজি-র সেই বিখ্যাত থিওরি - গরীব না খেতে পাওয়া অর্ধনগ্ন মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে গেলে তাদের মত হতে হবে। অর্থাৎ সৃজিতা কে ভালোবাসার পাগলি বানাতে গেলে সাহসী হতে হবে সুকান্তকে, সেই সঙ্গে বুদ্ধিমানও।

            ১৪ ই ফেব্রুয়ারী মানে প্রেমিক প্রেমিকার দিন। ঐ দিনটাতে ভালোবাসার মানুষকে কিছু না দিতে পারলে, বৃথা এ জীবন। আমাদের মধ্যে যারা প্রেমের ঘোর বিরোধী ছিল, মানে যারা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভালোবাসার উপর বিশ্বাস হারিয়েছিল তাদের কাছে এই দিনটার ব্যাখ্যা আবার ভিন্ন। তারা ভাবতো কিছু পাওয়ার দিন এই দিনটা। যাই হোক, যত মত তত পথ। তবে আজ আর বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দ্বারা পরিকল্পিত নানান অপকর্মের সঙ্গী হিসেবে সুকান্তকে আমরা পেয়েছি। আসলে তাছাড়া যে আমাদের আর কোনো উপায়ও ছিলনা। রাতের বেলা অন্যের বাগানের নারকেল গাছে উঠতে গেলে তো সাহস এবং বুদ্ধি দুই-ই লাগে, আমাদের মধ্যে সুকান্ত ছাড়া এই দুই য়ের মেলবন্ধন আর কারোর ছিল না। আবার উল্টোদিকে তাকেও অনেক সাহায্য করেছি আমরা, বিশেষ করে যে ক'জন হোস্টেলে থাকতাম। এই যেমন ধরুন প্রেমপত্র লেখার জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে খাটের নিচে ঢুকে মশার প্রাণ হত্যা বা পত্র বাহকের ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি।  আমাদেরও তো কষ্ট হতো যখন দেখতাম সৃজিতার হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলার দাগ, তাই আর চাইতাম না সুকান্তও সেই পথেই হাঁটুক। 
   দুজনের প্রেমপত্র দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটাও হতো বিচিত্র ঢঙে। গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালে ছাতার হাতলে মধ্যে ঢুকিয়ে প্যাঁচ আটকে দিত, ছাতাগুলো শ্রেণিকক্ষের পিছনের দিকে শুকনো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো। দুজনে গিয়ে একজন অপর জনের ছাতার হাতলের প্যাঁচ খুলে চিঠি বের করে নিত। বাকি দিনগুলোতে বই বা খাতার ভিতরে পত্রটি সযত্নে তিন-চারটি খামের মধ্যে মোড়া থাকত। এভাবেই দুজনের প্রেম গাঢ় হতে থাকে। এবার আমাদের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল, ভালোবাসার দিনে সুকান্ত তার সৃজিতাকে কিছু উপহার দিতে চাই। আমাদের থেকে প্রস্তাব দেওয়া হল - একটি ইঁটের টুকরো সুন্দর ভাবে প্যাক করে বান্ধবীকে দাও। প্রথমটায় সুকান্ত ভীষণ রকম রেগে যায়, কিন্তু আমরা বোঝাতে চেয়েছিলাম উপহার পয়সা দিয়ে কিনতে হয়- একথা সত্য, কিন্তু সেটা যখন কারোর খুব কাছের মানুষ দেয় তখন তার গুরুত্ব সম্পূর্ণ আলাদা, তখন তার মূল্য নিয়ে প্রশ্ন আসেনা, আসা উচিত নয়। সুতরাং সুকান্ত অতঃপর সম্মত হইল।

   এতদিনে সুকান্ত নিজেকে যথেষ্ট সাহসী বানিয়ে ফেলেছে, সঙ্গে অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছে অনেক। তাই উপহারটা সে নিজেই দিয়েছিল সৃজিতাকে। সেদিন হয়তো সৃজিতাকে উপহারটা দিতে বলে উপঢৌকন দেওয়ার প্রলোভন দেখালেও আমরা সম্মত হতাম না। কারণ ইঁটের টুকরো গিফট! ভাবাই যায় না। 

   এই ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যেদিন সব বন্ধুরা মিলে দুজনের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম, দেখে আশ্চর্য হলাম, সেই প্যাকেট, যার বহিরাংশের আভরণ আমাদের দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, তা সেদিনও ছিল তেমনই অমলিন এবং অক্ষত। সেদিন বুঝলাম উপহার তো উপহার-ই হয়, সেটা যত তুচ্ছই হোক, তার মূল্য দিতে জানতে হয়। সৃজিতাকে সেদিন বুদ্ধিমতী এবং দায়িত্ববতী দুই-ই মনে হয়েছিল।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments