জ্বলদর্চি

গাধা ছোলা খেতে ভালোবাসে/কৌশিক গুড়িয়া

গাধা ছোলা খেতে ভালোবাসে

কৌশিক গুড়িয়া  

অনেকদিন আগে শোনা একটি গল্প মনে পড়ে গেল। তখন প্রেমের কুঁড়ি ধরেছিল সবে। প্রায় দ্বিগুন-বয়সী এক দাদা, যাঁর সঙ্গে চটুলতার সম্পর্ক ছিল; তিনিই বলেছিলেন গল্পটা। গল্পে এক স্বামী-স্ত্রী তাঁদের সন্তানকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দু’টি গাধা দেখতে পান। শিশুমনের সারল্য জানতে চায়, বাঘ-সিংহ-হাতি’রা আলাদা আলাদা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গাধা দু’টো এক সঙ্গে কেন!  বাবা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, ওরা আসলে বর আর বউ। শিশু বলে, গাধারাও বিয়ে করে? বাবার তির্যক উত্তর ছিল, হ্যাঁ। গাধারাই বিয়ে করে... 
  ওই ছোট্ট পরিবারের তিক্ততা কিংবা তির্যকতার প্রসঙ্গ আমার জানার কথা নয়। তবে জানা আছে, প্রেমের তুমি প্রেমের আমি যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে তির্যকতাও। কোনও এক দিকে পাল্লা ভারী হলে সে প্রেম অচিরেই বেশ জোলো হয়ে উঠবে ।   
তাই আমার কাছে প্রেম-বিচারী সব থেকে প্রিয় পঙক্তি হলো, ‘তিনটি শালিক ঝগড়া করে / রান্না ঘরের চালে’। হ্যাঁ, সহজ পাঠ। তারই প্রথম ভাগে আছে ‘গাধা ছোলা খেতে ভালোবাসে’। অষ্টম পাঠের গদ্যে কর্তা বলছেন ‘ওকে কিছু ছোলা খেতে দাও’। এই অংশে প্রতিভাত হয়, প্রেম কেবল নারী ও পুরুষের মধ্যে ঘটমান ফ্রয়েড বা প্লেটো-গন্ধী সম্পর্ক নয়। পশুপ্রেম কিংবা প্রকৃতি প্রেমেও মনের উচাটন থেকে যায়। যেমন থেকে যায় মানুষ ভেদে, মন ভেদে প্রেমের সংজ্ঞায় নব নব শব্দ-সমাহার।

  সে ভিন্নতায় রবি ঠাকুরের সহজ পাঠ আমার কাছে প্রত্যন্ত এক প্রেম-পুস্তক। আর নন্দলালের ছোটো ছোটো (অথচ  সুতীব্র) অলংকরণ সে প্রেমে গোলাপের অজস্র দলমন্ডল। যে সহজ পাঠের সূচনা হয়, ‘ছোটো খোকা বলে অ আ, / শেখেনি সে কথা কওয়া, এই পঙক্তি দিয়ে। একবার ভাবুন, যে শিশুর মুখে এখনও কথা ফুটে ওঠেনি, সেই না ফোটা নির্মাণের মধ্যেও কি বাবা-মায়ের চূড়ান্ততম প্রণয় লেগে নেই? সেই বাঙালি বাবা-মাই’ই তো কিছুকাল পূর্বে প্রেমের আমি, প্রেমের তুমি নামক স্বপ্ন-কাব্যের সুতো বুনছিলেন... 
এভাবেই, হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ মহানন্দে ক্ষীর খেতে বসে। জীব-মনোবিজ্ঞান বলে খাদ্যগ্রহণ আসলে এক তুমুলতম আনন্দ-প্রদায়ী ঘটনা। আমরা অনেকেই জানি হয়তো, প্রেমও তেমন ঘটনার সমরেখ। হয়তো তাই, ‘বড়ো বউ’কে ভাতের জন্যে ডাক পড়ে অথবা নৈসর্গিক আনন্দধারায় ‘জেলে-ডিঙি চলে বেয়ে’। প্রথম ভাগের প্রথম পাঠে দেখুন,  ‘বনে কত মাছি ওড়ে। / ওরা সব মৌ-মাছি। / ঐখানে মৌ-চাক। / তাতে আছে মধু ভরা’ (কিংবা প্রায় সমতুল্য, ‘কলসি  ভরা এখো গুড়ে / মাছি যত বেড়ায় উড়ে’)। আমরা হয়তো বুঝি, একটি মৌচাকের প্রায়-সমুহ পতঙ্গই পুরুষ। স্ত্রী তথা রানীকে সন্তুষ্টির কিনারায় নিয়ে যেতেই অক্লান্ত শ্রম তাদের! আমরা কি ভেবে দেখেছি, এমন এক মিষ্টি প্রেমকথা উপহার দেয় আমাদের সহজ পাঠ। কিংবা ‘বনে বনে পাখি জাগে, / মেঘে মেঘে রঙ লাগে। / জলে জলে ঢেউ ওঠে, ডালে ডালে ফুল ফোটে’। এমন চিরানন্দের ভাব সম্প্রসারণ, পাঠক আপনার চিত্যে পুলক-রেখা জাগাবেই। চতুর্থ পাঠে দেখবেন, ‘বক মিটিমিটি চায় আর মাছ ধরে’। তুরীয় কোনও নেশাতুরের নয়ন-মুদ্রায় কি এমন ছাপ লেগে থাকে না? আসলে  এও এক প্রণয়-বিভাব, যেমন করে ‘দীনু এই পাখি পোষে’ বা ‘বড়বউ মেজবউ মিলে / ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে’। যদি কেউ এমন হন, যিঁনি দর্শন-অনুশীলনকেই প্রেম বলে মানতে চান তবে তাঁর   জন্যে, ‘কাল। ছিল। ডাল। খালি / আজ। ফুলে। যায়। ভরে’, --- এর চেয়ে উচ্চাঙ্গ উদ্ধৃতি আর হতেই পারে না। 

   দ্বিতীয় ভাগের প্রথম পাঠেই ‘সংসার-বাবু’ নামে এক চরিত্র আছেন। সে চরিত্র রবীন্দ্রনাথের কল্পিত। সেই সংসার-বাবুর বাসায় ‘কংস-বধের অভিনয় হবে’। শিশুমনে এমন সব শব্দবন্ধের আক্ষরিক অর্থগুলোই ছবি তৈরি করে, কিন্তু সংসার যে আসলে কংস-বধ শুধু নয়, সে এক চিরকালীন অভিনয়-স্থল; প্রেম পাগলরাও সে সত্যে পোঁছাবেন একদিন! তেমন অভিনয় নামক আশ্রয়-স্থানকেই শৈশব মননে জায়গা করে করে দেওয়া হয়েছে যেখানে শিশু তার মা’কে বলতে শেখে, ‘দিনরাত্তির কোমর বেঁধে / থাকব পাহারাতে’। এবং শেষ পর্যন্ত ‘কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে / হাত থেকে ধান খাবে’। ... 

  দ্বিতীয় ভাগের দ্বাদশ পাঠ এক অদ্ভুত উপাখ্যান। ডাক্তার বিশ্বম্ভর বাবু সপ্তগ্রামে রোগী দেখতে চলেছেন। রাস্তায় মাঝরাত্তিরে পালকির সামনে এলো একদল ডাকাত। অবশ্য ভৃত্য শম্ভু তিন ডাকাতকে ঘায়েল ও আহত করেছিল। পরে দেখা যায়, আক্রান্ত বিশ্বম্ভর বাবুই ডাকাতদের চিকিৎসা করতে উদ্যত হচ্ছেন! এই গদ্যের শিশু-শিক্ষা হল অসুস্থ-আহতর প্রতি প্রেম। নিজ  পেশায় প্রতি সুবিচার করাও তো প্রেম। এমন প্রেম বিপুল নয়, ভিন্নতাই রূপ তার। ত্রয়োদশ পাঠও সমমানের, সেখানে এক দলিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তি অত্যাচারিত হন। তবে যিঁনি বা যাঁরা এমন অত্যাচারের কারিগর তাঁদের এক আত্মীয়াই ওই দলিত ব্যাক্তিকে মুক্তি ও উপাচারে ভরিয়ে দেন।  এ বার্তা শিশু কিংবা পরিনত মানুষের মনে সমাজ প্রেমের দানা বুনে দেয়। এ বার্তা কেবল তুমি-আমির আত্মকেন্দ্রিকতা নয়, তা আসলে মহান এক হৃদয়-শুশ্রূষা। এভাবেই সহজ পাঠ প্রেমের ধার প্রমাণ করে। ফিরিয়ে আনে আমাদের অনেকেরই নিষ্পাপ এক স্মৃতি-সমগ্র। 
এমন প্রেম খুব সহজলভ্য হয়তো নয়, তবে তার প্রাপ্যতার নিয়ামক তো আমরাই! তাই প্রথম ভাগের শেষ পাতায় শুরু হওয়া কবিতা ‘কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাবো কবে,...’ শেষ হচ্ছে অমোঘ এক সত্য-সাধনায়।
  
  ‘কখনো হবে না সে কি ভাবি যাহা মনে’।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments