জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা- ১৮/ শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-১৮

শুভদীপ বসু

বিষয়-ছন্দ(তৃতীয় পর্ব)

বাংলা ছন্দের রীতি অক্ষরের উচ্চারণের বিশিষ্টতা এবং মাত্রা গণনা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।ছন্দের ধ্বনি প্রকৃতি মাত্রা বিন্যাস এর যে রীতি তার উপর নির্ভর করে আবৃত্তির উপর কোন কবিতার নামকরণ করা হয় না। নামকরণ হওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় শব্দের উচ্চারণের ধ্বনির যে মাত্রা নির্ণয় পদ্ধতি তার উপর।

  বাংলা কবিতায় দলের উচ্চারণের জন্য ছন্দের রীতির  ভেদ ঘটে থাকে। যেমন মুক্ত দল সবসময় একমাত্রার হয়ে থাকে কিন্তু রুদ্ধদল কোথাও একমাত্র কোথাও দু'মাত্রা হয়।সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে রুদ্ধদলের এইযে সংকোচন-প্রসারণ তার ওপর ভিত্তি করেই বাংলা ছন্দ কে ভাগ করা হয়েছে মূলত তিনটি শ্রেণীতে---
ক)দলবৃত্ত ছন্দ
খ)সরল কলাবৃত্ত ছন্দ
গ)মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দ
ক)দলবৃত্ত ছন্দ -চারমাত্রার পূর্ণ পর্ব,পর্বের আদি অক্ষর শ্বাসাঘাত, লয় দ্রুত,অপূর্ণ পদ এক অথবা দুই মাত্রার,পর্ব যতি সমন্বিত যে সুপ্রাচীন লৌকিক ছন্দ তাকে বলে দলবৃত্ত ছন্দ। এই ছন্দকে স্বরবৃত্ত ছন্দ,শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ,ছড়ার ছন্দ ও বলা হয়‌।
বৈশিষ্ট্য:
১)স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর প্রতি পর্বে আদি অক্ষরে প্রবল ঝোঁক বা জোর।এই ঝোঁক অন্য রীতির ছন্দের দেখা যায় না। অবশ্য ঝোঁক সব সময় কবিতার মধ্যেই থাকে তবে তাকে শ্বাসাঘাত বলা যায় না।সাধারণত ছড়া জাতীয় ছন্দের কবিতার ক্ষেত্রেই এই শ্বাসাঘাত এর ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়।
কে মেরেছে/কে ধরেছে/কে দিয়েছে/গাল।।তাইতো খুকু/রাগ করেছে/ভাত খায়নি/কাল।।(প্রতি পর্বে প্রথমে ঝোঁক পড়েছে।)
২)স্বরবৃত্ত ছন্দের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পড়তে হবে তাড়াতাড়ি অর্থাৎ লয় দ্রুত।
৩)যেহেতু প্রতিটি পর্বে শ্বাসাঘাত পড়ে তাই পর্বগুলি ছোট হয়ে যায় এবং উচ্চারণ করার সময় বাগযন্ত্রের ক্ষিপ্রতা আসে ও লয় দ্রুত হয়ে যায়।
৪) রুদ্ধ ও মুক্ত দল সবক্ষেত্রেই প্রতিটি দল একমাত্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
৫) স্বরবৃত্ত ছন্দে পূর্ণ পর্ব ৪ মাত্রার হয়। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একটি নতুন ধরনের জয়যাত্রার দলবৃত্ত ছন্দ তৈরি করেন।
খ)সরল কলাবৃত্ত ছন্দ-যে ছন্দের লয় মধ্যম বা বিলম্বিত, প্রধান পর্ব চার, পাঁচ, ছয়, সাত মাত্রার, মুক্তদল একমাত্র এবং রুদ্ধদল দুই মাত্রা এবং ধ্বনি ঝংকার সমন্বিত থাকে তাঁকে সরলকলাবৃত্ত ছন্দ বা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বলে।
দুলিতেছে তরী/ফুলিতেছে জল/ ভুলিতেছে মাঝি/পথ ।।৬+৬+৬+২
ছিড়িয়াছে পাল/কে ধরিবে হাল/ আছে কার হিম/মৎ।।৬+৬+৬+২
বৈশিষ্ট্য:
১) মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর লয় মধ্যম।
২) এই ছন্দে লাইনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধ্বনি ঝংকার শোনা যায়।
৩) এই ছন্দের মাত্রা গণনারীতি সরল মুক্ত অক্ষর একমাত্রা রুদ্ধঅক্ষর দু'মাত্রা।
৪) এই ছন্দের শোষণ শক্তি নেই।
৫) এতে অতিপর্ব লক্ষ্য করা যায়।

গ) মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দ-যে ছন্দের পূর্ণপর্ব বা মূল পর্ব 8-10 মাত্রার হয়,চরণে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দ ধ্বনির অতিরিক্ত এক ধরনের একটানা সুর বা তান যুক্ত,ধীরলয় আশ্রিত,শোষণ শক্তি সমন্বিত, একক ও শব্দের মধ্যে অবস্থিত রুদ্ধদল দুই মাত্রার হয়,তাকে অক্ষরবৃত্ত বা তান প্রধান ছন্দ বা মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দ পয়ার জাতীয় ছন্দ বলে।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
বৈশিষ্ট্য:
১)প্রতিটা চরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা সুর বাতান থাকে।
২) অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর লয় ধীর হয়।
৩) মাত্রা গণনারীতি এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য-মুক্ত অক্ষর এক মাত্রা, শব্দের আদি বা মধ্যস্থিত রুদ্ধ অক্ষর একমাত্রা, শব্দের অন্তে ও শেষে রুদ্ধ অক্ষর দুই মাত্রা,একক রুদ্ধ অক্ষর দুই মাত্রা।
৪) শোষণ শক্তি এই ছন্দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আধুনিককালে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কে কেন্দ্র করে অমিত্রাক্ষর ছন্দ, মুক্তক ছন্দ,গদ্য কবিতার ছন্দ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই ছন্দকে বাংলা সনাতন কাব্য ছন্দ বলা হয়ে থাকে।
পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments