ভোটের খেলা
রোশেনারা খান
২০২১ এর বিধানসভা ভোট আসেই গেল। এতদিন শুনতাম ‘ভোট যুদ্ধ’, এবার শুনছি ‘ভোট খেলা’। যুদ্ধ বা খেলা যাই হোক না কেন, এবারের ভোট নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের মনে নানারকম ভয়, দুশ্চিন্তা বাসা বেঁধেছে। আর এক শ্রেণির মানুষ ভাল ও নতুন কিছুর আশায় মনে মনে খুবই উত্তেজিত। কিছু মানুষ মনে করছেন এরা সবাই সমান, মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। তাই তাঁরা আশার ছলনে ভুলতে নারাজ। তাঁরা যাচাই করার চেষ্টা করছেন, কোন দল কতটা খারাপ বা ভালো।
কিছু মানুষের কাউকেই পছন্দ নয় বলে ভোট দেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবার তেমনটি হওয়ার উপায় নেই। ভোট না দিলে নাকি নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে যেতে পারে! ভোট পাওয়ার জন্য যে দলের হাতে ক্ষমতা রয়েছে তারা অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন। সেইসঙ্গে থাকছে অঢেল প্রতিশ্রুতি। অন্য দলগুলিও কম যায় না, তাঁরাও প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, সেইসঙ্গে প্রচার করে চলেছেন ওপর পক্ষের ব্যর্থতা ও শোষণের কাহিনী।
ভোট মানে শুধু যুদ্ধ বা খেলা নয়, ভোট মানে সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনও। গত কয়েক বছরে এরাজ্যেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বার বার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। এই সমস্ত নেতা-মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আপত্তিজনক মন্তব্য করলেও তাদের কোনও শাস্তি হচ্ছে না। বার বার বলে চলেছেন পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কে পাঠাবে ? কীভাবে পাঠাবে? কোন আইনে পাঠাবে? তার জন্য ওনারা কোনও আইনের ধার ধারেন না। প্রকাশ্যেই বলে চলেছেন, এটা হিন্দুরাষ্ট্র। এখানে মুসলিমদের জায়গা হবে না। তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্থানে বাসকরা হিন্দুদের কী হবে? তার উত্তর হচ্ছে, ওই তিন দেশের হিন্দুরা এদেশে স্বাগত। কিন্তু অন্য কোনও দেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে তাঁদের এদেশে জায়গা হবে না। আইনে এই যুক্তি ধোপে টিকবেনা। তবে ওরা সংবিধান ,আইন কিছুই মানতে নারাজ। ওরা যা বলবে সেটাই আইন।
কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা-নেত্রীদের এই আগ্রাসী মনোভাব এখন আর ঢাকা নেই। এ নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। কারণ ‘রাম রাজত্বে’ তাঁদের কোনও অসুবিধা নেই। তাহলে কি দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এদেশের মুসলিমরা? ওদের তাড়িয়ে দিতে পারলেই দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা, চাকুরি, মেয়েদের নিরাপত্তা, সব আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠবে? দেউলিয়াপন সরকারের সব বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতা পাল্টে যাবে? সরকারি চাকুরির মেয়াদ ৬০ পর্যন্ত থাকবে তো? দলিত নিধন মেনে নেবেন? মেনে নেবেন শিশু ধর্ষণ ও হত্যা?
শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষরা একটু তলিয়ে ভাববেন না? মানলাম, এই মুহূর্তে কোন দলকেই নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু তার মধ্য থেকেই মন্দের ভালোকে তো বেছে নিতে হবে। প্রতিশ্রুতি মানে ভাঁওতা। এটা তো না বোঝার কোনও কারণ নেই। যারা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা তো আগেই কাজগুলো করে ফেলতে পারতেন। ভোট ফুরিয়ে গেলে,ক্ষমতায় আশার পর দেখা যাবে ‘এটা পেলে সেই সেটা দিতে ভুলে যাবে’। বার বার প্রতিশ্রুতি ভাঙলে মানুষ তো বিশ্বাস হারাবেই।
২০২০ সালে করোনা জাঁকিয়ে বসার আগে পর্যন্ত এন আর সি নিয়ে সারা দেশকে তোলপাড় করে তুলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, মানে ভারতীয় জনতা পার্টি। কলকাতা থেকে দিল্লির সাহিন বাগে বৃদ্ধা থেকে কিশোরী মুসলিম মহিলারা এন আর সি বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, করোনা বা কোভিড-১৯ না এসে পড়লে সরকারের ক্ষমতায় কুলোচ্ছিল না ওদের হটিয়ে দেওয়ার। ভোটে ভারতীয় জনতা পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে এটা অন্যতম প্রতিশ্রুতি যে মুসলিমদের এদেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল মানুষেরা কী ভাবছেন জানা না গেলেও এক শ্রেণির মানুষ বহুদিন ধরে যে শুধু স্বপ্ন দেখছে, বললে ভুল হবে। তারা নিজেদের মত করে পছন্দও করে নিয়েছে, মুসলিমদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে তাদের বাড়িগুলো কে কোনটা দখল করবে। আগে একান্তে তাদের এই আলোচনা ফিসফিস করে হলেও, এখন ওদের জটলায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এই ভাগবাটোয়ারার হিসেব। এমনটা আগে কখনো শোনা যায়নি। সীমান্তবর্তী এলাকায় তাড়িয়ে দিয়ে দখল করার ঘটনার কথা শোনা যায় উভয় প্রান্ত থেকে।
এবারের ভোটে সব দিকদিয়েই বেশ একটা চমক আছে, নতুনত্ব আছে। আর সেটা দেখার জন্যই মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে। চমক শুধু গ্ল্যামার জগতের পার্থীদেরই নয়, এবার দলে দলে দল বদল করার মধ্যেও বেশ চমক আছে। চলচ্চিত্র জগতের আভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভোটে প্রার্থী করার অর্থ সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের বোকা বানিয়ে ভোট পাওয়া। সেইসঙ্গে ওই সমস্ত গ্ল্যামার জগতের প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। এদের অনেকের শেষ জীবনটা অর্থের অভাবে খুব দুর্দশায় কাটে। ভোটে পার্থী হতে পারাটা এঁদের কাছে মস্ত সুযোগ। একবার জিততে পারলেই আমৃত্যু পেনশন পাওয়া যাবে, শেষ বয়সে অর্থের চিন্তা করতে হবেনা।
দলের আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকে না। দল মানে সমষ্টি।দল পরিচালনা করেন নেতা- নেত্রীরা। তাহলে দল বদল করে কি হবে? মানুষ ও তার মানসিকতা তো একই থাকছে। মানুষ অনেক সময় ভোট দেন ভয়ে। ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করা হয় বলেই নেতা- মন্ত্রীদের সবসময় নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘুরতে হয়। ইউরপের দেশগুলিতে প্রধানমন্ত্রীকে সাধারণ মানুষের মত, সাধারণ মানুষের মধ্যে চলাফেরা করতে দেখা যায়। আমাদের মত গরিব দেশে নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের নিরাপত্তা রক্ষীদের জন্য কত টাকা ব্যয় হয় তার হিসেব জনগণের জানা নেই।
এদিকে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমুল্যের কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। শাক-সব্জি, চালডাল সবই অগ্নিমূল্য। অথচ কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছে না। তাই তারাও ভাবতে বাধ্য হচ্ছে কৃষি আইনের বিরোধিতা করবে? না পক্ষে যাবে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। এবার শুধু দেখার পালা। ফলাফল এখন অনেক দেরি। সময় বলবে সেটা।
পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments